Home / বিশেষ সংবাদ / পরকীয়া প্রেমিক রুবেলকে দিয়ে স্বামীকে খুন করালো সোনিয়া
পরকীয়া প্রেমিক রুবেলকে দিয়ে স্বামীকে খুন করালো সোনিয়া

পরকীয়া প্রেমিক রুবেলকে দিয়ে স্বামীকে খুন করালো সোনিয়া

নিউজ ডেস্ক, চাঁদপুর টাইমস :    আপডেট: ০৩:২৩ অপরাহ্ণ, ২৯ জুলাই ২০১৫, শনিবার

মোবাইল ফোনে মিসড কল। এ মিসড কলের সূত্র ধরে আলাপ ও মন দেওয়া-নেওয়া সোনিয়া ও রুবেলের। এরপর চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, বাটারফ্লাই পার্ক, ফয়’স লেকে দেখা করতেন দু’জন। এভাবেই তিন বছর কেটে যায়। ততদিনে এলএলবি পাস করা সোনিয়াকে বিয়ে দিতে তার পরিবার উঠেপড়ে লাগে। এরই মধ্যে ঘটকের বদৌলতে বর হিসেবে খোঁজ আসে ওবায়দুল হাসানের। ওবায়দুল বন্দর নগরীর প্রতাপশালী রাজনীতিবিদ ও সানোয়ার গ্রুপের কর্ণধার নুরুল ইসলাম বিএসসির ভাগ্নে হওয়ায় ওই প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করে সোনিয়ার পরিবার।

এতে সোনিয়ার দ্বিমত থাকলেও পছন্দের পাত্র রুবেলের পড়াশোনা শেষ হয়নি। তাই পরিবারের চাপ ও রুবেলের বেকারত্বের দায়ে শেষ পর্যন্ত গত বছরের ১৪ নভেম্বর নুরুল ইসলাম বিএসসির ভাগ্নেকে বিয়ে করেন সোনিয়া। কিন্তু বিয়ের ৮ মাস না পেরুতেই পুরনো প্রেমিকের সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্নে তাকে দিয়ে খুন করা হয় স্বামীকে। হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ক্ষুদ্রাস্ত্র কেনার জন্য সাবেক প্রেমিক রুবেলের হাতে তুলে দেন ৬০ হাজার টাকা। সোনিয়ার টাকায় কেনা অস্ত্রে ২৬ জুন রাজধানীর কলাবাগান থানার গ্রিন রোডে রুবেল তার ভাগ্নে ও বন্ধুদের নিয়ে বর্তমানে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির ভাগ্নেকে ছিনতাইকারীর নাটক সাজিয়ে হত্যা করে। ঘটনার পর হত্যাকান্ডে অংশ নেওয়া দুই যুবক মাহমুদুল হাসান মিঠু ও তানভীর আহমেদকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য উঠে আসে।

তাসমিন খাদিজা সোনিয়া। চট্টগ্রামের মেয়ে। পড়াশোনা করত রাজধানীর ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগে। এখানেই চাঁদপুরের ছেলে সাইফুল হাসান রুবেলের সাথে প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। সোনিয়ার পরিবার এ সম্পর্ক না মেনে গত ফেব্রুয়ারিতে বিয়ে দেয় পিতৃহীন ওবায়দুল হকের সাথে। তিনি প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির ভাগ্নে।

ওবায়দুল রাজধানীর ভূতের গলিতে মন্ত্রীর বাড়িতেই স্ত্রী সোনিয়াকে নিয়ে থাকতেন। আর পান্থপথে বসুন্ধরা সিটিতে মামার সানোয়ারা গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান কোয়ালিটি আইসক্রিমের কার্যালয়ে জেনারেল ম্যানেজারের (জিএম) দায়িত্ব পালন করতেন।

