জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী আজ ২৫ মে রোববার। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো :‘ দু হাজার চব্বিশের গণ-অভ্যূত্থান : কাজী নজরুলের উত্তরাধিকার ’। জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে চাঁদপুরে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ৬ মে ২০২৫ সকাল টায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন চাঁদপুরের মান্যবর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন । আমন্ত্রিত উপস্থিত সকলের মতামতের ভিত্তিতে কর্মসূচি গৃহীত হয়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী আগামি ২৫ মে রোজ রোববার বিকেল ৫ টায় কবির রচিত কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতা ও সন্ধ্য ৭ টায় জেলা শিল্প কলা একাডেমিতে ‘দু’হাজার চব্বিশের গণঅভ্যূত্থান ; কাজী নজরুরের উত্তাধিকার’-প্রতিপাদ্য বিষয়ে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান্।
এ ব্যাপারে একটি আবৃত্তি উপ-কমিটি করা হয়েছে। এদিকে নজরুল গবেষণা পরিষদ, চাঁদপুরের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে-দ’ুটো পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ ও চাঁদপুর পৌরসভাধীন আক্কাছ আলী রেলওয়ে একাডেমিতে বেলা আড়াই টায় ১০ শ্রেণির শিক্ষার্থী সমন্বয়ে কবির জীবন ও সাহিত্যে অবদান নিয়ে আলোচনা সভা এবং একটি আকর্ষণীয় কুইজ প্রতিযোগিতা। এদিকে নজরুল পরিষদ নামে অপর একটি সাংস্কৃতি সংগঠনও কর্মসূচি প্রণয়ন করেছে ।
প্রসঙ্গত : জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রেম, মানবতা ও বিদ্রোহের প্রতীক। উপন্যাস, নাটক, সঙ্গীত আর দর্শনেও নজরুলের অনবদ্য উপস্থিতি বর্ণাঢ্য করেছে বাংলা সাহিত্যকে। কণ্ঠশিল্পী, অভিনেতা, সম্পাদক পরিচয়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অভিমানী এ মানুষ হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলেন নিপীড়িত-অসহায়ের আর্তি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর কবিতা কোটি তরুণের রক্তে জ্বালায় স্ফুলিঙ্গ। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী এ মানুষটি ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (ইংরেজি সাল অনুযায়ী ২৪ মে ১৮৯৯ সাল) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের জীবনের পরতে পরতে সংগ্রাম করতে হয়েছে তাঁকে। জড়িয়ে ছিলেন নানা পেশায়। ১৯১৭ সালে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। অংশ নেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও। এরই মাঝে তৎকালীন প্রভাবশালী কবি-সাহিত্যিকদের সংস্পর্শে আসেন তিনি। ১৯২২ সালে প্রকাশ করেন ধূমকেতু পত্রিকা। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য নজরুলকে দেয়া হয় এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। বৃটিশদের প্রায় দু’শ বছরের অত্যাচার, নিপীড়ন ও জর্জরিত জাতিকে শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা অর্জনের আহবান জানিয়েছেন প্রিয় কবি নজরুল।
বিদ্রোহী কবিতাটি কবি নজরুল লিখে সে সময়ে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকারের দমন-পীড়নের জবাব দেন। একই সাথে তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে পরাধীনতার শৃংখল ভেঙ্গে তরুণ সমাজকে সু-শৃঙ্খল হতে সহায়তা করেছিল বিদ্রোহী কবিতাটি। জীর্ণশীর্ণ ও দু’বছরের একটি পরাধীন জাতিকে একটি স্বাধীন ও শোষণমুক্ত সমাজ গঠনে বিদ্রোহী কবিতার ভূমিকা রয়েছে। তৎকালীন সময়ে বিদ্রোহী কবিতাটি কতটুকু চ্যালেঞ্জিং বিষয় ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিদ্রোহী কবিতার রচনার প্রেক্ষাপট নিয়ে জানা যায়- ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের কোনো এক রাতে ৩-৪ সি, তালতলা, কলকাতা-১৪ লেনের বাড়ির নিচ তলায় দক্ষিণ- পূর্ব কোণে ঘরে বসে শেষ রাতে নিবিড় পরিবেশে তিনি ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি রচনা করেন। বল বীর— উন্নত মম শির ্। বিদ্রোহী কবিতার প্রথম শ্রোতা তাঁর বন্ধু কমরেড মুজ্জাফর আহমেদ।
