রাজনীতি

পরনির্ভরশীলতায় দিশেহারা বিএনপি

বিএনপির নির্ভরশীলতায় হ্রাস নিজস্ব সামর্থ্য ।

পরনির্ভরশীলতায় ক্ষমতায় যাওয়া অসম্ভব। চরম পরনির্ভরশীলতায় বরং নিজস্ব শক্তি-সামর্থ্য হ্রাস প্রাপ্ত হয়; নেতা-কর্মীরা হতাশায় ভোগে। ১/১১ এর আঘাতের পর বিএনপি মনে হচ্ছে নিজস্ব ছন্দ হারিয়েছে। পরনির্ভরশীলতায় আক্রান্ত হয়েছে। কেউ এসে কিছু করে দেবে বলেই চাতক পাখির মতো বসে আছে দলটি।

উপমহাদেশে বিভিন্ন বড় দল অতীতে পরনির্ভশীলতায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শেরে বাংলার কৃষক শ্রমিক পার্টি, ভাসানীর ন্যাপ, মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরা নিজস্ব শক্তি যত না ব্যবহার করেছে, পরনির্ভশীল হয়েছে বেশি। যার ফল ভালো হয়নি। দলগুলো নির্জীব হয়ে বা লুপ্ত হয়ে গেছে। শেরে বাংলা নানা দলের সঙ্গে কোয়ালিশন করে ক্ষমতায় ছিলেন। ভাসানী ন্যাপ চরম মুহূর্তে রাজনৈতিক নিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে। কমিউনিস্টরা বেড়ে উঠেছে আওয়ামী লীগের ছায়ায়। ফলে তাদের দল ও রাজনীতির বিকাশের বদলে অবক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। সে তুলনায় শেখ মুজিব ও জিয়াউর রহমান উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। ষাটের দশকে তরুণ শেখ মুজিব ৬ দফার আন্দোলন এককভাবে চালিয়ে নিয়ে শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার নেতায় পরিণত হন। জিয়াউর রহমান কোনোই রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্যাপক জনসমর্থন ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। আজকের আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আদিনেতাদের অনেক কাজেরই সুফল ভোগ করছেন। কিন্তু আদিনেতাদের মতো ত্যাগ, কৃচ্ছ্বতা ও আত্মশক্তি দেখাতে পারছেন না।

বিগত দিনে বিএনপির নির্ভরশীলতার মাত্রা সর্বক্ষেত্রে তীব্রভাবে ফুটে ওঠে। মনে হয়েছে, বিএনপি বসে আছে অন্যের আন্দোলনের ফসল নিজের ঘরে তুলবার জন্য। প্রথমে মনে হয়, হেফাজত আন্দোলন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে পতিত করবে আর বিএনপি সে সুযোগে ক্ষমতায় যাবে। হেফাজতের সঙ্গে বিএনপি ও ১৯ দল সমন্বিত ও শক্তিশালী অবস্থান নেয়নি। তারপর মনে হয়েছে, বিএনপি যেন বসে আছে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের মুখ চেয়ে। তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এবং আন্দোলন যুগপত চালাতে ব্যর্থ হয় দলটি। শেষ দিকে দেশব্যাপী জামায়াতের অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিএনপি অপেক্ষা করেছে অচল দেশের রাজধানী ঢাকা দখল করার জন্য। কিন্তু দল আন্দোলনে না থাকায় বেগম জিয়া যখন ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’র ডাক দিলেন, তখন নেতা-কর্মীরা জনগণকে নিয়ে বের হতে পারেনি। বিরাট বড় একটি আন্দোলন বলতে গেলে মাঠে মারা যায়। আওয়ামী লীগ এক তরফা শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করে। আর নির্ভরশীল বিএনপির নেতা-কর্মীরা আন্দোলনের মাঠ থেকেও সরে গিয়ে নিশ্চুপ হয়ে যায়। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সবসময়ই নেতা-কর্মীদের সরবভাবে মাঠে রাখার প্রয়োজনীয়তা বিএনপি অতীতের মতো বর্তমানেও বুঝতে পারেনি।

অতীতে জেনারেল নাসিমের ক্যু প্রচেষ্টার সময় ঢাকায় পিন্টু ও আব্বাস মাঠে ব্যাপক কর্মী বাহিনী নিয়ে উপস্থিত থাকায় রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস তাদের দমনে শক্ত অবস্থান নিতে পারেন। ১/১১ এর আগে-পরে বিএনপি তেমন জনসমর্থন নিয়ে এগিয়ে আসেনি। এমনকি শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়াকে প্রায়-গৃহবন্দী করে ফেলার সময়ও দলগতভাবে বিএনপি তীব্র প্রতিরোধমূলক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেনি। এজন্য বিএনপির আন্দোলনবিমুখ নীতি, সুবিধাবাদ, সাংগঠনিক দুর্বলতা, নীতি ও কৌশলগত সীমাবদ্ধতা এবং পরনির্ভরশীলতাকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