এদিকে বিয়ের পরও রুবেলের সাথে সম্পর্ক রাখছিল সোনিয়া। দুজনে মিলে ফন্দি করেন ওবায়দুলকে মেরে ফেলার। অস্ত্র কিনতে রুবেলকে ৬০ হাজার টাকাও দেয় সোনিয়া। কথামত গত ২৬ জুন রাতে রাজধানীর ভূতের গলিতে কলাবাগান থানার সামনে গুলিতে খুন হন ওবায়দুল। হত্যাকাণ্ডে রুবেল ছাড়াও অংশ নেয়, তার তিন ভাগ্নে মাহমুদুর হাসান মিঠুম তানভীর আহমেদ ও পাপ্পু।

এই হত্যাকাণ্ডকে ছিনতাই হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয়। প্রেমিক রুবেল গা ঢাকা দেয়। আর সোনিয়া চট্টগ্রামে শ্বশুর বাড়িতে চলে যায়। কিন্তু সিসিটিভির ফুটেজ আর মোবাইল ফোনের রেকর্ড দেখে প্রযুক্তির সাহায্যে ওবায়দুল হত্যার রহস্য উন্মোচন করে গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) পুলিশ। ডিবি সূত্র জানায়, বসুন্ধরা সিটি শপিংমলের অফিস থেকে প্রায় প্রতিদিনই রাত ১০টার মধ্যে বাসায় ফিরতেন ওবায়দুল। সে হিসাবে ২৬ জুন রাত ৯টার কিছু আগে ওই শপিংমলের সামনে অবস্থান নেয় ঘাতকরা।

তবে ওইদিন ১২টার কিছুক্ষণ আগে অফিস থেকে বের হন ওবায়দুল। বসুন্ধরা সিটির সামনের সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, তিনি মার্কেট থেকে বের হওয়ার পরই তার পিছু নেয় মিঠু। এ সময় সে মোবাইল ফোনে রুবেলকে ওবায়দুলের বের হওয়ার খবর জানায়। এরপর ওবায়দুল রিকশা যোগে তার ভূতের গলির ৫৭ নম্বর বাসার দিকে রওনা দেয়। এ সময় ওই বাসার সামনে মোটরসাইকেলে করে ওঁৎ পেতেছিল রুবেল, পাপ্পু ও তানভীর। ওবায়দুল রিকশাযোগে কলাবাগান থানার কাছে পৌঁছলে তাকে গুলি করে ঘাতকেরা।

এ সময় মটরসাইকেলের সামনে ছিল পাপ্পু, মাঝে রুবেল ও পেছনে তানভীর। রুবেলই প্রথম ওবায়দুলকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। তার গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার পর তানভীর পিস্তল কেড়ে নিয়ে ওবায়দুলের মাথা লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ওবায়দুলের কাছ থেকে ল্যাপ্টপ ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায় ঘাতকেরা। আর রিকশা চালক মাথায় গুলিবিদ্ধ ওবায়দুলকে কলাবাগান থানায় নিয়ে যান। পরে রাতে আড়াইটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।

ডিবি জানায়, সিসিটিভির ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ জানার পর ঘাতকদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের অভিযানে নামে পুলিশ।

ওবায়দুল হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির এসআই দীপক কুমার দাস জানান, জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে রুবেলের দুই ভাগ্নে মিঠু ও তানভীরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে প্রথমে ঢাকা থেকে মিঠুকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে পাবনা থেকে তার ভাই তানভীরকে ধরা হয়। পরে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর দুজনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।

এদিকে হত্যাকাণ্ডের রাতে রুবেল, সোনিয়া, পাপ্পু, মিঠু ও তানভীরের মধ্যে মোবাইল ফোনে যেসব কথা হয় সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানির কাছ থেকে তার রেকর্ড সংগ্রহ করে পুলিশ। ডিবি সূত্র জানায়, ফোন রেকর্ডে দেখা গেছে ওবায়দুলকে হত্যার আগে রাত সাড়ে ৮টা থেকে ১২টা ১৬ মিনিট পর্যন্ত সোনিয়া-রুবেল মোবাইল ফোনে ১৩ বার কথা বলে।

