Home / উপজেলা সংবাদ / ফরিদগঞ্জ / কিসের ভারে ডুবলো নৌকা?
Faridganj-ফরিদগঞ্জ

কিসের ভারে ডুবলো নৌকা?

‘ধান নেই’ তাহলে কিসের ভারে ডুবলো নৌকা? ফরিদগঞ্জ উপজেলায় বর্তমানে এটি একটি বিরাট প্রশ্ন! ক্ষমতাশীন দলের এমন ভরা-ডুবি দলীয় প্রতীকের কারণে? নাকি দলীয় গ্রুপিং এর কারনে? দলীয় নেতা কর্মীদের নিরব ভূমিকা! দলীয় প্রার্থীর আর্থিক দৈন্যতা? নাকি বিদ্রোহীদের কারণে? নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে রায়? নাকি সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান প্রেক্ষাপট তৈরী করে দিয়েছেন? নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরপরই নির্বাচনী এলাকা, উপজেলা সদর এবং আশপাশের রাজনৈতিক সচেতন লোকদের আলোচনার বিষয়ই ছিলো এটিই। এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছেন তারা।

ভোটের মাঠে নৌকা ও ধানের শীষের লড়াই হয়। এই নির্বাচনে ধানের শীষের প্রতীক ছিলো না। সে ক্ষেত্রে নৌকা সহজেই জিতে যাওয়ার কথা। কিন্তু সবাইকে হতাশ করে সাতজন প্রার্থীর মধ্যে নৌকার স্থান হলো চারে। জয়-পরাজয় থাকবে কিন্তু এমন পরাজয় মেনে নিতে পারছেন না আওয়ামীলীগের ত্যাগী নেতারা। তারা এই ভোট নিয়ে যতই বিশ্লেষণ করছেন ততই হতাশ হচ্ছেন। বিষয়টি তারা কিছুতেই মানতে পারছেন না। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতিকের বিরোধীতা অনেকেই করেছেন। এর কিছুটা প্রভাব পড়লেও খুব বেশী একটা সমস্যা হয়নি। বিগত নির্বাচনের ফলাফল এতো হতাশাজনক হয়নি। ‘নৌকা’ মোহাম্মদ হোসেন মিন্টুর প্রতীক নয়, এটা আওয়ামীলীগের প্রতীক। আর সেই নৌকার ভরা-ডুবি! ৯টি কেন্দ্রের মাত্র একটি কেন্দ্রে পাশ করেছে! বিজয়ী প্রতীক আনারস আর নৌকা প্রতীকের মধ্যে ভোটের ব্যবধান হলো ২,১৮১, ভাবা যায়? নৌকা পেয়েছে ১,৩৮৮ ভোট, আনারস পেয়েছে ৩,৫৬৯ ভোট।
 দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এই ইউনিয়নের ১ ও ২নং ওয়ার্ডে কোন নির্বাচনে নৌকা প্রতীক হারেনি। কিন্তু এই প্রথম ২টি ওয়ার্ডে পেল করেছে নৌকা। তাও আবার বিশাল ভোটে। নৌকার এই সামান্য ভোট দেখে প্রকৃত আওয়ামীলীগাররা হতাশা প্রকাশ করেছেন। টানা ১৪ বছর আ’লীগ ক্ষমতায় থাকার পরও এই হতাশাজন ফলাফল মেনে নিতে পারছেন না তারা।

