Home / ইসলাম / কুরআন ও হাদীসের আলোকে মেরাজুন্নাবী (সা.)
কুরআন ও হাদীসের আলোকে মেরাজুন্নাবী (সা.)

কুরআন ও হাদীসের আলোকে মেরাজুন্নাবী (সা.)

মুহা. আবু বকর বিন ফারুক :

“সুবহানাল্লাজী আসর বিআবদিহী লাইলাম মিনাল মাসজিদিল হারমি ইলাল মাসজিদিল আকসাল্লাজি বারকনা হাওলাহু লিনুরিয়াহু মিন আয়াতিনা, ইন্নাহু হু-অস সামিউল বাচির।” অর্থাৎ পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পযন্ত- যার চার দিকে আমি পর্যপ্ত বরকত দান করেছিÑ যাতে নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল। (আল- কুরআন)

“আসরা” শব্দটি “ইসরা” ধাতু থেকে উদ্ভুত। এর আভিধানিক অর্থ রাত্রে নিয়ে যাওয়া। যেহেতু রাসূলে পাক (সা:) মহান আল্লাহ পাকের নির্দেশে হযরত জিব্রাঈল (আ:)-এর সঙ্গী হয়ে হযরত উম্মেহানীর ঘর থেকে বের হয়ে পবিত্র খানেয়ে কাবায় এসে বোরাকে আরোহণপূর্বক অতি অল্প সময়ের মধ্যে “বায়তুল মুকাদ্দাস” বা “মসজিদে আকসায়” এসে উপস্থিত হন। পথিমধ্যে তিনি “আলমে বারযাখের” অনেক অনেক আযীবাত প্রত্যক্ষ করেন। মসজিদে আকসায় এসে সমস্ত আম্বিয়া আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপস্থিতিতে সকল নবী আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইমাম হয়ে তিনি দু-রাকাত নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে সকল নবী আলাইহি ওয় সাল্লাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শ্রেষ্ঠত্বের প্রশংসা করে সংক্ষিপ্ত ভাষণ বা খুতবা পেশ করেন। এ সারগর্ভ খুতবা প্রদান করে ইমামুল মুরসালীন হিসেবে সকলের থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। এ প্রক্রিয়াকে-ই আরবি ভাষায় “ইসরা” বলা হয়। পবিত্র আয়াতে কারিমায় এ দিকেই ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে।

আয়াতে কারীমায় প্রথমেই “সুবহানা” শব্দ ব্যবহার করে মহান আল্লাহ তায়ালা জগৎবাসীদের জানিয়ে দিলেন যে, মেরাজ তোমাদের কাছে আশ্চর্যের বিষয় মনে হবে আর এ ঘটনাকে আল্লাহতায়ালা “সুবহানা” শব্দ ব্যবহার করেছেন। যা সত্যিই আশ্চর্য্যের বিষয় মনে হবে। অথচ ইহাই বাস্তবে ঘটনা। আয়াতে কারীমায় “আসরা” দ্বারা রাত্রিকালীন ভ্রমণ বুঝানো হয়েছে। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, মেরাজ রাতে হয়েছে। আয়াতে “বি-আবদিহী” দ্বারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বুঝানো হয়েছে। আমার বান্দা বলে প্রেয়ময়তা বুঝানো হয়েছে। কেননা আল্লাহ তায়ালা তাঁর কোন বান্দাকে আমার বান্দা বলার দ্বারা তাঁর প্রতি ভালোবাসাই বুঝায়।

আর আয়াতে “বি-আবদিহী” দ্বারা ইহাই বুঝা যায় যে, মেরাজ স্ব-শরীরে হয়েছে। কারণ শুধু আত্মাকে দাস বলে না; বরং আত্মা ও দেহ উভয়ের সমষ্টিকেই দাস বলা হয়। এছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেরাজ থেকে এসে উম্মেহানিকে যখন ঘটনা শুনালেন তিনি বললেন, আপনি কারও কাছে ইহা প্রকাশ করবেন না; প্রকাশ করলে কাফেররা আপনাকে আরও বেশি মিথ্যারোপ করবে। মেরাজ যদি স্বপ্নই হত তাহলে মিথ্যারোপের কারণ থাকতে পারে না। কেননা স্বপ্নে মানুষ অনেক কিছুই দেখতে পারে। কথা অস্বীকার বা মিথ্যারোপের কোন কারণ থাকতে পারে না। মেরাজ সত্য এবং স্ব-শরীরে বিধান কাফেররা ইহাকে মিথ্যারোপ করতে পারে। এতেই বুঝা গেল যে মেরাজ স্ব-শরীরে ছিল।

