কয়েদীদের কাছে কখনো মহিয়সী মা, কখনো বোন, কখনো বা অদম্য এক কঠোর কর্মকর্তা।
তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন জয়পুরহাট জেলা কারাগারের প্রধান কাওয়ালিন নাহার। একজন সফল নারী হিসেবে যিনি ইতিমধ্যেই পরিচিতি লাভ করেছেন।
এমন ত্রিমুখি খ্যাতি লাভের পেছনে রয়েছে অজানা গল্প।
জয়পুরহাট কারাগারের জেল সুপার কাওয়ালিন নাহারের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেছে, তিনি পাবনার সাথিয়া উপজেলার বেড়ার সরিষা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৮৩ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আলহাজ আব্দুল করিম ও মা হোসনে আরা করিমের ১২ সন্তানের মধ্যে ষষ্ঠ সন্তান তিনি।
বাবা ছিলেন বিআইডব্লিউটি’র সাব-অ্যাসিসটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার। মা গৃহিনী। দুই ভাই মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ও দুই বোন চিকিৎসক।
জেল সুপার কাওয়ালিন নাহার জানান, নিজ উপজেলা বেড়া মঞ্জুর কাদের স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করার পর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবেশ বিজ্ঞান বিষয়ে অনার্সসহ মাস্টার্স পাশ করেন তিনি।
এরপর ৩০তম ব্যাচে বিসিএস পাস করে জেল সুপার হিসাবে কুড়িগ্রাম জেলা কারাগারে ২০১২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর যোগদান করেন।
তারপর তিনি জয়পুরহাট জেলা কারাগারে বদলি হন ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন কৃষিবিদ সিরাজুল ইসলাম সাজু নামের একজন কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে। এখন তাদের এক কন্যা সন্তান রয়েছে।
তার এই সফলতার পেছনে পারিবারিক অনুকূল পরিবেশের প্রভাবই বেশি কাজ করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, বাবা-মা ছিলেন সুখী দম্পতি। ভাই-বোন বেশি হলেও খুশিতে ভরপুর ছিল আমাদের পরিবার। এ ছাড়া আমার এক চাচা মেরিন ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রহিমও ছিলেন আমাদের ভাই-বোনের কৃতিত্বের পেছনে বড় উৎসাহদাতা। পরিবারে শৃঙ্খলা থাকলে যে কোনো সন্তানের পক্ষে সফলতা অর্জন সম্ভব।
চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে কাওয়ালিন নাহার বলেন, চাকরি করতে গিয়ে তিনি প্রথম দিকে কিছুটা হলেও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছি। কারণ অপরাধীদের নিয়ে কাজ করতে হয়। তবে পরিবারের অনুপ্রেরণা আর উৎসাহে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
জেল সুপার জানান, জেলে কাজ করতে এসে তিনি অসহায় মানুষদের নিয়ে কাজ করতে পারছেন এবং অনেক সময় মামলা জটিলতায় আটকে থাকা অসহায় কয়েদীদের ব্যাপারে জেল পরিদর্শনে আসা বিচারকদের সঙ্গে আলাপ করে সুষ্ঠু বিচার পাইয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। আবার জেলে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
জয়পুরহাট কারাগারের অনেক কয়েদীই এই নারী জেল সুপারের কৃতিত্বের সাক্ষ্য দেন। জেলা শহরের বিশ্বাসপাড়া রেল বস্তি এলাকার গোলাম মোস্তফার এক সময়ের মাদকাসক্ত ছেলে রতন মিয়া বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের রায়ে ছয় মাসের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জয়পুরহাট কারাগারে ছিলাম। এই অল্প সময়ের মধ্যে জেল সুপার স্যারের নির্দেশে জেল খানায় চুলকাটার কাজ শিখি। তারপর জেল থেকে বের হয়ে জেলখানার বাইরে বসে মানুষের চুল-দাড়ি কেটে জীবিকা নির্বাহ করছি।
শুধু রতন নয়, সাজা শেষে মুক্তিপ্রাপ্ত জেলার পাঁচবিবি উপজেলার শাইলট্টি গ্রামের নূরুল ইসলাম, নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার পাটোয়ারীপাড়া গ্রামের মুমিনুর আজাদ, ঢাকা কামরাঙ্গীর চর এলাকার নবেল হোসেনসহ কয়েজজন কয়েদী জানান, জেল সুপার কাওয়ালিন স্যারের তত্ত্বাবধানে জয়পুরহাট জেলা কারাগারে এখন সেলাই, পাট দিয়ে দড়ি তৈরি, বাঁশ ও বেত দিয়ে ঘর-গৃহস্থালীর সামগ্রী তৈরি, রাজমিস্ত্রির কাজসহ নানা হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এসব কাজ শিখে বাড়িতে গিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের পথ উন্মুক্ত হয়েছে।আগের অপরাধীরা জয়পুরহাট জেল থেকে বের হয়ে অধিকাংশই স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবনে ফিরে গেছেন।
জয়পুরহাট জেল পরিদর্শন কমিটির সদস্য সাবেক সদর উপজেলা ভাইস-চেয়ারম্যান আসমা খাতুন জানান, জেল সুপার কাওয়ালিন আপা কয়েদীদের জন্য খাদ্য তালিকার সুষ্ঠু বণ্টন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন ইতিবাচক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন, যা ইতিপূর্বে আর কখনো দেখা যায়নি।
জয়পুরহাট জেলা প্রশাসক আব্দুর রহিম বলেন, জেল সুপার কাওয়ালিন একাধারে সৎ ও সফল কর্মকর্তা এবং একজন ভালো গৃহিনী ও আদর্শ মা।
নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৩: ০০ পিএম, ৩ জুলাই ২০১৭, সোমবার strong>
ডিএইচ