Home / চাঁদপুর / চাঁদপুরের কর্মবীর আব্দুল করিম পাটওয়ারী সম্পর্কে অজানা কিছু কথা
কর্মবীর

চাঁদপুরের কর্মবীর আব্দুল করিম পাটওয়ারী সম্পর্কে অজানা কিছু কথা

পৃথীবিতে মৃত্যুর চেয়ে অনিবার্য সত্য আর কিছুই নেই। জন্মিলে প্রতিটা মানুষকে একদিন মুত্যুর স্বাদ ভোগ করতে হবেই; এটাই পৃথিবীর বিধান। তবে ব্যক্তি বিশেষ এই মৃত্যুকে জয় করে মরেও বেঁচে থাকেন অনন্তকাল। আর সে বেঁচে থাকার একমাত্র উপলক্ষ অথবা মাধ্যম হলো ব্যক্তির কর্ম বা কাজ।

একজন ব্যক্তি তার বিশেষ কর্মগুণে ইতিহাসে যেমন নন্দিত হয়ে থাকেন, তেমনি কেউ কেউ আবার অপকর্মের জন্যে নিন্দিত থাকেন যুগ থেকে যুগান্তর।

মুত্যুকে জয় করে চাঁদপুরের মাটি ও মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকা তেমনই একজন সফল কর্মবীর মরহুম আব্দুল করিম পাটওয়ারী। চার নদীর আর্শীবাদপুষ্ট রত্মগর্ভা চাঁদপুরের এই গর্বিত ভূমিপুত্র দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এখানকার মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছেন শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায়। ইলিশের শহর খ্যাত চাঁদপুরাকাশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রতিতযষা এ রাজনীতিবিদ ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন সংগ্রাম পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, স্বাধীনতা উত্তর চাঁদপুর মহকুমার অস্থায়ী প্রশাসক ও প্রধান বিচারক, গণপরিষদ সদস্য এবং চাঁদপুর পৌরসভার দুই বারের সফল চেয়ারম্যান ছিলেন। মাতৃভাষা অর্জনের আন্দোলনে তিনি চাঁদপুরে সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের দ্যুতিময়তায় তিনি শুধুমাত্র চাঁদপুরই নয় গোটা বাংলাদেশে সুপরিচিতি অর্জন করেন।

এই আলোকিত মানুষটি ১৯২৫ সালে চাঁদপুরে শহরের তালতলা পাটোয়ারী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম রৌশন আলী পাটোয়ারী। দাম্পত্য জীবনে তিনি ৫ পুত্র এবং ২ কন্যা সন্তানের জনক।

কর্মবীর

মরহুম আব্দুল করিম পাটওয়ারী

নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত ড্যান শেচম্যানের একটি বিখ্যাত উক্তি ‘টেকসই উন্নয়নের জন্য মানুষের চেতনা প্রয়োজন। মানুষ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।’ একজন মহৎ কিংবা ভালো মানুষ নির্ধারণের একমাত্র মানদন্ড হচ্ছে ভালো কাজ। ব্যক্তি জীবনকে সুন্দর, উদার এবং আকর্ষণীয় করে তুলতে ভালো কাজ অপরিহার্য। আর এই ভালো কাজ মানে, যে কর্ম দিয়ে পৃথিবীর কল্যাণ আর মানুষের মঙ্গল হয়। চাঁদপুরবাসীর আপনজন মরহুম আবদুল করিম পাটোয়ারী তাঁর যাপিত জীবনে মানুষের কল্যানে কাজ করে গেছেন। তিনি ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের একজন কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে পর্দাপণ করেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। সুদীর্ঘ বর্ণাঢ্য রাজনীতিক জীবনে চাঁদপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব কালিন সময়ে তার সততা ও নিষ্ঠা এবং ন্যায় পরায়নতার কারণে দলের নেতাকর্মীদের কাছে তিনি একজন আদর্শিক রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেন।

বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক ও দিপ্তময় অর্জন মহান ভাষা আন্দোলনের সময়ে আব্দুল করিম পাটোয়ারি চাঁদপুরে সংগঠকের দায়িত্বে ছিলেন।পাকিস্তানকালীন সময়ে তিনি ছিলেন বিডি মেম্বার ও এমপিএ। বাঙালী জাতির সর্বোচ্চ অর্জন মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি সংগ্রাম পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি চাঁদপুর মহকুমার অস্থায়ী প্রশাসক ও প্রধান বিচারক, এমসিএ, তৎকালীন মহকুমা রিলিফ ও ফুড কমিটির সভাপতি, কৃষি উন্নয়ন কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। প্রয়াত এই জননন্দিত গণমানুষের নেতা চাঁদপুরের প্রথম পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে সবচেয়ে বেশি সুখ্যাতি অর্জন করেন। চাঁদপুর পৌরসভার দুই-দুই বার নির্বাচিত চেয়ারম্যান (১৯৭৩-১৯৮২) থাকাকালিন সময়ে কর্মদক্ষতা, সততা ও ন্যায়পরায়নতায় তিনি অধুনিক চাঁদপুর পৌরসভার রূপকার খ্যাতি অর্জন করেন। পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকাকালিন নগর উন্নয়নের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সমাজসেবী এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্যে জায়গা দান করেন।

এছাড়াও ব্যক্তিজীবনে তিনি অসংখ্য সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: সাবেক চাঁদপুর মহকুমা রেডক্রস সোসাইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট, চাঁদপুর জেলা রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির আজীবন সদস্য ও কার্যকরী কমিটির সদস্য, ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের চীফ ওয়ার্ডেন, চাঁদপুর জেলা কারাগারের অস্থায়ী পরিদর্শক, চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের সদস্য, কচি-কাঁচার মেলা চাঁদপুর-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন ডায়াবেটিক সমিতি, মাজহারুল হক বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল, চাঁদপুর ফাউন্ডেশন। একজন ধর্মানুরাগী ও শিক্ষানুরাগী হিসেবে মরহুম আব্দুল করিম পাটওয়ারীর ব্যপক পরিচিত ছিলেন। তিনি চাঁদপুর শহরের বাসস্ট্যান্ড মসজিদে গোর-এ গরীবা’র প্রতিষ্ঠাতা এবং পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি, আঞ্জুমানে খাদেমুল ইনসান চাঁদপুর-এর প্রতিষ্ঠাতা (১৯৬৮ খ্রি.) ও পাটওয়ারী বাড়ি জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি এবং শহরের বিষ্ণুদী আজিমিয়া সপ্রাবি’র পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন।

২০০০ সালের ২১ জানুয়ারি বর্ষিয়ান রাজনীতিক ও সফল এই সমাজকর্মীর ৭৫ বছর বয়সের বর্ণাঢ্য উজ্ব্বল জীবনের অবসান ঘটে। তিনি ওইদিন মহান স্রষ্টার ডাকে সাড়া দিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে চাঁদপুরের আকাশ থেকে যেনো একটি উজ্জল নক্ষত্র প্রস্থান করে। তবুও সুন্দরের আলোয় উদ্ভাসিত কর্মবীর মরহুম আব্দুল করিম পাটওয়ারী মৃত্যুকে জয় করে আজও চাঁদপুর তথা এদেশের মাটি ও মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছেন শ্রদ্ধায়, সম্মানে- ভালোবাসায়।

আশিক বিন রহিম
লেখক পরিচিতি : সাহিত্য ও সংবাদকর্মী, সাধারণ সম্পাদক: চাঁদপুর সাহিত্য মঞ্চ। প্রকাশিত গ্রন্থ: চাঁদপুরের চাঁদমুখ, জাল ও জলের আখ্যান, পদ্মপ্রয়াণ।