পিতার আত্মত্যাগ-পুত্রের আত্মসমর্পণ

হজরত ইবরাহীম (আ.)-এর দীর্ঘদিন পর্যন্ত কোনো সন্তান ছিল না। বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার পর আল্লাহ তাঁকে দুটি সন্তান দান করেন। তাদের প্রথমজন হজরত ইসমাঈল (আ.)।

দীর্ঘ দোয়া ও আহাজারির পর জীবনসায়াহ্নে এসে যাও পুত্রসন্তান লাভ করলেন,কিছুদিন না যেতেই আল্লাহর ইচ্ছায় শিশুপুত্র ইসমাইল (আ.) ও তার মা হাজেরাকে মক্কায় রেখে আসতে হয়। মক্কা নগরী সে সময়ে ছিল নিতান্ত মরুভূমি। পাহাড়ে পাহাড়ে ছিল তীব্র উষ্ণতার অখণ্ড দাপাদাপি।

জনমানব,জনবসতি বা কোনো প্রাণীর চিহ্নমাত্র সেখানে ছিল না। ছিল না তৃণলতা ও গাছগাছালি। পাহাড়বেষ্টিত সেই ছোট্ট উপত্যকা, যেখানকায় বর্তমানে কাবা শরিফ অবস্থিত, সেখানে পৌঁছে অবস্থান করলেন। কিছুদিন পর স্ত্রী-পুত্রকে একাকী রেখে আল্লাহর নির্দেশে ফিরে গেলেন নিজ বাসস্থান সিরিয়ায়। খাবার হিসেবে সামান্য পানীয় ও কিছু খেজুর দিয়ে গেলেন।

দিনকয়েক যেতেই পানীয় ও খেজুর শেষ হয়ে গেল। মা-শিশু দু’জনই তীব্র পিপাসায় কাতর হলেন। শিশু ইসমাঈল কাঁদতে কাঁদতে মরণমুখে পতিত হলো। তার হৃদয়বিদারক চিৎকার বিবি হাজেরার জন্য ছিল অসহনীয়; কিন্তু করার কিছুই ছিল না। তবুও ব্যর্থ চেষ্টা হিসেবে পানির আশায় ছুটে গেলেন পাশের পাহাড় সাফায়। সেখান থেকে গেলেন মারওয়ায়। সাফা থেকে মারওয়া,মারওয়া থেকে সাফা- এভাবে একে একে সাতবার চক্কর দিলেন। কিন্তু কোথাও পানির চিহ্নও দেখলেন না! দৌড়ে দৌড়ে তিনিও ক্লান্ত। নিরাশ হয়ে ফিরে এলেন ছেলের কাছে। ততক্ষণে দেখলেন আল্লাহর কুদরতি পানির ফোয়ারা। মরুভূমিতে প্রবাহিত শীতল ঝরনাধারা। এ ঝরনার নামই জমজম।

হজরত ইসমাইল (আ.) কৈশরে উপনীত হলেন, পিতার কাজে টুকটাক সহযোগিতা করেন, তখনই আল্লাহর আদেশ এলো তোমার সর্বাধিক প্রিয় বস্তু কোরবানি করো। প্রিয় বস্তু নির্বাচনে কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলেন হজরত ইবরাহীম (আ.)। অবশেষে স্থির করতে পারলেন যে, আদরের সন্তান ইসমাইলই তার সর্বাধিক প্রিয়পাত্র। আল্লাহর আদেশ পালনে তিনি সন্তানের মতামতও জানতে চাইলেন। যেমন পিতা, তেমন সন্তান। সন্তানও আল্লাহর পথে কোরবানি হওয়ার জন্য সানন্দে রাজি হয়ে গেল। মিনা প্রান্তরের একটি নির্জন স্থানে হজরত ইবরাহীম (আ.) প্রিয়পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি করতে উদ্যত হলেন।

সে ঘটনার বিবরণ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘অতঃপর সে যখন পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো তখন ইবরাহীম তাকে বলল, হে পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে জবাই করছি। এখন তোমার অভিমত কী? সে বলল, হে পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন।

যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করলেন এবং ইবরাহীম তাকে জবাই করার জন্য শায়িত করলেন তখন আমি তাকে ডেকে বললাম,‘হে ইবরাহীম! তুমি তো স্বপ্নকে সত্যি প্রমাণিত করে দেখালে।’ (সুরা সাফফাত : ১০২-১০৫)। ইসমাইলকে জবাই করানো আল্লাহর উদ্দেশ্য ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর প্রতি পিতা-পুত্রের নিঃশর্ত আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ প্রত্যক্ষ করা। তাই আল্লাহ তায়ালা একটি জান্নাতি দুম্বা পাঠিয়ে দেন। ইসমাইল (আ.)-এর পরিবর্তে জান্নাতি দুম্বা কোরবানি করা হয় এবং সেই থেকে কেয়ামত পর্যন্ত সব মুসলমানের জন্য কোরবানি ওয়াজিব করা হয়।

ইবরাহীম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর এক অমর কীর্তি হলো বাইতুল্লাহ শরিফ নির্মাণ। হজরত নুহ (আ.)-এর মহাপ্লাবনে পবিত্র কাবা শরিফ মাটির সঙ্গে মিশে যায়। এরপর হজরত ইবরাহীম (আ.) কাবা শরিফ নির্মাণ করেন। হজরত ইসমাইল (আ.) পাহাড় থেকে পাথর এনে দিতেন আর ইবরাহীম (আ.) একটির ওপর একটি পাথরের গাঁথুনি দিতেন। সুরা বাকারার ১২৭নং আয়াতে এ ঘটনা আলোচিত হয়েছে। কাবা শরিফ নির্মাণে দুটি অলৌকিক কাণ্ড ঘটে। একটি হলো যে পাথরে দাঁড়িয়ে হজরত ইবরাহীম (আ.) কাবার নির্মাণকাজ করতেন সেই পাথর প্রয়োজন মতো ওপরের দিকে ও নিচের দিকে নেমে আসত।

দ্বিতীয় ছিল, হাজরে আসওয়াদ। জান্নাত থেকে আসা ধবধবে সাদা একটি পাথর কাবা শরিফে যুক্ত করা হয়। যে পাথরে দাঁড়িয়ে কাবা শরিফ নির্মাণ করা হয়েছিল, সে পাথরে হজরত ইবরাহীম (আ.)-এর পদচিহ্ন অঙ্কিত হয়ে গিয়েছিল। সে পাথরটি মুজিজা হিসেবে এখনও সংরক্ষিত আছে।

হজরত ইসমাইল (আ.)-এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মক্কা নগরী আবাদ করেন। জমজম কূপের মাধ্যমে তাদের পানীয়ের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তী সময়ে একটি ব্যবসায়ী কাফেলাও তাদের অনুমতিসাপেক্ষে মক্কায় বসবাস আরম্ভ করে। এভাবে উত্থান হয় একটি নগরীর। ইসমাইল (আ.)-এর বংশেই জন্মগ্রহণ করেন শেষ নবী হজরত মোহাম্মদ মুস্তফা (সা.)।

তাই রক্তে ও কর্মে মুসলিম জাতি হজরত ইসমাইল (আ.)এর অনুসারী।

মাওলানা শামসুদ্দীন সাদী, ১৭ জুলাই ২০২১

Share