বিশেষ সংবাদ

‘ওরা কী আমার চোখের ডাক্তারকে মেরে ফেলেছে?’

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে বিমানবন্দরে নেমেই অন্যদের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ওরা কী আমার চোখের ডাক্তারকে মেরে ফেলেছে?’

বুদ্ধিজীবী দিবসের এক আলোচনা সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী শম্পা এ কথা বলেন।

তিনি বলেন, ‘আমার বাবাটা একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাদের মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে রাখা হতো। ওখানে কী করা হতো-এ অংশটি আমি আর চিন্তা করতে চাই না। শুধু এইটুকু বলতে চাই-১৮ তারিখে (১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর) যখন বাবার লাশ পাই, তখন তার বুকটা গুলিতে ঝাঁঝরা ছিলো। তার কপালে বেয়োনেট চার্জ করা ছিলো।’

নুজহাত চৌধুরী বলেন, ‘এই দিবসটিতে কথা বলা খুবই কষ্টকর। একাত্তরের এই দিনে (১৪ ডিসেম্বর) ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাসায় ঘুরে ঘুরে আমাদের বাবাদের (শহীদ বুদ্ধিজীবীদের) চোখে কাপড় বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছু লোক দেশের সর্বোচ্চ মেধার অধিকারী কিছু মানুষকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। পেছনে পড়ে থাকছে তাদের স্ত্রী, ছোটো ছোটো সন্তান।’

‘একটি সুন্দর সোনার বাংলা দেখবো বলে আমরা এই ত্যাগ হাসি মুখে মেনে নিয়েছি। আমাদের বাবারা চলে গেছেন মাথা উঁচু করে, আমাদের মায়েরা ছিলেন, তারা কিন্তু অভিযোগ ছাড়াই, কোনো অনুযোগ ছাড়া চোখের জল গোপন করে দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে সংগ্রাম করছেন।’

বাবার স্মৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমি আমার বাবার খুবই আদরের মেয়ে ছিলাম। আমার ঠিক এক বছরের বড় একটি বোন আছে। তাই আমার মা আমাকে ঠিকমতো সময় দিতে পারতেন না। আমার বোনটিও একটু অসুস্থ ছিলো। মার অজান্তেই আমি ঠিক আমার বাবার বুকের ওপর গিয়ে পড়েছিলাম। এতো ব্যস্ত একজন ডাক্তার রাতে বাসায় ফিরে ওইটুকু মেয়েকে নিয়ে বুকের মধ্যে ঘুমুতেন। পাশ হতে পারতেন না, কাঁত হতে পারতেন না।’

বাবার স্মৃতি বলতে গিয়ে গলা ধরে আসে ডা. নুজহাত চৌধুরীর। এ সময় অনুষ্ঠানস্থল রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে উপস্থিত অতিথিদেরও চোখে জল আসে। অনেককেই চোখ মুছতে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগ আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

উপস্থিতিদের উদ্দেশে কান্নাজড়িত কণ্ঠে শহীদ ডা. আবদুল আলীমের মেয়ে বলেন, ‘আপনাদের কাছে যখন আসি আসলে তখন না চাইলেও আবেগতাড়িত হয়ে যাই। আমাদের বাবারা হাসি মুখে মৃত্যুকে মেনে নিয়েছিলেন। আপনাদের হাতে দিয়ে গেলে দেশটা ভালো থাকবে।’

উপস্থিত মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনাদের প্রতি অনুনয় করবো- যারা বিভিন্ন জায়গায় ক্ষমতায় আছেন, আমরা অনেক আশা নিয়ে, ত্যাগ নিয়ে, আপনাদের হাতে দেশটা সমর্পণ করেছি। আমাদের বাবাদের জীনের বিনিময়ে চেয়েছি একটি সুন্দর দেশ। সেটা বিনির্মাণের দায়িত্ব আপনাদের।’

তৃণমূলে মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্দশার কথা তুলে ধরে এই শহীদ সন্তান বলেন, ‘তৃণমূলে আমার মতো অনেক শহীদ সন্তান আছেন, মুক্তিযোদ্ধা আছেন, বীরাঙ্গনা আছেন। যারা ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। আপনাদের কাছে জানতে চাই-আপনারা যদি বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের লোক হন, তাহলে কী করে মুক্তিযোদ্ধার ওপর রডের বাড়ি পড়ে। এটা শহীদ সন্তানদের বুকে যে কতো বড় আঘাত, কত বড় অপমান- সেটা আশা করি আপনারা বুঝবেন।’

অনুষ্ঠানে পঁচাত্তর পরবর্তী বিভিন্ন সময়ের সাম্প্রদায়িক ঘটনা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেন তিনি।

ডা. নুজহাত আরো বলেন, ‘পঁচাত্তরের পর এদেশে সাংবিধানিকভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি আপনাদের কাছে অনুরোধ করছি-আমাদের রাজনৈতিক বিজয় হয়েছে, কিন্তু আদর্শিক যুদ্ধ চলছে। যদি তা না হবে, তাহলে কেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো। তিনি বেঁচে থাকলে তো কেউ আমাদের উপর হামলা করতে পারতো না।’ (প্রিয় ডট কম)

সাক্ষাতকারটি ভিডিওসহ দেখুন…

Share