মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন এবং রবির কাছে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা আদায়ের জন্য টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন- বিটিআরসি এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অপারেশনাল ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ শুরু করেছে।
এই দুই অপারেটরের বিশাল সংখ্যক গ্রাহক এবং গ্রাহকদের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকার পরেও বিটিআরসি এ পদক্ষেপ নিয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার বিটিআরসি দেশের সব ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট অপারেটরদের জানিয়ে দিয়েছে, বরাদ্দকৃত সর্বমোট ক্যাপসিটির মধ্যে গ্রামীণফোনের ৩০ শতাংশ আর রবি’র ১৫ শতাংশ ব্যান্ডউইড্থ কমিয়ে দিতে।
এ ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াতে আজ বিকেলে গ্রামীণফোনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘নিরীক্ষা প্রতিবেদন নিয়ে বিরোধ নিস্পত্তির লক্ষ্যে বিটিআরসি’র প্রতি আমাদের আইনগত শালিসি প্রক্রিয়ার যে আহ্বান ছিলো সেটির প্রতি এটি রীতিমতো অবজ্ঞাসূচক একটি নির্দেশনা। এ ধরণের একটি নির্দেশনায় আমরা বিস্মিত এবং এর আইনগত বৈধতা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। ব্যান্ডউইথ কমিয়ে আনার এধরণের জবরদস্তিমূলক সিদ্ধান্ত গ্রাহকস্বার্থের পরিপন্থি। এ ধরণের সিদ্ধান্ত আমাদের গেটওয়ে পার্টনারদের জন্যে একটি শাস্তিস্বরূপ সিদ্ধান্ত। এটি দেশের লাখো ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সেবা পাবার অধিকারের পথে অন্তরায় তৈরি করবে।’
প্রসঙ্গত, গত ২২ মে অনুষ্ঠিত বিটিআরসির ২২৭তম সভায় উেই মোবাইল অপারেটরদের বিরুদ্ধে আট ধরণের অপারেশনাল ব্রবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়।
ওই সিদ্ধান্তের সময় এ ব্যবস্থায় কী ধরণের প্রভাব পড়তে পারে সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা হয়। এ বিষয়ে গত ৪ জুন কালের কণ্ঠে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়।
বিটিআরসির আট ধরণের অপারেশনাল ব্যবস্থার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে বা আইজিডব্লিউ প্রান্ত থেকে ব্যান্ডউইড্থ বন্ধ বা সীমিত করা। এর ফলে এ দুই অপারেটরের ইন্টারনেট সেবার মান কমবে বা ব্যাহত হবে বলেও সভার কার্যপত্রে উল্লেখ করা হয়। অন্য সাতটি সম্ভাব্য ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে, বিটিআরসি থেকে এ দুই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে অনাপত্তি বা অনুমোদন পত্র জারি বন্ধ করে দেওয়া।
এতে প্রতিষ্ঠান দু’টির নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ বন্ধ হয়ে যাবে। এমএনপি পোর্ট ইন বন্ধ বা সীমিত করার পরিকল্পনাও হাতে রাখা হয়েছে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট অপারেটর তাদের নেটওয়ার্কে পোর্ট ইন সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে না বা এ সুবিধা সীমিত হয়ে পড়বে। এর চাইতে কড়া পদক্ষেপ হতে পারে নতুন গ্রাহক নেওয়া বন্ধ বা সীমিত করে দেওয়া।
ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে বা আইজিডব্লিউ প্রাপ্ত থেকে অন্তর্গামী বা বহির্গামী কল বন্ধ বা সীমিত করণের পদক্ষেপও নেয়া হতে পারে। আইসিএক্স বা ইন্টার কানেকশন এক্সচেঞ্জ-এর মাধ্যমে বন্ধ বা সীমিত করে দেওয়া হতে পারে স্থানীয় কল। নেটওয়ার্ক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বা এসএমএস-এর মাধ্যমে সারাদেশ বা নির্দিষ্ট এলাকায় ৩জি ও ৪জি সেবা বন্ধ করে দেওয়ার পদক্ষেপও নেয়া হতে পারে।
এদিকে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে গত মার্চ পর্যন্ত দেশে মোবাইল ফোনের ভয়েস গ্রাহক পৌঁছেছে ১৬ কোটির উপরে। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহক সাত কোটি ৪০ লাখ। দেশের মোবাইল ইন্টারনেট গ্রাহক নয় কোটি ৩১ লাখের উপরে। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহক তিন কোটি ৭৫ লাখের উপরে। গ্রামীণফোনের মার্কেট শেয়ার ৪৬ শতাংশ। অন্যদিকে রবির গ্রাহক চার কোটি ৭৩ লাখের কাছাকাছি। এ অপারেটরের ইন্টারনেট গ্রাহক দুই কোটি ৯০ লাখের কাছাকাছি। মার্কেট শেয়ারও ৩০ শতাংশ। এ অবস্থায় এই দুই মোবাইল ফোন অপারেটরের ব্যান্ডউইড্থ কমিয়ে দেওয়াতে গ্রাহকদের উপর এর বিরূপ প্রভাব পড়বে বলেই সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা।
প্রসঙ্গত, বিটিআরসি গ্রামীণ ফোনকে গত ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা পরিশোধ করতে বলে। গ্রামীণ ফোনের সিস্টেম নিরীক্ষার পর সর্বশেষ এই পাওনার পরিমান নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে বিটিআরসির পাওনা আট হাজার ৪৯৪ কোটি এক লাখ টাকা এবং এনবিআরের পাওনা চার হাজার ৮৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এনবিআরকেও গ্রামীণ ফোনের কাছে এই পাওনা আদায়ের জন্য আলাদা চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া বিটিআরসি গত বছরের ৩১ জুলাই ১০ কার্যদিবসের মধ্যে পাওনা পরিশোধের জন্য চিঠি দেওয়া হয়; কিন্তু রবি এতে রাজি নয়। এতে রবির কাছে পাওনার পরিমাণ উল্লেখ করা হয় এক হাজার ২৫১ কোটি ৬৭ লাখ ৯৭ হাজার ৫৫১ টাকা।
বিটিআরসি এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে রবির কাছে চিঠি পাঠায়। এ অডিট প্রতিবেদন সম্পর্কে রবির বেশি আপত্তি ছিল স্পেকট্রাম চার্জ বিষয়ে। পরে রবির যুক্তি ও দাবি মেনে পাওনার পরিমাণ ৩৮৪ কোটি ৪৪ লাখ ছয় হাজার ৭৫ টাকা কমিয়ে ৮৬৭ কোটি ২৩ লাখ ৯১ হাজার ৪৭৬ টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়; কিন্তু তাতেও সম্মত নয় রবি। গ্রামীণফোনও বলেছে, বিটিআরসির ওই দাবি আইনগতভাবে ভিত্তিহীন।
বিটিআরসি সূত্র জানায়, ব্যান্ডউইড্থ কমিশয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের আগে সর্বশেষ গত ১৩ জুন দুই অপারেটরকে তাগিদপত্র দেওয়া হয়।