ফিচার

নিভৃত পল্লী থেকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পেছনে যার অনুপ্রেরণা বেশি ছিলো

গ্রামের নাম কামালপুর। কিশোরগঞ্জ হাওর এলাকার এক নিভৃত পল্লী। দুর্গম আর হতদরিদ্র মানুষের এ গ্রামে জন্ম নেয়া দুরন্ত এক শিশুর বেড়ে ওঠা। আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখে শিশুটি।

হাওরের প্রবেশদ্বার করিমগঞ্জ উপজেলা। গ্রামের নাম জাফরাবাদ। ওই গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে রাশিদা খানম। পরিবারের মত-অমতের বাধা পেরিয়ে ওই হাওর-বালকের মন কেড়ে নেন রাশিদা খানম। আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নে শক্তি আর সাহস জোগাতে থাকেন তিনি।
সেই থেকে গল্পের শুরু। একজন নারী কতটা শ্রম-মেধা-মননে তার প্রিয় মানুষটিকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহস আর অনুপ্রেরণা জোগাতে পারেন, রাশিদা তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

দেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের স্ত্রী তিনি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতির মুখে নিজ স্ত্রীকে নিয়ে নানা রসালো গল্প শুনে থাকবেন নিশ্চয়ই। তবে আজকের একজন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ হয়ে ওঠার পেছনের মানুষটির কথা কয়জনই জানেন! রাশিদা হামিদের প্রেরণায় শুরু হয় একজন সহজ-সরল আর আপাদমস্তক রাজনীতিক আবদুল হামিদের পথচলা। যে পথের শেষ বঙ্গভবন।

তবে আবদুল হামিদ আর রাশিদা হামিদের চলার পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না। স্বামী রাজনীতি করেন। এটাই যেন ছিল অপরাধ। এজন্য কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি এ মহীয়সী নারীকে। এমনকি ছেলে রাজনীতি করে বলে তার আত্মীয়রা প্রথমে আবদুল হামিদের কাছে বিয়ে দিতে রাজি হননি! স্বামী-সন্তানের জন্য রাশিদাকে জীবনভর সহ্য করতে হয়েছে নানা প্রতিকূলতা। তবে কিছুতেই দমে যাননি তিনি। স্বামী আর সংসারের জন্য নিজের জীবন তুচ্ছ মনে করেছেন। পরিবারের খোঁজ-খবর আর ভরণ-পোষণ চালাতে গিয়ে নিজের প্রতি খেয়াল রাখার সুযোগ পাননি।

জাগো নিউজ’র সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে সংগ্রামী এ নারীর জীবনকথা। জানান, শুধু রাজনীতি করায়, মানুষের জন্য কাজ করায় তার স্বামী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ আর তাকে কী পরিমাণ নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে।
করিমগঞ্জ উপজেলার জাফরাবাদ গ্রামের মৃত আব্দুল হালিম খানের চার ছেলে আর দুই মেয়ের মধ্যে রাশিদা সবার বড়। তিন ছেলে আর এক মেয়ের মা। বাড়ির পাশের মাছিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর ১৯৬৩ সালে এসভি সরকারি বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল সরকারি কলেজে ভর্তি হন। এ সময় পরিচয় হয় কামালপুরের সেই কিশোর গুরুদয়াল সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের তৎকালীন জিএস মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে। পরিচয় থেকে প্রেম। তারপর বিয়ে। এইচএসসি পাস করার আগেই আবদুল হামিদের সঙ্গে বিয়ে হয়।

তবে বিয়ের পর্বটাও সহজ ছিল না। রাজনীতি করা ছেলের সঙ্গে কিছুতেই বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না তার মামা-খালারা। কিন্তু ততদিনে আবদুল হামিদ আর রাশিদার মন বাঁধা পড়ে গেছে মাছিমপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠের বকুল গাছের ফুলের মালার মতোই! বকুলতলা থেকে কুড়িয়ে আনা ফুল দিয়ে মালা গেঁথে প্রতিদিন আবদুল হামিদকে উপহার দিতেন রাশিদা। কী করে বিচ্ছিন্ন হয় সেই মধুর মিলন! অগত্যা রাশিদার নানা সেই সময়কার পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য মাওলানা সাইদুর রহমানের হস্তক্ষেপে ১৯৬৪ সালে বিয়ে হয় প্রেমিক আবদুল হামিদের সঙ্গে। তখন থেকেই সংগ্রামী জীবনের শুরু রাশিদার।


