Home / সারাদেশ / ঘরের মধ্যে একাই লাশের জানাজা দিয়ে চৌকির পাশে কবর
Bondhur lash maze..
ছবিতে আটককৃত ভয়ংকর বন্ধু মামুন (বামে), পুলিশের সাথে হাতকড়া পরা অবস্থায় বন্ধুর লাশ উত্তোলন করছেন (ডানে)

ঘরের মধ্যে একাই লাশের জানাজা দিয়ে চৌকির পাশে কবর

১১ দিনের মাথায় আরেকটি ‘ভয়ংকর’ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করল পাবনা জেলা পুলিশ। এবার ধরা পড়েছে বন্ধুরূপী ভয়ংকর এক খুনি। তাঁর নাম মামুন হোসেন।

হত্যার ৫৬ দিন পর কীভাবে ধরা পড়ল সেই খুনি? কীভাবে প্রিয় বন্ধু রবিউল ইসলামকে হত্যা করেন মামুন? কীভাবে লাশ গুম করেন? কীভাবে উদ্ধার হলো বন্ধুর কঙ্কাল? কেন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড?

এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন পাবনার পুলিশ সুপার জিহাদুল কবীর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্টে তুলে ধরেছেন মামলার তদন্তের বর্ণনা।

এর আগে জানিয়ে দেই পাবনার সুজানগর উপজেলার মানিকহাট ইউনিয়নের উলট গ্রামে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। রবিউল ইসলাম আর মামুন হোসেন পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুজনই সুজানগর উপজেলার সেলিম রেজা হাবিব ডিগ্রি কলেজের বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। রবিউলকে হত্যার অভিযোগে পুলিশ গত বৃহস্পতিবার মামুনকে গ্রেপ্তার করে।

পাবনার পুলিশ সুপার জিহাদুল কবীর তাঁর ফেসবুকে যা জানিয়েছেন, তা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো :

“লাশের চেহারা এত বিকট হয়! বোটকা পচা গন্ধে পেট গুলিয়ে আসছে। তার চেয়েও বড় কথা, একটা মানুষ লাশের সঙ্গে একই ঘরে ঘুমালোই বা কীভাবে? একদিন নয়, দুদিন নয়, গুনে গুনে ছাপান্ন (৫৬) দিন ধরে ঘরের মেঝের নিচে লাশটা লুকিয়ে রাখা সহজ কথা নয়। তাও আবার নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুর লাশ। কৌতূহল জাগলে পড়তে থাকুন…

২০-৯-১৭ তারিখে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন পাবনার সুজানগর উপজেলার উলট গ্রামের রবিউল। বৃদ্ধ বাবা সকালে ঘুম থেকে উঠে খুঁজতে থাকেন রবিউলকে। কিন্তু ঘরে তাঁকে খুঁজে পান না। ভাবেন, কোথাও বেড়াতে গেছে বুঝি। পরদিনও ঘরে ফেরেন না রবিউল। হঠাৎ রবিউলের ভাইয়ের ফোনে একটা এসএমএস আসে।

‘ভাইকে বাঁচাতে চাইলে ৫০ (পঞ্চাশ) লক্ষ টাকা পাঠাও’। এইবার সবাই নড়েচড়ে বসে। রবিউলের বাপ-ভাই কী করবেন বুঝতে না পেরে তাঁর সবচেয়ে কাছের বন্ধু মামুনের কাছে যান।

তিনিও তাঁদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুকে খুঁজতে থাকেন। মাঝখানে আরো একটা দিন কেটে যায়। কোনো উপায় না দেখে সুজানগর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন রবিউলের বড় ভাই। জিডি নম্বর : ৯৩৬, তারিখ ২২-৯-১৭। তদন্তের দায়িত্ব বর্তায় উপপরিদর্শক (এসআই) বেলালের ওপর। বিভিন্ন সূত্র ধরে তিনি এগুতে থাকেন।

একপর্যায়ে বাদীপক্ষ অধৈর্য হয়ে যায়। হৃদয় নামের একজনকে আসামি করে অপহরণ মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর : ১১, তারিখ ৫-১০-১৭। পুলিশ হৃদয়কে গ্রেপ্তার করে। তাঁর স্বীকারোক্তি মোতাবেক গ্রেপ্তার হয় আরো পাঁচজন। তারা টাকা চাওয়ার কথা স্বীকার করলেও রবিউলের কোনো হদিসই দিতে পারে না। তীরে এসেও তরী ডোবার মতো ঘটনা। সব যেন গোলমেলে লাগছিল। তাহলে রবিউল গেলেন কই?

