টি-টোয়েন্টির ফেরিওয়ালা, বাংলাদেশের সাকিব

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ফেরিওয়ালা বলা হয়ে থাকে ক্রিস গেইলকে; কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের গেইলের চেয়ে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান।

দেশে-বিদেশের প্রায় সব ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে সদর্প বিচরণ সাকিবের। আইপিএল, বিগব্যাশ, ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (সিপিএল), বিপিএল, পিএসএল, এসপিএল সবখানেই আছেন তিনি। যে কোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশে টি-টোয়েন্টি লিগ হলেই, সেখানেই খেলেছেন সাকিব।

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সবচেয়ে জনপ্রিয় লিগ ধরা হয় ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগকে (আইপিএল)। কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে আইপিএলে সাকিব আল হাসানের অভিষেক ২০১১ মৌসুমে। অভিষেকের পরই বাংলাদেশ অলরাউন্ডারের শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি। ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন দলের অপরিহার্য অংশ। কেকেআরের দুটি শিরোপা জেতার পেছনে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

২০১১ সালেই সাকিবের আইপিএল যাত্রার শুরু। সেবার অবশ্য খুব বেশি ম্যাচ খেলা হয়নি তার। তবে ৭ ম্যাচ খেলে বোলিংয়ে মাত্র ৬.৮৬ ইকোনমিতে নিয়েছিলেন ১১টি উইকেট। বোলিংয়ে আলো ছড়ালেও ব্যাটিং ততটা ভাল হয়নি। ১৪.৫ গড়ে এবং ১৩১.৮১ স্ট্রাইক রেটে করেছিলেন সর্বমোট ২৯ রান, যদিও লোয়ার মিডল অর্ডারে ব্যাট করতে নামায় খুব বেশি বল খেলার সুযোগ পাননি তিনি। দল হিসেবে সেবার আইপিএল-এ চতুর্থ অবস্থানে ছিল কলকাতা।

২০১২ সালের আইপিএল-এ প্রথমবারের মত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল কলকাতা। তাতে সাকিবের বোলিংয়ের বেশ ভাল অবদান ছিল। ৮ ম্যাচে ৬.৫ ইকোনমিতে নিয়েছিলেন ১২ উইকেট, যা কিনা তার আইপিএল ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ। আগের বছরের মত ২০১২ সালেও ব্যাট হাতে তেমন উজ্জ্বল ছিলেন না সাকিব, ১৫.১৬ গড়ে এবং ১২২.৯৭ স্ট্রাইক রেটে করেছিলেন সর্বমোট ৪২ রান।

তবে ফাইনালে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে খেলেছিলেন ৭ বলে অপরাজিত ১১রানের একটি সময়োপযোগী ইনিংস। ২০১৩ সালের আইপিএল-এ কলকাতা দলে নাম থাকলেও বাংলাদেশের হয়ে জিম্বাবুয়েতে খেলতে যাওয়ায় কোন ম্যাচ খেলা হয়নি সাকিবের। দল হিসেবে সেবার গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিল কলকাতা নাইট রাইডার্স।

কলকাতার দ্বিতীয় বারের মত আইপিএলের শিরোপা জয়ের ক্ষেত্রে ২০১৪ সালে ব্যাটে-বলে সাকিবের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। আইপিএলে ওই বছরই সবচেয়ে সফল ছিলেন সাকিব।

আইপিএল ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ ১৩ ম্যাচ খেলে ৬.৬৮ ইকোনমিতে নিয়েছিলেন ১১ উইকেট। পাশাপাশি ব্যাটিংয়েও ছিল তার দারুণ পারফরম্যান্স। ৩২.৪২ গড়ে এবং ১৪৯.৩৪ স্ট্রাইক রেটে করেছিলেন ২২৭ রান, যা ছিল তার এখন পর্যন্ত আইপিএল ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ সর্বমোট রান।

সর্বোচ্চ ইনিংস ছিল রয়েল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর বিপক্ষে ৩৮ বলে ৬০ রান। শুধু তাই নয়, অসাধারণ পারফরম্যান্স করে জিতেছিলেন প্লেয়ার অফ দ্য ফাইনালের পুরষ্কারও!

Sakibপাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের সিরিজ থাকায় ২০১৫ সালে মাত্র ৪ ম্যাচ খেলেছিলেন সাকিব। বোলিংয়ে ৮.৭৮ ইকোনমিতে নিয়েছিলেন ৪ উইকেট আর ব্যাটিংয়ে ১৩৩.৩৩ স্ট্রাইক রেটে করেছিলেন সর্বমোট ৩৬ রান। সাকিবের অনুপস্থিতিতে সেবারও খুব একটা ভাল করতে পারেনি তার দল কলকাতা, গ্রুপপর্ব থেকেই আইপিএল যাত্রা শেষ করেছিল তারা।

আইপিএল ক্যারিয়ারে ২০১৬ সালকে ধরা হয় সবচেয়ে বাজে বছর। প্রথম দুই ম্যাচে উপেক্ষিত থাকলেও পরে প্রায় নিয়মিত মাঠে নামেন সাকিব। দশ ম্যাচ খেললেও ব্যাট ও বল হাতে পুরোপুরি ব্যর্থ তিনি।