রাশিদা হামিদ বলেন, এসএসসি পাস করার পর বিয়ে! মামা বিয়ের বিষয়ে মত বদলে ফেলতে পারেন। এজন্য তাড়াহুড়া করে বিয়ে হয়ে যায়। স্বামী রাজনীতি করেন। কিশোরগঞ্জে একটি ছোট বাসায় থাকতাম। গ্রামের বাড়ি থেকে ছোট ছোট অনেক দেবর আর ভাগ্নে বাসায় থেকে লেখাপড়া করে। তাদের কেউ পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে, কেউবা ষষ্ঠ শ্রেণিতে। সারাদিন বাসায় লোকজন লেগেই থাকত। তাদের চা-নাশতা দেয়া, পরিবারের লোকজনের জন্য রান্না, খাওয়ানো সব আমাকে সামলাতে হতো।

‘বিয়ের পর হঠাৎ করে এমন অবস্থায় পড়লাম, কোনো অবসর ছিল না। নিজের দিকে খেয়াল রাখার সুযোগ ছিল না। টানাপোড়েনের সংসার। সংসার বাড়তে থাকে। ছন্দপতন ঘটে নিজের লেখাপড়ায়। কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকি। গভীর রাতে একটু একটু করে পড়ি। এভাবে এইচএসসি পাস করি। স্বামী আর বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নিজের জীবন নিয়ে কোনো চিন্তার সুযোগ পাইনি। তবে আমার স্বামী মানুষকে ভালোবাসে। সহজিয়া। সৎ রাজনীতিক। এজন্য একদিন ও ভালো করবে- এমন বিশ্বাস ছিল আমার’- বলছিলেন, দেশের টানা দু’বারের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের স্ত্রী রাশিদা হামিদ।

স্বামীর দীর্ঘ রাজনীতিক জীবনে জেল-জুলুম, হুলিয়া আর নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে রাশিদা হামিদ বলেন, ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র শিক্ষা আন্দোলন, ছয়দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, সর্বোপরি ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলন আর একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন আবদুল হামিদ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় মিঠামইনে গ্রামে গ্রামে পালিয়ে বেড়াতে হয় রাশিদাকে। ডাকাতরা কেড়ে নেয় সবকিছু। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে সন্তানদের মুখে সময়মতো খাবার তুলে দিতে পারেননি। মেলেনি প্রয়োজনীয় কাপড়। তবে থামেনি তার জীবন-সংগ্রাম। আবদুল হামিদকে রাজনীতির কারণে বারবার জেলে যেতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৬ সালে গ্রেফতার করা হয় আবদুল হামিদকে। দুই বছর পর তাকে জেল থেকে বের করে আনেন রাশিদা হামিদ।

রাশিদা হামিদের ছোট ভাই আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডা. আ. ন. ম নওশাদ খান বলেন, কতটুকু ধৈর্য থাকলে কঠিন পরিস্থিতিতে অবিচল থেকে স্বামীকে পেছনে থেকে প্রেরণা দিয়ে মর্যাদার আসনে তুলে দিতে পারেন, আমার বোন তার অন্যতম উদাহরণ।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেনাবাহিনী আবদুল হামিদকে কিশোরগঞ্জের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। গভীর রাতে সেই সময়কার আবদুল হামিদের শিক্ষক গুরুদয়াল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ওয়াসীম উদ্দীন খানকে দিয়ে রাতে আবদুল হামিদকে বাসা থেকে ডেকে বের করা হয়। সকালে রাশিদা হামিদ জানতে পারেন, তার স্বামীকে আর্মিরা ধরে নিয়ে গেছে। কিশোরগঞ্জ জেল থেকে তাকে পাঠানো হয় ময়মনসিংহ কারাগারে। পরে আবদুল হামিদকে নেয়া হয় রাজশাহী ও কুষ্টিয়া কারাগারে। কুষ্টিয়া কারাগারে থাকার সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ঢাকার পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই সময় রাশিদা স্বামীকে দেখতে ঘুরে বেড়ান দেশের বিভিন্ন কারাগারে। একদিকে পরিবার আরেক দিকে সংসার। দুই দিকই সামলাতে হয় তাকে। হাসপাতালে ভর্তির পর রাশিদা হামিদ আদালতে রিট করেন।

ডা. নওশাদ খান বলেন, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের মতোই আমার বোন সারাজীবন পরিবার, এলাকাবাসী ও সাধারণ মানুষের সেবায় নিয়োজিত। মায়ের মতোই আদর দিয়ে তিনি আমাদের এতগুলো ভাই-বোনকে বড় করেছেন। তিনি একজন মহান শিক্ষক। তার কাছ থেকে আমরা জীবনের পাঠ নিয়েছি।
১৯৮১ সালের ঘটনা। তখন দেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তার পিএস ছিলেন রাশিদা হামিদের মামা কর্নেল এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমান। তাকে দিয়ে আবদুল হামিদ ও রাশিদা হামিদকে ক্যান্টনমেন্টের বাসায় ডেকে পাঠান জিয়াউর রহমান। তাকে প্রস্তাব দেয়া হয় আওয়ামী লীগ বাদ দিয়ে তার মন্ত্রিপরিষদে যোগ দিতে। কিন্তু রাশিদা হামিদ ও তার স্বামী আবদুল হামিদ সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এজন্য অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয় তাদের।