১নং ওয়ার্ডে ভোট কাস্ট হয়েছে ১৬৮০ ভোট, এর মধ্যে নৌকা পেয়েছে মাত্র ২৯ ভোট, টেলিফোন প্রতীক পেয়েছে সর্বোচ্চ ৫৫৮ ভোট। ২নং ওয়ার্ডে কাস্ট হয়েছে ১৭০৯ ভোট, এর মধ্যে নৌকা পেয়েছে ৭৩ ভোট, আনারস প্রতীক পেয়েছে সর্বোচ্চ ৫৭৩ ভোট। ৩নং ওয়ার্ডে কাস্ট হয়েছে ১৭৩০ ভোট, এর মধ্যে নৌকা পেয়েছে ৩৩ ভোট, টেলিফোন প্রতীক পেয়েছে সর্বোচ্চ ৮২৪ ভোট। ৪নং ওয়ার্ডে কাস্ট হয়েছে ৮৭৮ ভোট, এর মধ্যে নৌকা পেয়েছে ৭৪ ভোট, ঘোড়া প্রতীক পেয়েছে সর্বোচ্চ ৪৮৬ ভোট। ৫নং ওয়ার্ডে কাস্ট হয়েছে ১৪৭৬ ভোট, এর মধ্যে নৌকা পেয়েছে ৬০ ভোট, আনারস প্রতীক পেয়েছে সর্বোচ্চ ৮০৫ ভোট। ৬নং ওয়ার্ডে কাস্ট হয়েছে ১৬৪৫ ভোট, এর মধ্যে নৌকা পেয়েছে ৩৪৩ ভোট, আনারস প্রতীক পেয়েছে সর্বোচ্চ ৪৪২ ভোট। ৭নং ওয়ার্ডে কাস্ট হয়েছে ১২৯৩ ভোট, এর মধ্যে নৌকা পেয়েছে ৪৬৯ ভোট, নিকটতম প্রতিদন্ধী আনারস প্রতীক পেয়েছে ২৪৭ ভোট। ৮নং ওয়ার্ডে কাস্ট হয়েছে ৯১৮ ভোট, এর মধ্যে নৌকা পেয়েছে ১৩৮ ভোট, আনারস প্রতীক পেয়েছে সর্বোচ্চ ২৯৬ ভোট। ৯নং ওয়ার্ডে কাস্ট হয়েছে ১৩৪৬ ভোট, এর মধ্যে নৌকা পেয়েছে ১৬৯ ভোট, মোটর সাইকেল প্রতীক পেয়েছে সর্বোচ্চ ৪৪৩ ভোট।  

৮নং পাইকপাড়া উত্তর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের কমিটি ৬৫ সদস্য বিশিষ্ট, ৯টি ওয়ার্ডে ৫১ করে মোট সদস্য ৪৫৯ জন। এভাবে ইউনিয়ন যুবলীগ ও ওয়ার্ড যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, মহিলালীগ, যুব মহিলালীগ, কৃষকলীগ শ্রমিকলীগ, ওলামালীগ ও ছাত্রলীগের ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটিতে লোক রয়েছে সর্বমোট ৩২৫৪ জন। এর মধ্যে ছাত্রলীগ বাদ দিলে ২৯৩৩ জন কমিটিতেই আছেন। সাধারণ ভোটারের কথা বাদই দিলাম, কমিটিতে এতো লোক থাকতে নৌকা কীভাবে ১৩৮৮ ভোট পায়? তাহলে কী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের নেতারা দলীয় সিদ্ধান্তকে অবজ্ঞা করেছেন? তাহলে কী আওয়ামীলীগের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছে?
তবে এটা স্পষ্ট এখানে গ্রুপিং রাজনীতি ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। এখানে মূল প্রার্থীর বিপরীতেও কেউ কেউ প্রার্থী দিয়ে থাকে এবং গোপনে তাকে সহযোগিতাও করা হয়। বিষয়টি বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও দিয়েছেন। পাইকপাড়া দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে উপলক্ষ করে, জেলা পরিষদ নির্বাচনকে ইঙ্গীত করে সাহাবুদ্দিন সাবু নামের এক আওয়ামী লীগ নেতা পোস্ট করেন ‘কারিশমাটিক লিডারদের কারিশমা গেল কই। ৮নং ইউনিয়নে কেন নৌকার পরাজয়।’ আরেক নেতা মো.জামাল উদ্দিন লিখেন, ‘প্রথম দিকে নৌকা প্রতীক নিয়ে আসা ছিলো কঠিন, পাশ করা ছিলো সহজ। এখন নৌকা নিয়ে আসা যতটা সহজ কিন্তু পাশ করা ততটাই কঠিন। ফ্যাক্ট : ৮নং পাইকপাড়া ইউনিয়ন।”

