Home / বিশেষ সংবাদ / স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে পাট
jute ..

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে পাট

পাট চাষ ও পাটশিল্পের সঙ্গে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জড়িত। পাটশিল্প হলো বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ভারী শিল্প, যা ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের একক বৃহত্তম শিল্প। বর্তমান বিশ্বের পাট ও পাটজাত দ্রব্যের বৈদেশিক রপ্তানি আয়ের বৃহৎ অংশই বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে, যা মোট বিশ্ববাজারের প্রায় ৬৫ শতাংশ।

আমাদের দেশেই পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নতমানের পাট উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ৩ শতাংশ আসে পাট থেকে এবং দেশের জিডিপিতে এর অবদান প্রায় ৩ শতাংশ। প্রতি বছর প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কৃষক পেয়ে থাকে পাটের আঁশ ও পাটকাটি বিক্রি করে। এ দেশের প্রায় ৪০ লাখ কৃষক পাটের ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জড়িত। এ ছাড়া কাঁচা পাট ও পাটজাত দ্রব্য বাংলাদেশের রপ্তানি ক্ষেত্রে রাজস্ব আয়ের একটি বড় উৎস।

পাট খাতের উন্নয়নে পাট ও পাটজাত পণ্যকে ২০২৩ সালের ‘প্রোডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ বা বর্ষপণ্য এবং পাটকে কৃষিজাত পণ্য হিসেবে গণ্য করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাট এখন থেকে কৃষিজাত পণ্য হিসেবে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত হবে।

কৃষি বিপণন আইন অনুসারে কৃষিপণ্য হিসেবে এখন থেকে পাটের সর্বনিম্ন মূল্য ও যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়ন করবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। ইতোমধ্যে পাটচাষিদের কৃষিঋণ ও কৃষি মন্ত্রণালয় প্রদত্ত ভর্তুকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিজেএমসির অধীন বন্ধ ঘোষিত মিলগুলোর পাওনা ও অন্যান্য দায়-দেনা পরিশোধে ৫৭৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার।

বাংলাদেশের পাট এখন পশ্চিমা বিশ্বের গাড়ি নির্মাণ, পেপার অ্যান্ড পাল্প, ইনস্যুলেশন শিল্প, জিওটেক্সটাইল হেলথ কেয়ার, ফুটওয়্যার, উড়োজাহাজ, কম্পিউটারের বডি তৈরি, ইলেকট্রনিক্স, মেরিন ও স্পোর্টস শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে।

পাট ও পাটজাত বর্জ্যের সেলুলোজ থেকে পরিবেশবান্ধব বিশেষ সোনালি ব্যাগ, পাটের তৈরি জিন্স (ডেনিম), পাট ও তুলার মিশ্রণে তৈরি বিশেষ সুতা (ভেসিকল), পাট কাটিংস ও নিম্নমানের পাটের সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে নারিকেলের ছোবড়ার সংমিশ্রণে প্রস্তুত জুট জিওটেক্সটাইল, পাটকাঠি থেকে উৎপাদিত ছাপাখানার বিশেষ কালি (চারকোল) ও পাট পাতা থেকে উৎপাদিত ভেষজ পানীয় দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।

পাট দিয়ে তৈরি শাড়ি, লুঙ্গি, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, বাহারি ব্যাগ, খেলনা, শোপিস, ওয়ালম্যাট, আল্পনা, দৃশ্যাবলি, নকশিকাঁথা, পাপোশ, জুতা, স্যান্ডেল, শিকা, দড়ি, সুতলি, দরজা-জানালার পর্দা, গহনা ও গহনার বাক্সসহ ২৩৫ রকমের আকর্ষণীয় ও মূল্যবান পণ্য দেশ-বিদেশে বাজারজাত করা হচ্ছে। জলবায়ু আন্দোলনের অংশ হিসেবে পানি, মাটি ও বায়ুদূষণকারী পলিব্যাগ উৎপাদন এবং ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র জনমত তৈরি হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ার ফলে পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর শিল্প, রাসায়নিক দ্রব্যসামগ্রীর পরিবর্তে অর্গানিক বা পচনশীল ও নবায়নযোগ্য সামগ্রীর চাহিদা বাড়ছে। পাট ও পাটপণ্য শুধু পরিবেশবান্ধব এবং সহজে পচনশীলই নয়; এটা পরিবেশকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে।

বর্তমান বিশ্ব-বাস্তবতায় পরিবেশবান্ধব তন্তু হিসেবে আবার পাটের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে,পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যবহার আগামি দু-তিন বছরের মধ্যেই সারাবিশ্বে তিন গুণ হবে। ফলে পাটপণ্যের বাজার সৃষ্টি হবে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়নের। দুনিয়াব্যাপি পাটের ব্যাগের চাহিদা বৃদ্ধি ও আমাদের দেশের উন্নতমানের পাট– এ দুইয়ের সম্মিলন ঘটাতে পারলে বাংলাদেশেরও সফলতা আসতে পারে।

মানসম্মত পাট উৎপাদন ও পণ্য বহুমুখীকরণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে স্বদেশি পাটপণ্যের কার্যকর ব্র্যান্ডিংয়ের উদ্যোগ নেয়া এবং পাটপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে আইনগত প্রতিবন্ধকতা দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, গ্রিন ইকোনমি ও সবুজ পৃথিবীর বাস্তবতায় বিশ্ববাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় সোনালি আঁশের হারানো সোনালি দিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

লেখক : ড.মো.আল-মামুন,প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট
এজি