আয়াতে কারীমায় “লাইলাম” শব্দ ব্যাবহারের দ্বারা বুঝা গেল মেরাজ রাত্রের সামান্য সময় ছিল। মেরাজের জন্য সারারাত্র প্রয়োজন হয় না। দুনিয়ার হিসেবে ইহা নিতান্ত সামান্য সময়। রাসূল সাল্লাল্লাই আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মেহানির ঘরে শায়িত থেকে সেখান থেকে জিব্রাঙ্গল (আ.)-এর আহবানে সাড়া দিয়ে মহান আল্লাহর নির্দেশে মেরাজে চলেন। মেরাজ থেকে ভোর হওয়ার পূর্বেই আবার চলে আসেন। ইহাই; রাত্রের সামান্য সময় যা “লাইলাম” দ্বারা বুঝানো হয়েছে।

মেরাজ ছিল দীর্ঘ সাতাইশ বছর। যা আমাদের হিসাবে সামান্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে বিছানায় শায়িত ছিলেন মেরাজ থেকে ফিরে এসে দেখলেন সে বিছানা এখন ও গরম। দরজার কড়া নড়তে শুরু করে, মেরাজ থেকে ফিরে এসে দেখেন ২৭ বছর পর এসে দেখেন অযুর পানি এখনও পর্যন্ত গড়াচ্ছে। সোবাহানাল্লাহ। ইহাই “লাইলাম”। দুনিয়ার হিসাবকে ভেঙ্গে দিয়ে আদেশ জারি করে দিলেন, চন্দ্রÑসূর্যসহ সকল সৃষ্টি যে যেখানে আছে, সে সেখানেই থাক। আমি আমার হাবীবকে দীর্ঘ ২৭ বছর মেরাজে নিয়ে আসব। ঠিক ২৭ বছর পর আবারও ঘোষণা জারি করে দিলেন যে, হে সৃষ্টিজগৎ! তোমরা পূর্বের ন্যায় চলমান হয়ে যাও। এ ব্রেকেই ২৭ বছর অতিবাহিত হয়েছে। আর ইহা আল্লাহর জন্যেই সম্ভব। কেননা মহান আল্লাহতায়ালা সকল ক্ষমতার মালিক। আর ইহাই দুনিয়ার হিসাবে “লাইলাম”। এ “লাইলাম” একেবারেই সামান্য সময়। যা আল্লাহতায়ালারই কুদরত। আর এ জন্যই আয়াতের প্রথমেই “সুবহানাহ” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আয়াতে কারীমায় “মিনাল মাসজিদিল হারামে ইলাল মাসজিদিল আকসা”। মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত তাঁর এ ভ্রমণ।

তাহলে এর দ্বারা বুঝা যায় যে, মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকছা পর্যন্ত ভ্রমণ পবিত্র কুরআন দ্বারা সাবেত। যেখানে এক মাসের পথ সেখানে যদি রাত্রের কিছু সময়ে যাওয়া সাব্যস্ত হয় তাহলে ঊর্ধ্বকাশে যাওয়াও আল্লাহর ইচ্ছাধীন এবং আল্লাহর ক্ষমতায় অবশ্যই সম্ভব।

কেউ কেউ বলেছেন যে, মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত হচ্ছে “আসরা”। আর মসজিদে আকসা থেকে সপ্তাকাশে, আরশে আজীম সেই ঊর্ধ্ব জগতের ভ্রমণই হলো মেরাজ।
আয়াতে “বারকনা হাওলাহু” দ্বারা যার চার দিকে বরকতের কথা বলা হয়েছে যে, এ মেরাজে যাওয়ার পথের চতুর্দিকে বরকতময়। এ “হাওলাহু” দ্বারা সমগ্র সিরিয়াকে বোঝানো হয়েছে।