এদিকে নির্বাচন শেষ হওয়ার ৪ দিন পর পরাজিত প্রার্থী মোহাম্মদ হোসেন মিন্টু পাটওয়ারী (নৌকা) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইভে এসে বলেন, “আনারসের রস আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে অনেক মিষ্টি, তাই তারা দলের আদর্শ ও প্রতীক বাদ দিয়ে রস খাওয়ার নেশায় মগ্ন আছেন। আমি ৮০’র দশকে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছি, অনেক পথ পাড়ি দিয়ে বর্তমানে উপজেলা আ’লীগের সদস্য পদে দায়িত্ব পালন করছি। ফরিদগঞ্জে আ’লীগের বড় বড় প্রভাবশালী নেতা যারা সংসদ নির্বাচন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকা নিয়ে আসে আমরা তাদের জন্য কাজ করি।

ঠিক তেমনি ভাবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন আসলে জননেত্রীর সেই নৌকা কোন্দায় পরিনত হয়। এই যে কোন্দা, সেই কোন্দার ব্যাখ্যার জন্য অপেক্ষা করুন। আল্লাহ যদি আমাকে সুস্থ্য রাখে প্রতিটি নেতার রেকর্ড, তথ্য ও নাম সহকারে আপনাদের সামনে প্রকাশ করবো। আমি জানি এই নাম গুলো প্রকাশ করলে আমাকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হবে, তার জন্য আমার একটুও দ্বিধা হবে না। বহু আন্দোলন সংগ্রাম করেছি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জন্য। মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও জননেত্রী শেখ হাসিনা যাদের কাছে নিরাপদ নয় তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবো। আমাদের মধ্যেই খন্দকার মোস্তাকরা লুকিয়ে, যারা আগামীতে চাঁদপুর জেলা ও ফরিদগঞ্জ উপজেলা আ’লীগের সম্মেলনে নেতা হতে চান।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবু সাহেদ সরকার বলেন এ বিষয়ে বলেন,‘আমাদের ইউনিয়নের কিছু নেতা প্রতিপক্ষের নির্বাচনী মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছে। অন্যদের কথা আর কি বলবো। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক এবং হতাশার।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,‘আমাদের প্রার্থী কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে একটি অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন। আমরা ওদের বিরুদ্ধে অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিবো।’
উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র বীর মুক্তি যোদ্ধা আবুল খায়ের পাটওয়ারী বলেন,‘বিষয়টি অত্যান্ত দুঃখজনক। মূলত এখানে ভাইলীগ, প্রতিনিধিলীগ, অমুকলীগ, তমুকলীগে দলটাকে শেষ করে দিচ্ছে। ঐখানে নৌকা পরাজয়ের প্রধান কারণ হলো সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি বাজে এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন। তাকে সাধারণ মানুষ কখনোই পরিষদে পেতেন না। সাবেক চেয়ারম্যানের প্রতীকও ছিলো নৌকা। সে কারণেই সাধারণ মানুষ নৌকা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,‘এটা সত্য আওয়ামীলীগের ৯/১০টি অঙ্গ সংগঠন রয়েছে। ওয়ার্ড কমিটি রয়েছে। কমিটির লোকজন ভোট দিলেও নৌকা পরাজয় করে না। যারা নৌকার বাহিরে গিয়ে প্রকাশ্যে অন্য প্রার্থীর হয়ে কাজ করেছে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’  

প্রতিবেদক: শিমুল হাছান, ৭ ডিসেম্বর ২০২২