Home / খেলাধুলা / ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে জয়ের নায়ক মুশফিক
Mushfiq
ফাইল ছবি

ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে জয়ের নায়ক মুশফিক

ঘরের মাঠে, ২১৪ রান করেও টি-টোয়েন্টিতে শ্রীলঙ্কা যে হেরে গেছে বাংলাদেশের কাছে। সেই বাংলাদেশ, যাদের তারা কিছুদিন আগেই হারিয়ে এসেছে ঘরের মাঠে। সেই বাংলাদেশ, যারা টানা হারে পর্যুদস্ত। ঠিক সেখান থেকেই বাংলাদেশের এমন প্রত্যাবর্তন, যে জয়ের বর্ণনায় রূপকথা শব্দটাও বড্ড কম পড়ে যায়! ২ বল হাতে রেখে ৫ উইকেটে পাওয়া জয়—এই শব্দগুলোর কী সাধ্য এক অনন্য অভিজ্ঞতার সাক্ষী হওয়ার!

মেঘলা দিনের পর মেঘ কেটে যাওয়া সন্ধ্যায় টস জিতে বোলিং নিয়েছিলেন মাহমুদ উল্লাহ। আগের ম্যাচে ১৩৯ রানের পুঁজি নিয়েও জোর লড়াই উপহার দিয়েছিলেন তাঁর দলের বোলাররা। তাঁদেরই একজন তাসকিন আহমেদ বেশ বড় মুখ করেই সংবাদ সম্মেলনে বলে গিয়েছিলেন ১৭০-১৮০ রানের ভেতর প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কাকে আটকে রাখার সংকল্পের কথা। তাঁর ভাগ্যটাই ছিল কাল সবচেয়ে খারাপ, ৩ ওভারে দিলেন ৪০ রান। কুশল পেরেরার ৪৮ বলে ৭৪ আর কুশল মেন্ডিসের ৩০ বলে ৫৭ রানের দুটি ইনিংসের সঙ্গে উপুল থারাঙ্গার অপরাজিত ৩২ রানের ক্যামিওতে শ্রীলঙ্কার রান গিয়ে দাঁড়ায় ২০ ওভার শেষে ৬ উইকেটে ২১৪। টেস্ট পরিবারের কোনো দলের বিপক্ষে এটাই শ্রীলঙ্কার সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ, এর আগে ২০০৭ সালে কেনিয়ার বিপক্ষে শ্রীলঙ্কা করেছিল ২৬০ রান।

যে দলটা আগের ম্যাচে ৫৫ বল থেকে কোনো রান নিতে পারেনি, তাদের আত্মবিশ্বাস তলানিতেই থাকার কথা। গণমাধ্যমেও তির্যক মন্তব্য, সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন; এসবই তো দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের পর থেকে নিত্যসঙ্গী। ভারতের কাছে পাত্তাই না পাওয়া দলটা যে শ্রীলঙ্কার এই রানের সৌধ এক লহমায় গুঁড়িয়ে দেবে, কোচ চন্দিকা হাতুরাসিংহে কি সেটা ভেবেছিলেন?

উদ্বোধনী জুটিতে খানিকটা পরিবর্তন। তামিম ইকবালের সঙ্গী লিটন কুমার দাস। ডানহাতি-বাঁহাতির সমন্বয় আর নিজেকে হারিয়ে খোঁজা সৌম্য সরকারকে খানিকটা সময় দিতেই এই কৌশল। শুরুটা স্বপ্নের মতো করে দিয়ে গেলেন লিটন কুমার দাস। ৫ ছক্কা আর ২ বাউন্ডারিতে মাত্র ১৯ বলে ৪৩ রানের অসাধারণ ইনিংসের শেষটা হয় নুয়ান প্রদীপের বলে লেগ বিফোর উইকেটের শিকার হয়ে।

তবে এর আগে কবজির মোচড়ে তাঁর ছয়ের মারগুলো আলপনা হয়েই আঁকা থাকবে ক্রিকেটপ্রেমীদের চোখে। তামিম শুরুতে কিছুটা সাবধানী, লিটনের বিদায়ে বের হলেন খোলস ছেড়ে। ৬ বাউন্ডারি আর ১ ছক্কায় সাজানো ২৯ বলে ৪৭ রানের ইনিংসের সমাপ্তিটা থিসারা পেরেরার হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা বলে বোলারকে রিটার্ন ক্যাচ দিয়ে। ওয়ানডাউনে নামা সৌম্যও ২২ বলে ২৪ রানের কার্যকর ইনিংস খেলে সচল রেখেছেন রানের চাকা। তবে বাংলাদেশ দলকে জেট ইঞ্জিনের গতি এনে দিয়েছেন মুশফিকুর রহিম। চাপের মুখে ৩৫ বলে ৭২ রানের এক অসাধারণ ইনিংস; যেখানে তাঁর প্রিয় স্লগ সুইপ, রিভার্স সুইপ, আপার কাটসহ টি-টোয়েন্টির কার্যকর সব শট থেকে আসা বাউন্ডারি আর ওভার বাউন্ডারিগুলোই হারের শঙ্কা ফুটিয়ে তুলছিল শ্রীলঙ্কার সমর্থকদের চোখে-মুখে।

