স্বাস্থ্য

দেশে এক কোটি মানুষের জন্য মাত্র একজন ভাসকুলার সার্জন

সড়ক দুর্ঘটনা, ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতসহ যে কোনও দুর্ঘটনায় ধমনী বা শিরা কেটে গেলে অনেক সময় হাত এবং পায়ের রক্তনালী বন্ধ হয়ে যায়। আর এসব আহত রোগীদের চিকিৎসা শুরু করা দরকার হয় অন্তত জরুরিভিত্তিতে।

এ ছাড়া যখন কারো স্ট্রোক হয়, তখন হয়ত তার রক্তনালীতে টিউমার ছিল, কিন্তু ধরা পড়েনি। এই টিউমার ফেটে গিয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। আর রক্তনালী কেটে কিংবা ফেটে গেলে চিকিৎসা যদি ছয় থেকে আট ঘণ্টার ভেতর শুরু করা না যায়, তাহলে হাত-পা কেটে ফেলতে হয়। এর চিকিৎসার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দরকার পড়ে। কিন্তু দেশের বেশির ভাগ জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে ভাসকুলার সার্জন নেই বললেই চলে।

আঘাতজনিত কারণে ধমনী কিংবা শিরার রক্তবাহী নালী ক্ষতিগ্রস্ত হলে, যে অপারেশন করা হয়, তাকে ভাসকুলার সার্জারি (Vascular Surgery) বলে এবং যে চিকিৎসক এই অপারেশনটি করেন তিনি ভাসকুলার সার্জন বা রক্তনালী চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারাদেশে ভাসকুলার সার্জন রয়েছেন মাত্র ১৮ জন। বাংলাদেশের জনসংখ্যার হিসাবে প্রায় এক কোটি মানুষের জন্য একজন ভাসকুলার সার্জন। আর পূর্ণ অধ্যাপক রয়েছেন মাত্র একজন।

এ ছাড়া ভাসকুলার সার্জারির সুযোগ শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটেই সীমাবদ্ধ। তারপর আবার শয্যার সংখ্যাও একেবারে কম। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভাসকুলার সার্জারির জন্য সিট বরাদ্দ মাত্র ২৬টি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র চারটি বেড। কিন্তু সেখানে নারীদের ভর্তি করা হয় না। আর এখানে নেই কোনও জরুরি বিভাগও। কোনও নারী যদি এখানে ভর্তি হতে চান, তাহলে তাকে কেবিনে কিংবা পেয়িং বেডে থাকতে হয়।

আর কেবিন ভাড়া প্রতিদিন দেড় থেকে তিন হাজার টাকা। এ ছাড়া পেয়িং বেডের ভাড়া আড়াইশ টাকা প্রতিদিন। সে হিসাবে এই অপারেশন করার জন্য দরকার হয় সাত থেকে ১০ দিন। এর জন্য প্রতিদিন তিন হাজার টাকা করে ১০ দিনের জন্য খরচ হবে ৩০ হাজার টাকা।

এদিকে, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অবস্থাও খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়।

রাস্তাঘাটে হাত-পা কাটা যত ভিক্ষুক দেখা যায়, এদের বেশির ভাগই ভাসকুলার সার্জারির রোগী। তাদের হাত-পায়ের রক্তনালী ব্লক হয়ে গেছে। যদিও এর চিকিৎসা রয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। তারা জানান, হার্টে যেমন রিং পরানো যায়, পায়েও তেমনি রিং পরানো যায়।

হার্টে যেমন বাইপাস করা যায়, পায়েও তেমনি বাইপাস করা যায়। অথচ সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, অনেক চিকিৎসকও জানেন না, বাংলাদেশে এই ধরনের চিকিৎসা রয়েছে।

চিকিৎসকদের মতে, হার্টের ভাল্বে সমস্যা থাকলে হার্ট ব্লক হয়ে রক্ত পায়েও চলে যেতে পারে। এর ফলে হঠাৎ তীব্র ব্যথা হয়ে পা কালো হয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে রোগীরা প্রথমে যান অর্থোপেডিকসের কাছে। সেখানে এক্সরে, এমআরআই করেন। যখন দেখা যায়, পায়ে পার্লস নেই, তখন তারা ভাসকুলার সার্জনের কাছে পাঠান।

‘এটাকে আমি অজ্ঞ চিকিৎসা বলবো’ বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাসকুলার স্পেশালিস্ট সার্জন ডা. এসএমজি সাকলায়েন। তিনি বলেন, ডিপ ভেইন থ্রোম্বসিস বা গভীর শিরায় ব্লক হতে পারে, এটা মানুষ জানেনই না।