দশ ম্যাচে ব্যাট করে করেন মাত্র ১১৪ রান। বোলিংয়েও ঠিক একই চিত্র। ৪৮.৬০ গড়ে উইকেট নেন মাত্র ৫টি। আইপিএল ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত মোট ৪২ ম্যাচ খেলে ২১.৬ গড়ে করেছেন ৪৯৭ রান। আর বোলিংয়ে সমান ম্যাচে ২৪.৮৮ নিয়েছেন ৪৩ উইকেট।

আইপিএলে কলকাতার হয়ে নিজের জাত চেনানো সাকিব প্রথমবারের মত পাকিস্তান সুপার লিগের (পিএসএল) প্রথম আসরে প্লাটিনাম ক্যাটাগরির খেলোয়াড় হিসেবে এক লাখ ৪০ হাজার ডলার পারিশ্রমিকে করাচি কিংসের হয়ে খেলতে যান।

হাফ সেঞ্চুরি দিয়ে পিএসএল শুরু করলেও পরবর্তীতে ফর্ম হারিয়ে খুঁজতে থাকেন নিজেকে। আট ম্যাচ খেলে ব্যাট হাতে করেন ১২৬ রান। বোলিংয়ের চিত্রটা এর চেয়ে বেশি খারাপ। সমান ম্যাচে নেন মাত্র ৩ উইকেট।

বিগব্যাশ কেবল অস্ট্রেলিয়ার জনপ্রিয় ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টই নয়, ক্রিকেট দুনিয়ায় এ টুর্নামেন্টের আবেদন গুরুত্ব অন্যরকম। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে নিত্যনতুন নানা অনুষঙ্গ যোগ হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বিগ ব্যাশের। এ টুর্নামেন্টে এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের একজনই খেলার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি সাকিব আল হাসান।

প্রথম আসরে ইয়োহান বোথার চোট বিগব্যাশে অ্যাডিলেডে সুযোগ করে দিয়েছিল সাকিবকে। মাত্র দুটি ম্যাচে অংশ নিয়ে ব্যাট হাতে করেছিলেন ৪৮ রান। হাত ঘুরিয়ে পেয়েছিলেন ২ উইকেট। পরের আসরে মেলবোর্ন রেনিগেডসে নাম লিখিয়ে বোলিংয়ে দারুণ আলো ছড়িয়েছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। টুর্নামেন্টে ৭ উইকেট নিয়ে পেসার জেমস প্যাটিনসনের সঙ্গে যৌথভাবে রেনিগেডসের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি সাকিব।

তবে প্যাটিনসন ৫ উইকেটে নিয়েছেন পাঁচ ম্যাচ খেলে আর সাকিব চার ম্যাচে। বল হাতে জ্বলে উঠলেও ব্যাট হাতে সাকিব ছিলেন অনেকটাই ম্লান। ৪ ম্যাচে ৪ ইনিংসে সাকিবের রান মাত্র ৩৯। গড় ৯.৭৫, সর্বোচ্চ ২২। এই ২২ রান করেছেন টুর্নামেন্টে নিজেদের শেষ ম্যাচ অ্যাডিলেড স্ট্রাইকার্সের বিপক্ষে। ফিল্ডিংয়ে চার ম্যাচে রান আউট করেছেন ১টি আর ক্যাচ নিয়েছেন ৩টি।

বিশ্বজুড়ে টি-টোয়েন্টি লিগ মাতানো গেইল-পোলার্ড-ব্র্যাভোদের দেশে ক্যারিবিয়ান লিগ খেলছেন সাকিব। বিসিবি থেকে অনাপত্তিপত্র না পাওয়ায় ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (সিপিএল) প্রথম আসরের পর আর খেলা হয়নি বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের।

তবে চতুর্থ আসরে জ্যামাইকা তালাওয়াহসের হয়ে মাঠ মাতাচ্ছেন সাকিব আল হাসান। চলতি আসরে এখন পর্যন্ত জ্যামাইকার হয়ে ৬ ম্যাচে মাঠে নামলেও ব্যাট করার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ৩ ম্যাচে। ব্যাট হাতে রান এসেছে ১২০, সর্বোচ্চ ৫৪*। আর বোলিং করে উইকেট নিয়েছেন ৫টি। দুটি ম্যাচে ব্যাট এবং বল হাতে জিতিয়েছেন জ্যামাইকাকে।

এদিকে বিভিন্ন দেশের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট লিগে খেলে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে ২০০তম ম্যাচ খেলার নতুন এক মাইলফলক স্পর্শ করেছেন বাংলাদেশের সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান।

এর মধ্যে ১৮৪ ইনিংসে ব্যাট করে ২১.২৬ গড়ে করেছেন ৩২৫৩ রান। আর ১৯৮ ইনিংসে বল করে নিয়েছেন ২৩৫ উইকেট। ফ্রাঞ্চাইজি লিগ খেলার জন্য এক দেশ থেকে আরেক দেশ চষে বেড়ানো সাকিবকে তাই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের ফেরিওয়ালা বলাই যায়।

নিউজ ডেস্ক ।। আপডেট ০৯:৩৫ পিএম,১৮ জুলাই ২০১৬,সোমবার
এইউ

Share