শেষবেলায় মাহমুদ উল্লাহর ১১ বলে ২০ রানের ছোট্ট ঝড়টাও কম কাজে লাগেনি। থিসারার উঁচু ফুল টসে লং অন দিয়ে ছক্কা, নো বলে ফ্রি হিট পেয়ে পরের বলে বাউন্ডারি। থিসারার ওভারে ওই বাড়তি রানটাই বেশ এগিয়ে রাখে বাংলাদেশকে।

যদিও মাহমুদ উল্লাহর বিদায় আর সাব্বিরের শূন্য রানে রান-আউট হওয়াটা বেঙ্গালুরুর সেই বিভীষিকাই জাগিয়ে তুলেছিল অনেকের মনে। এত কাছে এসেও আবার কি পুড়তে হবে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায়? তেমনটা হতে দেননি মুশফিক।

১৯তম ওভারের পঞ্চম বলে মিডউইকেট দিয়ে মারা বিশাল ছক্কায় সেই স্মৃতিকেই যেন বাইরে ফেললেন। পরের বলে এক রান নিয়ে রাখলেন স্ট্রাইক। থিসারার করা ম্যাচের শেষ ওভারে প্রথম বলটায় নিলেন দুই রান, স্ট্রাইক রাখলেন নিজের কাছেই।

পরের বলে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট দিয়ে চার, জয়ের সঙ্গে ব্যবধান তখন হাতছোঁয়া দূরত্বের। তবু যে ভয় কাটে না, মনে পড়ে যায় বেঙ্গালুরু, বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘মারাকানাজো’। সেদিনও তো মাঠে ছিলেন এই মুশফিকই, জয়ের নিঃশ্বাস দূরত্ব থেকে ফিরে আসার স্মৃতিটাও তাই ফিরে ফিরে আসে। কিন্তু এবার আর ভুল করেন না মুশফিক।

দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা তাঁকে বানিয়েছে পোড় খাওয়া সৈনিক, জানেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে হার-জিতের ফয়সালা হয় না। থিসারার পরের বলটা ছিল ইয়র্কার, কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। লং অনে ঠেলে দিয়ে মিসফিল্ডিংয়ের ফায়দা উঠিয়ে তুলে দুই রান, খেলায় তখন সমতা। আর হারার ভয় নেই বাংলাদেশের! পরের বলটা নিচু ফুলটস, মিড উইকেটে আলতো করে ঠেলে দিয়ে এক রান নিয়েই মুশফিক মেতে ওঠেন বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে! আর বিস্ময়ে বিমূঢ় শনিবার রাতের প্রেমাদাসা স্টেডিয়াম।

জয়ের পর স্টেডিয়ামের লাউড স্পিকারে বাঁধাধরা নিয়মে বাজছে চটুল সুরের গান, নাচছে চিয়ার লিডাররা। কিন্তু সেসবই যে মনে হচ্ছে অসহ্য! কিছুদিন আগে মিরপুরের মাঠে যে এই অভিজ্ঞতাই হয়েছিল বাংলাদেশের, ১৯৩ রান করেও হেরে যাওয়ার পর।

প্রেস বক্সটা মিরপুরের নয় বলে মেতে ওঠা যায়নি বাঁধভাঙা উল্লাসে। তবে বাংলাদেশ থেকে আসা সব সাংবাদিক যে ভেতরে ভেতরে আনন্দে মাতোয়ারা তা নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই।

ম্যাচ শেষের সংবাদ সম্মেলনে এসে তামিম ইকবাল বলে গেলেন, এই জয়টা বড্ড দরকার ছিল। প্রমাণ করা দরকার ছিল বাংলাদেশ যেভাবে খেলছে, এতটা খারাপ তারা নয়। নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ রাখার সঙ্গে সঙ্গে আসলে আরো একটা ব্যাপারও পরিষ্কার করে দিয়েছেন তামিম-মুশফিকরা।

বাংলাদেশের সাফল্যের একমাত্র কারণ চন্দিকা হাতুরাসিংহে নন। শ্রীলঙ্কায় রোজ রোজ চলতে-ফিরতে, উৎসাহী ট্যাক্সিচালক থেকে শুরু করে টিকিট কাটার লাইনে দাঁড়ানো মানুষটার কাছ থেকে হাতুরাসিংহের মাহাত্ম্য শুনতে যে আর ভালোও লাগছিল না!