এ রোগে যখন একজন রোগী ভাসকুলার সার্জনের কাছে যান, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে এই রোগী অনেক। কিন্তু আমাদের প্রধান সমস্যা আমরা জানিই না এটা ভাসকুলার রোগ এবং তারপর এটাও জানি না যে, ভাসকুলার রোগের চিকিৎসা কোথায় হয়, চিকিৎসকেরা কোথায় বসেন। আর তখনই রোগী অপচিকিৎসার শিকার হন।

ভাসকুলার সার্জারি কেন দরকার এ প্রশ্ন করলে ডা. এসএমজি সাকলায়েন বলেন, বাংলাদেশে মৃত্যুর প্রধান কারণ, সড়ক দুর্ঘটনা। বেশির ভাগ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান। যার হাত-পা কেটে যায়, তাকে অতি দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া প্রয়োজন, যেন ভাঙা হাড় থেকে তার রক্তনালী কেটে না যায়।

তিনি বলেন, বেশির ভাগ মানুষ এ বিষয়টি জানেনই না।

ডা. এসএমজি সাকলায়েন বলেন, ‘গোল্ডেন আওয়ার’ বলে পরিচিত ছয় থেকে আট ঘণ্টার মধ্যে যদি কেটে যাওয়া রক্তনালী জোড়া না দেওয়া হয়, তাহলে হাত বা পা আর রক্ষা করা যায় না। দেশে ভাসকুলার সার্জারির রোগী অনেক। কিন্তু তারা জানেনই না এটা তার ভাসকুলার সমস্যা, কোথায় তার চিকিৎসা হবে।

এ সমস্যার সমাধান বিষয়ে ডা. সাকলায়েন বলেন, যারা এমবিবিএস পাস করেন, যারা এফসিপিএস ডিগ্রি নিচ্ছেন, তাদের যদি তিনমাসের জন্য ভাসকুলার সার্জারি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, তাহলে মানুষের ভোগান্তি অনেক কমবে।

তিনি বলেন, তারাই সারাদেশের ইর্মাজেন্সি কেস ম্যানেজ করতে পারবেন।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাসকুলার সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা.মাহবুবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, রক্তনালী ব্লক বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই ছিল। কিন্তু এর সঠিক চিকিৎসা হতো না। কারণ, এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক একেবারেই কম। তিনি বলেন, এ রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা শুধুমাত্র ঢাকাতে থাকায় এ ধরনের রোগীরা সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অপরদিকে, দেশের মেডিসিন থেকে শুরু করে চর্মরোগ এমনকী হাতুড়ে চিকিৎসকরাও এর চিকিৎসা করছেন। এতে করে এ সব রোগী ক্ষতির মুখে পড়ছেন।

অধ্যাপক ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, এ সব কারণে সরকারের কাছে আবেদন করেছি যেন এ বিষয়ের ওপর সরকারের নজরদারি বাড়ানো হয়। এতে সবার উপকার হবে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে ভাসকুলার বিভাগ নেই ‘এটা অবিশ্বাস্য একটি বিষয়’ মন্তব্য করে ডা. সাকলায়েন বলেন, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ভাসকুলার সার্জারি বিভাগ থাকলেও তা খুব একটা কার্যকর নয়। সারাদেশে এ বিভাগে পূর্ণ অধ্যাপক রয়েছেন মাত্র একজন।

সরকারের করণীয় উল্লেখ করে ডা. সাকলায়েন বলেন, সরকার যখন এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করবে, প্রতিটি হাসপাতালে একটি আলাদা সেটআপ দেবে, যখন আরও বেশি প্রচার পাবে, যখন সাধারণ মানুষসহ চিকিৎসকরাও জানবেন বিষয়টি, তখন আর মানুষ অহেতুক চিকিৎসা নেবেন না।

এজন্য এখন খুব বেশি প্রয়োজন প্রতিটি হাসপাতালে জরুরিভিত্তিতে ভাসকুলার বিভাগ খুলে সেখানে ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া। (বাংলাট্রিবিউন)

ভাসকুলার সম্পর্কিত আরো কিছু পোস্ট ক্লিক/টাচ্ করে পড়ুনঅজ্ঞান ছাড়া দেশে প্রথম ভ্যারিকোস ভেইন অপারেশন

ভাসকুলার সার্জন ডা. এসএমজি সাকলায়েন রাসেলের লেখা ‘অপারেশন থিয়েটারের গল্প’

নিউজ ডেস্ক :  আপডেট, বাংলাদেশ সময়  ২:০০ পিএম,  ২৩ আগস্ট  ২০১৬, মঙ্গলবার
ডিএইচ

Share