Home / সারাদেশ / করোনাকালে দ্বিগুণ হলো লঞ্চ ভাড়া
করোনাকালে

করোনাকালে দ্বিগুণ হলো লঞ্চ ভাড়া

করোনার এই দুঃসময়ে ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন লঞ্চ মালিকরা। করোনায় দ্বিতীয় ঢেউ কমে আসায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে লঞ্চ চলাচলের শুরু থেকেই যাত্রীদের কাছ থেকে দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। যাত্রীরা করোনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে লঞ্চ চলাচলের কারণে বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে-এমনটা মনে করলেও শেষ পর্যন্ত লঞ্চ মালিকরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন এখন থেকে বাড়তি ভাড়ায়ই যাত্রীদের লঞ্চে যাতায়াত করতে হবে। ডেকের যাত্রীরা বাড়তি ভাড়া দিলেও চাপ কম থাকায় প্রথম শ্রেণি ও কেবিন যাত্রীরা আগের ভাড়ায়ই যাতায়াত করছেন। তবে যাত্রীদের অনেকেই একে ‘কৌশলী প্রতারণা’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। ভাড়া তুলতে গিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে প্রায়ই বাদানুবাদের সম্মুখীন হতে হচ্ছে লঞ্চ স্টাফদের।

ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে কথা হয় কেন্দ্রীয় লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মাস তিনেক আগে সরকারের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে লঞ্চের ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। আগে থেকেই লঞ্চের ভাড়া বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে আসছিলাম। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রথম ১০০ কিলোমিটারে কি.মি প্রতি যাত্রী ভাড়া হবে ১ টাকা ৭০ পয়সা। পরের প্রতি কি.মির ভাড়া হবে ১ টাকা ৪০ পয়সা করে।’

কেন্দ্রীয় লঞ্চ মালিক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি বদিউজ্জামান বাদল বলেন, ‘সারা দেশে রেজিস্টার্ড প্রায় ১২শ’ যাত্রীবাহী নৌ-যান রয়েছে। করোনা’র থাবায় এইসব লঞ্চের মালিকদের এখন করুণ দশা। গেল বছর প্রথম দফার লকডাউনে টানা ৬৬ দিন বন্ধ ছিল লঞ্চ। এ বছরও ৪৬ দিন লঞ্চ চালাতে পারিনি আমরা। ঋণের দায়ে বহু মালিকের পথে নামার দশা। এই অবস্থায় লঞ্চের ভাড়া বৃদ্ধি না হলে পুরো শিল্পটি ধ্বংস হয়ে যেত। ভাড়া বৃদ্ধি সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি না হলেও মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের মৌখিকভাবে বর্ধিত হারে ভাড়া আদায়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আশা করছি ২-৪ দিনের মধ্যে সার্কুলারও পেয়ে যাব।’

রাজধানীর সদরঘাট থেকে দেশের ৪৫টি রুটে চলাচল করে লঞ্চ। এর ২৮টি রুটই বরিশাল অঞ্চলের। এর মধ্যে ঢাকা-বরিশাল রুটেই দিনে ২৩টি লঞ্চ যাত্রী বহন করে। আগে ঢাকা-বরিশাল রুটে ডেকে যাত্রীদের ভাড়া ছিল জনপ্রতি ২০০ টাকা। করোনার ভয়াবহতায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রী পরিবহণ প্রশ্নে প্রথম থেকেই বাসে শতকরা ৬০ ভাগ ভাড়া বৃদ্ধি করা হলেও লঞ্চে তা বাড়েনি। বিষয়টি নিয়ে শুরু থেকেই নানা দাবি তুলে আসছিলেন লঞ্চ মালিকরা।

এ বছরের এপ্রিলে হঠাৎ করেই আসে লঞ্চের ভাড়া বৃদ্ধির ঘোষণা। শুরুতে বলা হচ্ছিল করোনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে কম যাত্রী নিয়ে লঞ্চ চালানোর জন্যে এই ভাড়া বৃদ্ধি। বিষয়টি মেনেও নিয়েছিল যাত্রীরা। ঢাকা-বরিশাল রুটে যেখানে স্বাভাবিক সময়ের ভাড়া ছিল ২০০ টাকা সেখানে ৪০০ টাকা করে নিতে শুরু করে মালিকরা। এভাবেই চলছে প্রায় ২ মাস ধরে। স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করে অতিরিক্ত যাত্রী বহনের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে বেরিয়ে পড়ে থলের বিড়াল। লঞ্চ মালিকরা সবাইকে সাফ জানিয়ে দেন, এই ভাড়া বৃদ্ধি কেবল করোনাকালের জন্য সব সময়ের জন্য।