রাশিদা হামিদের বড় ছেলে জাতীয় সংসদের সদস্য প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক বলেন, আম্মা আমার আদর্শ। আব্বা রাজনীতির বাইরে পরিবারের খোঁজ নিতে পারতেন না। সবকিছু সামলাতে হয়েছে আম্মাকে।

তিনি বলেন, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আমাদের পরিবারকে কঠিন সময় পার করতে হয়। পরিবারের উপার্জনক্ষম কেউ ছিল না। ভরণ-পোষণের জন্য আম্মা আমাদের নিয়ে আশুগঞ্জে মামার বাসায় চলে এলেন। ছয় মাস সেখানে ছিলাম। আব্বা জেলে থাকার সময় ১৫ দিন পরপর আম্মা আমাদের নিয়ে আব্বাকে দেখতে যেতেন। আইনি বিষয়গুলো নিজেই খোজঁ-খবর নিতেন। আব্বাকে রাজশাহী জেলে নেয়ার পর আম্মার জন্য আরও কঠিন হয়ে পড়ে। এমন সময় গেছে টাকার অভাবে আমাদের একমাত্র ছোট বোনটি অসুস্থ হয়ে পড়লেও তার চিকিৎসা করাতে পারিনি। কিন্তু আম্মা কোনো কিছুর বিনিময়ে কোনো আপস করেননি। অবিচল থেকে আব্বাকে সাহস জোগাতেন। কুষ্টিয়া জেল থেকে আব্বাকে অসুস্থ অবস্থায় পিজি হাসপাতালে ভর্তি করার পর আম্মা হাইকোর্টে রিট করেন। সেই সময়কার প্রধান বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে দেখা করে বিনাবিচারে আটক করে রাখা আব্বার মুক্তির জন্য তার সহযোগিতা চান।

মাকে নিয়ে গর্বিত এমপি রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক জানান, এত অভাব-অনটনের মধ্যেও কোনোকিছু অপূর্ণ রাখেননি তিনি।

আবদুল হামিদের মতোই সহজিয়া জীবনের মানুষ রাশিদা হামিদ। আবদুল হামিদ স্পিকার হওয়ার আগ পর্যন্ত শহরের একটি কিন্ডারগার্টেনে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন।

বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত আবদুল হালিম খান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান রাশিদা হামিদ একজন শিক্ষানুরাগী। এ ফাউন্ডেশন থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। তার পরিবারের লোকজন এটি পরিচালনা করেন। আবদুল হালিম খান ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আনোয়ার হোসেন বাচ্চু জানান, আপার মতো এমন একজন আদর্শ নারীকে পেয়ে আমরা গর্বিত। ব্যস্ততার মাঝেও মাঝে-মধ্যে ছুটে আসেন কলেজে। সবার খোঁজ-খবর নেন। তিনি আমাদের আদর্শ।
রাশিদা হামিদ বলেন, আমার স্বামী জাতীয় সংসদে সাতবার এমপি হয়েছেন। সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা, ডেপুটি স্পিকার, স্পিকার, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও পরপর দু’বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। এটা আমার জন্য অনেক গর্বের। কিন্তু আমি তার পাশে থেকেছি কোনো ক্ষমতার লোভে নয়। একজন ভালো ও সৎ মানুষ হিসেবে যতটুকু পেরেছি প্রেরণা-সাহস জুগিয়েছি। বঙ্গভবনে থাকলেও আমার মন পড়ে থাকে গ্রামে। সেই কোলাহল, শিশুদের মুখরতা আমাকে টানে। আমি মনে করি সততা ও মানুষের ভালোবাসাই আবদুল হামিদকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।

‘আমি এখনও সেই আগের মতোই। সংসার জীবন শুরু হয়েছিল কঠিন পরিস্থিতিতে। তখন রাত দেড়টা-দুটার আগে ঘুমাতে পারতাম না। সবাই ঘুমিয়ে গেলে বই নিয়ে পড়তে বসতাম। এভাবেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখনও রাত দুটার আগে ঘুমাতে পারি না’- বলেন রাশিদা হামিদ।

তিনি বলেন, ‘আবদুল হামিদকে কতটা ভালোবাসি তা কেবল আমিই জানি। ওকে কলেজ জীবন থেকেই ভালোবাসি, কারণ সে মানুষকে ভালোবাসে। কারও ক্ষতি করে না। তার সততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। এখনও বঙ্গভবনে এসে এলাকার কোনো মানুষ ডাক দিলে সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। তাকে ভালোবাসা, ভালো লাগার প্রেরণা এটাই।’

প্রতিবেদক -নুর মোহাম্মদ, সাংবাদিক, কিশোরগঞ্জ
উৎস : জাগো নিউজ

Share