এক হাদীসে রয়েছে, আল্লাহ তায়ালা আরশ থেকে ফোরাত নদী পর্যন্ত বরকতময় ভূ-পৃষ্ঠকে বিশেষ পবিত্রতা দান করেছেন। (রূহল মাইনী)
“লিনুরিয়াহু মিন আয়াতিনার” অর্থাৎ যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শনে দেখিয়ে দেই। মেরাজের রজনীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান আল্লাহ তায়ালার কুদরতের অসংখ্য বিষয় অবলোকন করেন। তন্মধ্যে সপ্তাকাশ, নবীদের সাথে সাক্ষাত, বায়তুল মুকাদ্দাসের সনরা পাথর, বোরাক, রফরফ, সিদরাতুল মুনতাহা, জান্নাত-জাহান্নাম, আলমে বরযখের কতিপয় দৃশ্যাবলী সহ মহান আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য নিদর্শনাবলী।
আলমে বরযখের কতিপয় বিষয় তুলে ধরা হলো :

বোরাকে আরোহন করার পর তিনি একটি সবুজ মাঠ দেখতে পেলেন সেখানে নারীÑপুরুষ সজ্জিত হয়ে ক্ষেত খামারের কাজে ব্যস্ত। তারা একদিকে জমীন প্রস্তুত করেছে, অপরদিকে বীজ বুনন করছে। আর সাথে সাথে তা শস্য- শ্যামলা হয়ে ক্ষেতে ভরে যাচ্ছে। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত জিব্রাইল (আ.)কে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন ইহা ওই সম্প্রদায়ের উদাহরণ; যারা আল্লাহর রাহে প্রশস্ত মনে দুনিয়াতে দান-সদকা করে।

এমন একদল বদ-নসীবের দেখা পেলেন যেখানে অসংখ্য নারী-পুরুষ বিরাট একটা পাথর যুক্ত মাঠে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। আর তাদের মাথার উপর বড় বড় পাথর দ্বারা আঘাত করা হচ্ছে। পাথরের আঘাতে তাদের মাথা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে, আবার উহা পূর্ববৎ ভালো হয়ে যাচ্ছে আর মারছে। এরা হচ্ছে ওই সম্প্রদায়, যারা নামাজ না পড়ে বিছানায় আরামের সাথে শুয়ে থাকত এবং অলসতা করে বিছানা ছেড়ে নামাজের জন্য যেত না। বরং অহংকার করে দিন কাটাতে। বিশাল আলোচনার সামান্য মাত্র এখানে বয়ান করা হলো।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেরাজ সংঘটিত হয়েছিল নবুয়তের ১২ সালে যা মক্কা শরীফে উম্মেহানির ঘর বা কাবার হাতীম থেকে। এ সফরে তাঁর ছিনা চাক করা হয়েছে।

তফসীরে কুরতুবীতে আছে, ইসরার হাদীস সমূহ সব মুতাওয়াতির। নাক্কাশ সম্পর্কে বিশজন সাহাবীর রেওয়ায়েত উদ্ধৃত করেছেন। এবং কাযীআয়ায় শেফা গ্রন্থে আরও বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।

ইমাম ইবনে কাসীর স্বীয় তফসীর গ্রন্থে এসব রেওয়ায়েত পূর্ণরূপে যাচাই বাছাই করে বর্ণনা করেছেন।

পবিত্র কুরআন ও হাদীসের দ্বারা রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেরাজের সত্যতা এবং স্বশরীরে মেরাজ প্রমাণিত। আমরা এর দ্বারা আমাদের আমলী জিন্দেগী গঠন করব। ইনশাআল্লাহ আল্লাহ আমাদেরকে আমল করার তাওফিক দান করুক। আমীন।

লেখক পরিচিতি : মুহাম্মদ আবু বকর বিন ফারুক, খতিব;পূর্ব মনোহরখাদী মদীনা বাজার বাইতুল, আমিন জামে মসজিদ; শিক্ষক, বিষ্ণুপুর সিদ্দিকীয়া মাদ্রাসা, মুঠোফোন : ০১৮৩৭-৩১৮৪১২

চাঁদপুর টাইমস : এমআরআর/২০১৫