ঢাকা-বরিশাল রুটের নৌ-পরিবহণ সংস্থা অ্যাডভেঞ্চার নেভিগেশনের মালিক এফবিসিসিআই’র পরিচালক নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘আগাগোড়াই ভাড়া কম নিচ্ছি আমরা। সরকারিভাবে ডেক শ্রেণির ভাড়া জনপ্রতি ২৫৫ টাকা নির্ধারিত থাকলেও আমরা নিতাম ২০০ টাকা। নিয়মানুযায়ী কেবিনের ভাড়া ডেকের ভাড়ার ৫ গুণ পর্যন্ত বেশি নেওয়া যাবে। আমরা ৪ গুণের বেশি নিতাম না। প্রতিবছর লঞ্চের পরিচালন ব্যয় বাড়ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন। কিন্তু লঞ্চের বাড়ছিল না ভাড়া। টানা প্রায় দেড় বছর ধরে করোনা মোকাবিলা করছি আমরা।

এমনিতেই লঞ্চে এখন খুব একটা বেশি যাত্রী ওঠে না। সড়ক পরিবহণ সেক্টরে যাত্রী ভাড়া বাড়িয়েছে সরকার। বিভিন্ন শিল্পকে নানা প্রণোদনাও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমাদের নিয়ে কেউ ভাবে না। লঞ্চ শিল্প মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম ঠিক তখনই এই ভাড়া বৃদ্ধি জরুরি ছিল।’ কেন্দ্রীয় লঞ্চ মালিক সমিতির সহসভাপতি বরিশাল চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘২০১৩ সালে সর্বশেষ বাড়ানো হয়েছিল লঞ্চের ভাড়া। প্রতি ৩ বছর পরপর ভাড়া বৃদ্ধির কথা থাকলেও গত ৮ বছরে তা হয়নি। অথচ এর মধ্যে আন্দোলন করে ঠিকই বেতন বাড়িয়েছে নৌ-যান শ্রমিকরা। এই যে ভাড়া বাড়িয়ে ৪১২ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়েছে তারপরও কিন্তু আমরা ১২ টাকা ৫০ পয়সা কম নিচ্ছি। তাছাড়া এখন পর্যন্ত বাড়ানো হয়নি কেবিনের ভাড়া।’

লঞ্চের ভাড়া বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্তে কেবল ঢাকা-বরিশালই নয়, বিপাকে পড়েছে দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় সব রুটের যাত্রীরা। ঢাকা-পটুয়াখালী রুটে আগে যেখানে ডেক শ্রেণির ভাড়া ছিল ৩৮৩ টাকা সেটি এখন বেড়ে হয়েছে ৫১৫, ঢাকা-ভোলা রুটে ২৫৫ টাকার ভাড়া এখন ৪৭০। এছাড়া ঢাকা-আমতলি, ঢাকা-বরগুনাসহ অন্য রুটগুলোতেও ভাড়া বেড়ে দুই থেকে আড়াই গুণ হয়েছে। অবশ্য এর মধ্যে ঢাকা-ভোলা এবং ঢাকা-বরগুনা রুটে এখনো নেওয়া হচ্ছে পূর্বের ভাড়া। ঢাকা-আমতলি রুটে ডেক শ্রেণিতে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে জনপ্রতি ৫০ টাকা। বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘সবাই জানে করোনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে কম যাত্রী নিয়ে লঞ্চ চালাতে হবে বলে এই ভাড়া বৃদ্ধি।

এখন মালিকরা বলছেন এটা নাকি সব সময়ের জন্য স্থায়ী। সেরকম কিছু হলে তা সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। করোনার এই দুঃসময়ে যখন অভাব-অনটনে মানুষ দিশাহারা ঠিক সেই সময়ে এরকম কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তা কেউ ভালোভাবে নেবে না। তার ওপর লঞ্চ মালিকরা প্রথম শ্রেণির ভাড়া না বাড়িয়ে বাড়াল ডেকের ভাড়া। যেখানে শুয়েবসে মধ্যবিত্ত আর দরিদ্র শ্রেণির মানুষেরা যাতায়াত করে। যেহেতু অনেক টাকা খরচ করে বাসে কিংবা বিমানে যাওয়ার ক্ষমতা নেই তাই তাদেরকেই ভাড়া বৃদ্ধির ফাঁদে ফেলে জিম্মি করা হচ্ছে। সরকারের উচিত এই বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা। তা না হলে লাখ লাখ মানুষ চরম বিপদে পড়বে।’

ঢাকা ব্যুরো চীফ,৮ জুন ২০২১