বিশেষ সংবাদ

আমাদের প্রজন্মের সেরা বার্তা সম্পাদক আহমেদ ফারুক হাসান

প্রভাষ আমিন | আপডেট: ০৫:০৬ পিএম, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫, রবিবার

আহমেদ ফারুক হাসান। মানতে দ্বিধা নেই, নামটি মনে হলেই, আমার এবং আমি নিশ্চিত অন্য সহকর্মীদেরও প্রথমেই তার বদমেজাজের কথাটাই মাথায় আসবে। কিন্তু আমি জানি, আহমেদ ফারুক হাসান আসলে নারকেলের মত। ওপরটা শক্ত, ভেতরটা সরেস। জানি, কারণ আমি তার বদমেজাজটাও দেখেছি, স্নেহও পেয়েছি।

৯৩-৯৪ সালে ফারুক ভাই বাংলাবাজার পত্রিকার বার্তা সম্পাদক ছিলেন। আর আমার প্রথম দৈনিক পত্রিকা বাংলাবাজার। মানে হলো, ফারুক ভাই পত্রিকার বড় কর্তা আর আমি কনিষ্ঠতম কর্মী। দূর থেকে ফারুক ভাইয়ের বদমেজাজ দেখেছি। কিন্তু নিজে কখনো শিকার হইনি। কেন জানি না, হয়তো ছোট বলেই ফারুক ভাই আমাকে স্নেহ করতেন। আমি সেই স্নেহটাকে প্রশ্রয় বানিয়ে সুবিধা নিতাম। ফারুক ভাই তার টেবিলের ওপর সিগারেটের প্যাকেট রাখতেন। অন্য কেউ এই ঝুকি নিতো না। কারণ বাংলাবাজার পত্রিকায় তখন পরিবেশটাই এমন ছিল, টেবিলের ওপর চিরতার পানি রাখলেও সবাই কাড়াকাড়ি করে খেয়ে ফেলতো। কিন্তু ভয়ে কেউ ফারুক ভাইয়ের প্যাকেটে হাত দিতো না। আমি অবলীলায় তার প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে নিতাম। এমনও হয়েছে, সিনিয়র অনেকে এসেও আমাকে বলতো, যেন ফারুক ভাইয়ের প্যাকেট থেকে সিগারেট এনে দেই। একদিন ফারুক ভাই আমাকে বললেন, তোর তো অনেক সাহস। ভয়ে কেউ আমার কাছে আসে না। আর তুই আমার প্যাকেট থেইক্যা সিগারেট নেস। আমি গলা ফাটিয়ে হাসতাম, আর বলতাম, আমার সাহস বেশিই।

এতক্ষণ বদমেজাজের কথা বললাম বলে কেউ ভাববেন না বদমেজাজের জন্যই তার খ্যাতি। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমাদের প্রজন্মের সেরা বার্তা সম্পাদকের নাম আহমেদ ফারুক হাসান। পঞ্চাশ পেরোনোর আগেই মৃত্যুর সাথে সখ্য ঘটানোর সময় ছিলেন দৈনিক যুগান্তরের উপ-সম্পাদক।কিন্তু ফারুক ভাইকে সবাই মনে রাখবে বার্তা সম্পাদক হিসেবেই। দেশের সংবাদপত্র ইতিহাসের বাঁক বদলে দেয়া আজকের কাগজের প্রথম বার্তা সম্পাদক আহমেদ ফারুক হাসান। আজকের কাগজের সাফল্যের অনেকটা কৃতিত্বই তার। শুধু যদি বদমেজাজীই হতেন তাহলে নিশ্চয়ই ভোরের কাগজ, বাংলাবাজার পত্রিকা, মানবজমিন, যুগান্তরে সাফল্যের সাথে দায়িত্ব পালন করতে পারতেন না। বকাঝকার ধাক্কাটা সইতে পারলে ফারুক ভাই ছিলেন সাংবাদিকতার চলন্ত ক্লাশরুম।

তার সাফল্যের মূল রহস্য জ্ঞান, প্রচুর পড়তেন, প্রচুর জানতেন। শব্দভান্ডার ছিল অসামান্য। আজকের কাগজের সাফল্যের অন্যতম শর্ত ছিল, এতে কোনো নিউজ জাম্প হতো না। তার মানে কম কথায় সব কথা লিখতে হতো। শিরোনামও হতো কম কথায়। কম শব্দে সবকিছু বলাটা সহজ কাজ নয়। এই কঠিন কাজটি অতি সহজ করে করতে পারতেন ফারুক ভাই। দেখে মনে হতো, আরে সাংবাদিকতা এত সহজ। ফুলটাইম সাংবাদিক হওয়ার আগে ফারুক ভাই কবিতা লিখতেন। কবিতা তাকে ছেড়ে গেলেও ভাষার কাব্যিক ঢংটা রয়ে গিয়েছিল। তিনি যেসব পত্রিকায় কাজ করেছেন, তার পাঠকরা অনেকবারই তার প্রমাণ পেয়েছেন। কিন্তু বার্তা সম্পাদকরা বরাবরই আড়ালে থাকেন। পাঠকরা হয়তো একটা শিরোনাম দেখে মুগ্ধ হলেন বা কোনো রিপোর্টারের ঝরঝরে ভাষার প্রশংসা করলেন; কিন্তু আসল কৃতিত্বটা কার তা জানাই হয় না তাদের। ফারুক ভাই পড়তেন বেশি, লিখতেন কম। তারপরও তার গোটা তিনেক বই পাওয়া যায় বাজারে। নতুন যারা সাংবাদিকতা করতে চান, তাদের অবশ্যপাঠ্য হতে পারে সেগুলো।

আহমেদ ফারুক হাসান, অসাধারণ, অনন্য কিন্তু সবক্ষেত্রে অনুসরনযোগ্য নয়। যেমন শুরুতেই তার যে বদমেজাজের কথা বললাম, সেটা তখন হয়তো মানিয়ে গেছে, এখন যুগ পাল্টে গেছে, এখন বদমেজাজী বস এখন আর আদরনীয় নন। ফারুক ভাই কাজপাগল মানুষ ছিলেন। খাটতে পারতেন ভুতের মত। আগের সাংবাদিকরা যেমন ঘর-সংসার ফেলে পত্রিকা অফিসকেই ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলতেন, তিনি অনেকটা তেমনই। যুগ এখন সত্যি পাল্টেছে। ঘর-সংসার ফেলে পত্রিকার জন্য জীবন দিয়ে দেয়াও এখন আর ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। কিন্তু ফারুক ভাই সত্যি কাজপাগল মানুষ ছিলেন। পত্রিকার জন্য সত্যি সত্যি জীবন দিয়ে দিয়েছেন। যুগান্তর অফিসেই তার হার্টে অ্যাটাক হয়। মেজাজে, কাজের ধরনে পুরনো ঘরানার মানুষ হলেও; আসলে তিনি ছিলেন আধুনিক মানুষ। নইলে বাংলাদেশের আধুনিক সাংবাদিকতার যুগ সন্ধিক্ষণে নেতৃত্ব দিতে পারতেন না।

জ্ঞানে, মেজাজে, প্রজ্ঞায়, বৈপরীতে, আধুনিকতায় ফারুক ভাই আসলে একজন ভালো মানুষ ছিলেন। মৃত্যুর ৬ বছর পরও তাকে স্মরণ করছি পরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়।

৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫
Probhash2000@gmail.com

Share