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও প্রশাসন) গৌতম কুমার বিশ্বাস ও সুজানগর সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার রবিউল ইসলামও কোমর বেঁধে নামলেন কাজে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম আইটিতে দক্ষ কাউকে কাজে লাগাতে হবে। দায়িত্ব দেই ডিবির এসআই অসিতকে। অদম্য কৌতূহলী অসিত সব শুনে মনোযোগ দিলেন রবিউলের জীবনযাপনের ওপর। ঘটনা ঘাঁটাঘাঁটির একপর্যায়ে জানতে পারলেন, রবিউলের সঙ্গে সর্বশেষ যোগাযোগ হয়েছিল মামুনের। মামুন কোথায়?

ঘটনার ১০-১৫ দিন পরই ঢাকায় চলে গেছেন চাকরির খোঁজে। নানা প্রলোভনে ডেকে আনা হলো তাঁকে। কী নিষ্পাপ নুরানী চেহারা। শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখ। ২০-২২ বছরের টগবগে যুবক মামুন। কী হাসি-খুশি ছেলেটা। কোরআন-হাদিসের জ্ঞান অগাধ। শুধু একটা বিষয় তাঁর জানা ছিল না। আর সেটা হলো পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ। রবিউল যেদিন হারান, সেই দিন তাঁর মোবাইলের শেষ কলে তিনি মামুনকে কী বলেছিলেন? আর তাঁকে পাঠানো এসএমএসটা কী ছিল? এই দুই প্রশ্নের জালেই ফেঁসে গেলেন মামুন। তাঁকে বলতেই হলো সেই ভয়ংকর রাতের কথা।

২০-০৯-২০১৭ তারিখ। রাত প্রায় ১১টা। প্রেমঘটিত একটা ব্যাপারে রবিউলকে মামুন তাঁর বাসায় ডেকে আনেন। এরপর পূর্বপরিকল্পিতভাবে কৌশলে রবিউলকে কড়া ঘুমের ওষুধ মেশানো পানি খাওয়ান তিনি। এরপর পরিকল্পনা মতো শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় রবিউলকে। তারপর যা ঘটেছে তা কল্পনারও অতীত। মামুন ঘরের মধ্যে একাই লাশের জানাজা পড়েছেন। বন্ধুকে তাঁর শোয়ার চৌকির পাশে মেঝের মাটিতে কবর দিয়েছেন। তাহাজ্জুদের নামাজও পড়েছেন।

পরের দিন খুব স্বাভাবিকভাবে রবিউলের বাপ-ভাইদের সঙ্গে খোঁজাখুঁজি করেছেন। আবার ফাঁকে ফাঁকে পরিচয় গোপন করে মোবাইল ফোনে রবিউলের ভাইয়ের কাছে মুক্তিপণের টাকাও চেয়েছেন। এর কিছু দিন পর চলে যান ঢাকায়। কেউ ঘুণাক্ষরের জানতে পারেননি কী হয়ে গেছে। কে জানত কোনো এক এসআই অসিত বা বেলালের মতো কোনো পুলিশ তাঁর সবটুকু ঢেলে দিয়ে বের করে আনবে ঘটনার ভেতরের ঘটনা।

৫৬ দিন পর ১৭ নভেম্বর সকালে শত শত গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে মাটি খুঁড়ে তাঁরই দেখানো মতে বের করে আনা হবে হতভাগা রবিউলের লাশ। সত্য প্রকাশ পাবেই। জয় হোক পাবনা জেলা পুলিশের। জয় হোক পেশাদারিত্বের। আল্লাহ আমাদের নিরাপদ রাখুন” বলে পুলিশ সুপার জিহাদুল কবীর তাঁর লেখা শেষ করেন।

এর আগে পাবনার পুলিশ সুপার জিহাদুল কবীর জানান, মামুন ও রবিউল দুজনই একটি মেয়েকে পছন্দ করতেন। তবে মেয়েটি পছন্দ করতেন রবিউলকে। এরই ফলে রবিউলকে হত্যার পরিকল্পনা করেন মামুন। আটকের পর মামুন পুলিশকে এসব তথ্য জানান। মামুনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। (এনটিভি)

নিউজ ডেস্ক
: পডেট, বাংলাদেশ ৯ : ০৩ পিএম, ১৯ নভেম্বর, ২০১৭ রোববার
ডিএইচ

Leave a Reply