পরনির্ভরশীলতার ক্ষেত্রে বিএনপিকে সব সময় জামায়াত-নির্ভরশীলতার অভিযোগ শুনতে হয়। সমালোচকরা বলেন, বিএনপি ক্রমেই জামায়াতের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে। বিএনপি ১/১১ এর পর নির্বাচনে গেছে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদের উগ্র অবস্থান ও চাপের কারণে। দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মত-বিনিময় ও আলাপ-আলোচনা না-করে জামায়াতের কথায় নির্বাচনে গিয়ে স্মরণকালের সবচেয়ে কম আসন পেয়েছে বিএনপি এবং ১/১১ এর বিতর্কিত ও তাদের ভাষায় ‘অবৈধ’ সরকারকে বৈধতা দিয়েছে। অথচ তখন যৌথ বাহিনীর আক্রমণে দেশব্যাপী বিএনপির নেতাকর্মীরা জর্জরিত ছিল। নির্বাচন করার মতো মানসিক ও সাংগঠনিক শক্তি তাদের ছিল না। আবার গত নির্বাচনেও বিএনপি যেন না-যায় সেজন্য চাপ দিয়েছে জামায়াত।

এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রতিটি দলই নিজ নিজ স্বার্থ ও দলগত অবস্থান নিয়ে কাজ করবে এবং অন্যকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিএনপি নিজের কর্মসূচি বন্ধ রেখে অন্যের চাপের জন্য অপেক্ষা করবে কেন? এমন প্রশ্ন রেখে তারা বলেন, বিএনপির উচিত নিজস্ব কর্মসূচি ও দলীয় স্বার্থে এজেন্ডা সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়া। সংগঠন গড়ে তোলা। আন্দোলনের মাধ্যমে নিজের দলকে চাঙ্গা করা এবং বিভিন্ন কৌশল ও কর্মসূচি প্রণয়ণের ভিত্তিতে রাজনীতি করা। নিজস্ব কাজের পরিধি না বাড়ালে অন্য যে কোনোও দলই নানা ক্ষেত্রে বিএনপির ওপর প্রভাব বিস্তার করবে এবং বিএনপি অন্যের দ্বারা প্রভাবিত থেকে নিজের শক্তি ও সামর্থ্যকে ব্যবহার ও বিকশিত করতে পারবে না।

বিএনপির জামায়াত-প্রীতি নিয়ে দলের বাইরের সমালোচনার সঙ্গে সঙ্গে দলের ভেতরেও নেতা-কর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ আছে। কিন্তু বিএনপি সেটা দলীয় পর্যায়ে যুক্তিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করতে পারছে না। এ কারণে বহু স্থানে দেখা গেছে, ১৯ দলের ব্যানারে বিএনপি ও জামায়াত ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে পারছে না। এতে সরকারবিরোধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন বেগ পাচ্ছে না। আন্দোলনকারীদের নিজেদের দ্বন্দ্ব ও অবিশ্বাসের কুফল ছড়িয়ে পড়ছে নেতা-কর্মীদের মধ্যে। বিশেষত সর্বসাম্প্রতিক উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াত একত্রে কাজ করতে পারেনি। অনেক স্থানে বিএনপি ও জামায়াতের ভোটের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে নির্বাচনের জিতে গেছে আওয়ামী লীগ। ফলে জামায়াত ফ্যাক্টর বিএনপির জন্য কতটুকু লাভজনক আর কতটুকু ক্ষতিকর, সেটা পর্যালোচিত হওয়া দরকার মনে করা হলেও বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

একইভাবে জামায়াতের সঙ্গে জোটগত ঐক্য ও সমঝোতা কতটুকু ও কী রূপ, সেটাও দলের ভেতরে ও বাইরে স্পষ্ট করা হয়নি। বিএনপির জোটসঙ্গী হিসাবে জামায়াত অ্যাসেট না লাইবিলিটি, সেটা বিএনপিকেই বিচার-বিশ্লেষণ করে ঠিক করতে হবে এবং সবার কাছে স্পষ্ট করতে হবে। জামায়াতের সঙ্গে অস্পষ্টতা ও সুপ্ত-নির্ভরশীলতার সমালোচনা কাটানোর জন্য বিএনপির প্রয়োজন নিজস্ব কর্মসূচি ও সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু সে পথে যাওয়ার মতো ত্যাগী নেতা-কর্মীর অভাব দলটি কাটাতে পারছে না।

নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময়১১:০৫ এ.এম, ২৬ এপ্রিল ২০১৭,বুধবার
ইব্রাহীম জুয়েল

Share