Home / জাতীয় / রাজনীতি / দল পরিচালনায় বেকায়দায় বিএনপি
দল পরিচালনায় বেকায়দায় বিএনপি

দল পরিচালনায় বেকায়দায় বিএনপি

চাঁদপুর টাইমস নিউজ ডেস্ক || আপডেট: ০৫:৩১ অপরাহ্ন, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫,  মঙ্গলবার

দল পরিচালনায় স্বাভাবিক অর্থ সরবরাহ না হওয়ায় বেকায়দায় পড়েছে বিএনপি। রাজনীতির স্বাভাবিক গতি ‘আপাতত’ বন্ধ থাকায় সহসাই এ সমস্যা থেকে উত্তরণের পথও পাচ্ছে না একাধিকবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়া দলটি। তাই একদিকে দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনায় যেমন নানাবিধ সংকট মোকাবেলা করতে হচ্ছে, তেমনি অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।

সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিএনপি চরম অর্থ সংকটে পড়েছে। প্রতিদিন দলের নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নে দলীয় তহবিল শূন্যের কোঠায় বলে জানা গেছে। আগামী দিনে দল পুনর্গঠন করে রাজপথে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে চেয়ারপারসন থেকে শুরু করে নির্বাহী কমিটির সদস্যদের কাছ থেকে মাসিক চাঁদা আদায়ের উদ্যোগও কাজে আসছে না বলে জানা গেছে।

বিএনপি সূত্রে জানা যায়, শুভানুধ্যায়ীদের দান ও সহায়তা, সদস্যদের মাসিক চাঁদা, সদস্য ফরম বিক্রিই হল বিএনপির আয়ের প্রধান উৎস। আর ব্যয়ের প্রধান খাতগুলো হল— যাতায়াত, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, জনসভা, ইফতার মাহফিল, অফিস খরচ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন ইত্যাদি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আগের মতো অর্থের যোগান দিতে না পারায় বিএনপির স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। মাসের পর মাস বকেয়া পড়ে থাকছে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান অফিস ও নয়াপল্টন অফিস স্টাফদের বেতনের টাকা।

‘অর্থনৈতিকভাবে বিএনপির সংকট চলছে বা বিএনপির অর্থের উৎসে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে’— এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি দলের মুখপাত্র ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন। তবে তিনি দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কৃচ্ছ্রতা সাধনের চেষ্টা চলছে বলে জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি, অহেতুক যাতে খরচ না হয়। সে কারণে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি।’

সূত্র জানায়, বিএনপির অর্থনৈতিক নাজুক অবস্থার পেছনে রয়েছে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কঠোর নজরদারি। বিএনপিকে সহযোগিতা করে সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়ে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী বর্তমানে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, বিএনপির কাছ থেকে নানান সুবিধা নিয়ে যারা অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক বনেছেন, অবস্থা বেগতিক দেখে তাদেরও এখন আর আগের মতো সাড়া পাচ্ছে না দলটি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক যুগ্ম-মহাসচিব অর্থ সংকটের কথা সরাসরি স্বীকার না করলেও দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কিছুটা অসুবিধার কথা জানান। তিনি অভিযোগ করেন, ‘স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে যেমন সরকার বাধা সৃষ্টি করছে; তেমনি দল পরিচালনায় অর্থের যোগানেও তারা বাধা দেবে এটাই স্বাভাবিক। তবে বিএনপি দলীয় নেতাদের কাছ থেকে মাসিক চাঁদা আদায় করে দল পরিচালনার খরচ যোগান হচ্ছে। কর্মসূচি বাস্তবায়নে অনেক টাকা লাগে। এ ক্ষেত্রে নেতাদের কাছ থেকে মাসিক চাঁদা ও থোক সহযোগিতা নিয়েই দলীয় কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে।’

জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসনের এক উপদেষ্টা যিনি ব্যবসায়ী হিসেবে ও দেশের মিডিয়া জগতে একজন সফল উদ্যোক্তা, তাকে বিগত বিএনপির টানা আন্দোলনের সময় আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মূলত বিএনপির আন্দোলনে অর্থের যোগানদাতা সন্দেহেই তাকে আটক করা হয়। বিএনপির আন্দোলন থেমে যাওয়ার পর তাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। এ ছাড়া আরেক উপদেষ্টা যিনি সফল ব্যবসায়ী হিসেবেও স্বীকৃত তাকে বিভিন্ন মামলার জালে আবদ্ধ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য যাতে তিনি বিএনপির আন্দোলনে অর্থ সহযোগিতা করতে না পারেন। একইভাবে দেশের শেয়ার বাজারের এক আলোচিত ব্যবসায়ীকেও বিভিন্ন মামলায় জড়ানো হয়। তিনি দেশছাড়া রয়েছেন। সরকারের খড়গের এ সব দৃষ্টান্ত দেখে বিএনপিমনা ব্যবসায়ীরা এখন দলটি থেকে অনেকটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলেছেন।