ফোন রেকর্ডে দেখা গেছে, মিঠু রুবেলকে বলে, ‘মামা আজ বাদ দাও, ভালো লাগছে না।’ উত্তরে রুবেল তাকে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরামর্শ দেয়। এরপর রাত ১১টা ২৫ মিনিটে রুবেল মোবাইল ফোনে সোনিয়াকে বলে, ‘প্রায় দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করছি। ওরা আর অপেক্ষা করতে চাচ্ছে না। তুমি বললে অন্য কোনোদিন ঠিক করি।’ জবাবে সোনিয়া রুবেলকে বলে, ‘আমি আর পারছি না, যা করার আজকেই করতে হবে। আর যদি না পার, তাহলে কাল আমার মৃত্যু সংবাদ পাবে।’

এরপর রাত ১২টা ১৬ মিনিট। সোনিয়ার মোবাইলে ফোন করে রুবেল বলে, ‘অপারেশন সাকসেস। আমার মোবাইল ফোনটি কিছুদিন বন্ধ থাকবে। আমাকে খোঁজার দরকার নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমি নিজেই যোগাযোগ করব।’ এরপর থেকেই রুবেলের মোবাইল বন্ধ আছে।

এদিকে হত্যাকাণ্ডে জড়িত মূল ঘাতক (শুটার) তানভীর ও তথ্যদাতা মিঠু আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এতে তারা হত্যা পরিকল্পনায় সোনিয়ার জড়িত থাকার কথা জানায়। ডিবি সূত্র জানায়, সোনিয়ার সংশ্লিষ্টতার কথা জানার পর থেকে তাকে নজরদারিতে রাখা হয়। বুধবার মধ্যরাতে ঢাকার ডিবির একটি দল তাকে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করে। বৃহস্পতিবার সোনিয়াকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।

ডিবির ডিসি মাশরেকুর রহমান বলেন, ওবায়দুল খুন হওয়ার পর শ্বশুর বাড়িতেই ছিলেন সোনিয়া। তবে গোয়েন্দারা হত্যাকাণ্ডে তার সম্পৃক্ততা বিষয়টি জেনেছে জানার পর তিনি চট্টগ্রামের ট্রিটমেন্ট হাসপাতালে জ্বর নিয়ে ভর্তি হন। পুলিশ চট্টগ্রামে গিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করতে পারে আশঙ্কায় হাসপাতাল থেকেও পালিয়েছিলেন তিনি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দীপক কুমার দাস বলেন, নিছক ছিনতাইয়ের ঘটনা নয়, ওবায়দুলকে পরিকল্পিতভাবেই হত্যা করা হয়েছে। আর এ খুনের নেপথ্যে রয়েছেন তারই স্ত্রী সোনিয়া। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাটি প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ এখন পুলিশের হাতে রয়েছে। তিনি আরো বলেন, সোনিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এমদাদুল হকের আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন জানায় ডিবি পুলিশ। আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। তবে সোনিয়া তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা থাকায় সাবধানতার সঙ্গে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রুবেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক থাকার কথা স্বীকার করেছে সোনিয়া। স্বামীকে হত্যার বিষয়ে তার সায় ছিল দাবি করলেও অস্ত্র কেনার জন্য রুবেলকে টাকা দেয়ার বিষয়টি বারবার এড়িয়ে যাচ্ছে সে। সূত্র জানিয়েছে, শিগগিরই চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত রুবেল ও তার অপর ভাগ্নে পাপ্পুকে গ্রেফতার এবং হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও মোটরসাইকেল উদ্ধার হবে।

 

চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/এমআরআর/২০১৫

চাঁদপুর টাইমস ডট কমপ্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, আলোকচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করা বেআইনি