দলীয় সূত্র বলছে, টানা অবরোধ আর হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচির পথ থেকেও বিএনপিকে সরে আসতে হয়েছে দলের অর্থনৈতিক সংকটের কারণেই। অর্থের অভাবেই নেতাকর্মীদের নামে থাকা রাজনৈতিক মামলাগুলোতে ঠিকঠাক আইনী সহায়তা দিতে পারছে না কেন্দ্রীয় বিএনপি। সাংগঠনিকভাবে কর্মীও মাঠে নামাতে পারছে না শুধু টাকার অভাবে।

পর্যাপ্ত টাকার সরবরাহ থাকলে বিএনপির বিগত কয়েক মাসের আন্দোলন কৌশল ভিন্নও হতে পারত। কিন্তু টাকার সরবরাহ কমে যাওয়ায় দল পরিচালনার প্রয়োজনীয় অর্থযোগান দিতে ব্যর্থ হয় হাইকমান্ড।

বিএনপির দলীয় তহবিলে অর্থের যোগানদাতাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও আর্থিক লেনদেনে সরকারের কঠোর নজরদারিতে অনেকে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও দলটিকে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করতে পারছেন না।

এদিকে টানা কয়েক মাসের আন্দোলনে ক্ষতির শিকার তৃণমূল কর্মী ও তাদের পরিবারগুলো কেন্দ্রীয় বিএনপি থেকে আইনী সহায়তা ও পুনর্বাসনের জন্য আর্থিক কোনো সুবিধা না পেয়ে ভীষণ ক্ষুব্ধ। স্থানীয় নেতারা যে যার সাধ্যমতো টাকা খরচ করে কর্মীদের পাশে দাঁড়ালেও সে প্রচেষ্টায় এখন ভাটার টান।

দলীয় সূত্র জানায়, দলের অর্থের যোগানে বাধা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নেতাদের দলীয় তহবিলে নিজেদের মাসিক চাঁদা প্রদানে অনীহাও এ সংকটের অন্যতম কারণ। কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন পদের নেতাদের মাসিক চাঁদা ফান্ডে নিয়মিত জমা হওয়ার কথা। কিন্তু এ সব নেতারও অনীহা চাঁদা পরিশোধে। কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন পদের এ সব নেতার দলের দফতর থেকে দফায় দফায় চিঠি দিয়েও নিয়মিত মাসিক চাঁদার টাকা পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর দলের সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিলের পর থেকে এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের ৪০ লক্ষাধিক টাকা চাঁদা বকেয়া রয়েছে।

বিএনপির সাবেক অর্থ বিষয়ক সম্পাদক বর্তমানে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু দলের অর্থের উৎস সম্পর্কে বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চালাতে অবশ্যই টাকার প্রয়োজন হয়। আর এ সব টাকা মূলত দলের সামর্থ্যবান নেতারা যোগান দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া অনেক শুভানুধ্যায়ী আছেন যারা দলের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে সহযোগিতা করে থাকেন। এটা বিএনপির জন্য যেমন, তেমনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্যও একই।’

সাবেক মন্ত্রী টুকু আরও বলেন, ‘বিভিন্ন জেলায় ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) বড় বড় জনসভাগুলোতে বেশকিছু অর্থের প্রয়োজন হয়। সে সব খরচ মূলত সংশ্লিষ্ট জেলার স্থানীয় নেতাকর্মীরাই যোগান দিয়ে থাকেন। কোনো জেলা যদি নিজ থেকে খরচ চালাতে সংকটে পড়ে, তখন হয়ত কেন্দ্রীয়ভাবে দল কিছুটা সহযোগিতা করে থাকে। তবে এ সব বিষয় চেয়ারপারসন একাই দেখভাল করেন। তিনি হয়ত কাউকে বলে দেন দলকে সহযোগিতা করার জন্য। তার আহ্বানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি খুশি মনে সহযোগিতা করেন।’

এক প্রশ্নের জবাবে টুকু বলেন, ‘কোনো ব্যবসায়ী আমাদের দলকে টাকা দেয় বলে আমার জানা নেই। বাজারে যে সব লোকদের নিয়ে গুজব-আলোচনা শোনা যায়, আমি জানি না আদৌ তারা কোনো দিন বিএনপিকে অর্থনৈতিকভাবে কোনো সহযোগিতা করেছে কি না?’

নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের এক স্টাফ নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশ নেতাই বিত্তবৈভবে সম্পদশালী। অনেকেই একাধিকবার মন্ত্রী-এমপি ছিলেন। বাড়ি-গাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্যেরও অভাব নেই তাদের। কিন্তু দল পরিচালনায় সাংগঠনিক মাসিক চাঁদা দিতে তাদের অনীহা। এ অবস্থায় সংগঠন পরিচালনায় অর্থ সংকটের কথা জানিয়ে কয়েক মাস আগে কেন্দ্রীয় নেতাদের নামে চিঠি দেন দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলীয় চাঁদা পরিশোধে অনীহা প্রকাশকারীদের মধ্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য থেকে শুরু করে নির্বাহী কমিটির সদস্য পর্যন্ত অন্তত ৪১৭ জন কেন্দ্রীয় নেতা রয়েছেন। বার বার তাগাদা দেওয়ার কারণে এবং সামনে যেকোনো সময় জাতীয় কাউন্সিল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় অনেকে নিজেদের মাসিক চাঁদা পরিশোধ করা শুরু করেছেন।’

বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পুরনো স্টাফ মো. দলিল উদ্দিন বলেন, ‘সংখ্যা বলতে পারব না, তবে অনেক নেতাই এখন তাদের মাসিক চাঁদা পরিশোধ করছেন। এখন পর্যন্ত কয়েক লাখ টাকা আদায় হয়েছে।’

মো. দলিল উদ্দিন জানান, স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মাসিক চাঁদা ১ হাজার টাকা। ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টা ৫ শ’ টাকা। যুগ্ম-মহাসচিব, সম্পাদক ও সহ সম্পাদকগণ ৩ শ’ এবং জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যদের ১ শ’ টাকা। চেয়ারপারসন ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের মাসিক চাঁদাও ১ হাজার টাকা।

নয়াপল্টন কার্যালয়ের আরেক স্টাফ মো. গাফ্‌ফার  জানান, কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন পদের নেতা ছাড়াও দল থেকে যারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তারা পদাধিকার বলে জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। তাদেরও মাসিক চাঁদা ১ হাজার টাকা মাত্র।

তিনি আরও জানান, ২০১৩ সালে বিগত ৮ম জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হলেও তখন যারা সংসদ সদস্য ছিলেন তাদের অধিকাংশরই এখনও চাঁদা বাকী আছে। স্বল্প সংখ্যক নেতা তাদের মাসিক চাঁদা পরিশোধ করেছেন। এখনও টাকার পরিমাণে প্রায় ৪০ লাখেরও বেশী চাঁদা বাকী আছে। তবে চেয়ারপারসন, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের চাঁদা হাল নাগাদ পরিশোধ করা আছে।

এদিকে গত ২৪ আগস্ট নির্বাচন কমিশনে দলের আয়-ব্যয়ের হিসাব জমা দিয়েছে বিএনপি। ওইদিন দলের চার সদস্যের প্রতিনিধিদল কমিশনের সচিব মো. সিরাজুল ইসলামের কাছে এ হিসাব জমা দেন। আয়-ব্যয়ের হিসাব জমা দিয়ে বিএনপির চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট এ কে এম আমিনুল হক সাংবাদিকদের জানান, ১ জানুয়ারি-২০১৪ থেকে ৩১ ডিসেম্বর-২০১৪ পর্যন্ত দলের মোট আয় হয়েছে দুই কোটি ৮৭ লাখ ৪৮ হাজার ৫৭৪ টাকা। ব্যয় হয়েছে তিন কোটি ৫৩ লাখ তিন হাজার ৫৯০ টাকা, অর্থাৎ ৫৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৬ টাকা ব্যয় বেশি হয়েছে। এই অতিরিক্ত টাকা গত বছরের ব্যাংক হিসাব থেকে মেটানো হয়েছে।

 

চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/ এমআরআর/২০১৫