তিনি বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি ও একজন বাঙালি কবি,একটি বিদ্রোহী কবিতা লিখেই বিদ্রোহীকবি এবং পরবর্তীকালে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। দেশপ্রেম, মহত্ব,মানুষত্ববোধ, মানুষের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা জাগ্রত করা তাঁর লেখনিতে পাওয়া গেছে। পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ থেকে পরাধীনতার বিরুদ্ধে লেখনি, বৃটিশ শাসকদের হুমকি-দমকি উপেক্ষা করেও ক্ষুরদার লেখনি অব্যাহত রাখা, প্রেম-প্রণয়-ভালোবাসায় বিচ্ছেদ,জেল জরিমানা,অর্থভৈববের প্রাচূতাহীন জীবন,দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে থেকেই জীবন-যাপন,প্রথমজীবনে নার্গিসের প্রেমের বিরহ-বেদনা, প্রেয়সী ও পরে স্ত্রী প্রমীলার পক্ষাঘাতজনিত অসুস্থতায় কবিকে সাময়িক বিচলিতহওয়া,সন্তান ও মাতৃবিয়োগেও থেমে যান নি তিনি। তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম অগ্রণী বাঙালী কবি,ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকা রাখার পাশাপাশি প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্যসর্বাধিক পরিচিত।
১৯২০ সাল হতে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত তাঁর সব রচনা সামগ্রীর সঠিক হিসেব পাওয়া না গেলেও ২ হাজার ৮শ গান,৯’শ কবিত, ১’শ টি প্রবন্ধ ৫৫ ডি গ্রন্থ, ২৫টি নাটক, ১৮টি গল্প, ১’শ ৯৪ গজল ও ইসলামী গান ও ৪’শ ৫০টি শ্যামা সঙ্গীত রচনা করেন। ১৯৪৩ সাল থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাকরুদ্ধ ছিলেন। তাঁর স্ত্রী প্রমীলা ১৯৩৯ সালে অসুস্থ হন এবং ১৯৬২ সালে ৩০ জুন মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সমাধিস্থল কবির জন্মস্থান চুরুলিয়ায়। বাংলা ভাষার সাহিত্য গগনে আর কোনো বাংলা ভাষার কবি বা সাহিত্যিক ২০-২১ বছরের এ অল্প সময়ে এতগুলো রচনাবলী কেউ রেখে গেছেন কি না তা আমার জানা নেই। তিনি বাংলা সাহিত্য,কবিতায় সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ দু’ বাংলাতেই তাঁর কবিতা, গান ও গজলে সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে বিদ্রোহী রি’নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা মননে,মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি একাধারে কবি,সাহিত্যিক,সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। অগ্নিবীণা হাতে তাঁর প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তাঁর প্রকাশনা। যেমন লেখাতে তিনি বিদ্রোহী,তেমনই জীবনের সব কাজেই “বিদ্রোহী কবি” হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ। তিনি সর্বমোট ২৩ বার বাংলাদেশে আসেন। তিনি ছিলেন আমাদের কুমিল্লার জামাই।
চাঁদপুর আসেন ৩ বার। যে কোনো কারণেই হউক- তিনি দ’ুটো বিয়ে করেন। তাও আবার কুমিল্লায়। একটি হলো-দৌলতপুরের তেওতায় অপরটি হলো -কুমিল্লা শহরের কান্দির পাড়। প্রথম স্ত্রীর নাম- নার্গিস এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম প্রমীলা। দু’ টো নাম তিনিই রেখেছেন। কবির প্রিয় কবির নাম ছিল-পারস্যেও কবি হাফিজ। কবি হাফিজের প্রিয় ফুল ছিল- নার্গিস। কবি নজরুল দৌলত পুরে নার্গিসদের বাড়িতে অতিথি থাকাকালীন ৪১ দিনে ১শ ৬০টি গান ও ১শ ২০টি কবিতাই লিখেন। কবির সাথে যাঁদের প্রণয় সম্পর্ক ছিলো-তাঁদের মধ্যে কুমিল্লার দৌলতপুরের সৈয়দা আসা খাতুন ওরফে নার্গিস, কুমিল্লা কান্দিরপাড়ের ইন্দোকুমারের ভাতিজি ও বসন্তকুমার-গিরিবালার মেয়ে আশালতা সেনগুপ্তা ওরফে প্রমীলা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ছাত্রী ফজিলাতুন্নেছা ওরফে জোহা। জোহার সাথে কবির সম্পর্ক বেশি দিন যায় নি।
১৩২৮ বঙ্গাব্দের ৩ আষাঢ় শুক্রবার কবির সাথে নার্গিসের বিয়ে হয়। কবি নজরুলের সাথে নার্গিসের বিয়ে হলেও বাসর রাতেই কবি নার্গিসদের বাড়ি ত্যাগ করেন। অবশেষে নার্গিস নজরুলের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেন। করেন এবং ‘তহমীনা’ নামে একটি উপন্যাসও লিখেন। ১৯৩৭ সালে ৩০ বছর বয়সে নার্গিসের বিয়ে হয়। তাও আলী আকবর খানের পুস্তক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী এর সাথে। তার নাম ছিল কবি আজিজুল হাকিম। চব্বিশ বছর সংসার অতিবাহিত হওয়ার পর ১৯৬২ সালে নার্গিসের স্বামী আজীজুল হাকিম মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭১ সালের প্রারম্ভে নার্গিস বিলেতে ছেলের কাছে চলে যান। নজরুলের মৃত্যুর পর একবার দেশে এসে নজরুল সমাধিতে গিয়েছিলেন নার্গিস অনেকটা নিভৃতে।
১৯৮৫ সালে ম্যানচেস্টারে একমাত্র সন্তান ডা.ফিরোজের বাসভবনে ৮১ বছর বয়সে নার্গিসের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৭২ সালের ২৪ মে বাংলাদেশে স্বপরিবারে আসেন এবং নির্ভীক ও বাকরুদ্ধ অবস্থায় ঢাকাতে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ মে ৭৭ বছর বয়সে তিনি তৎকালীন পিজি হাসপাতালের ১১৭ নং কেবিনে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে তাঁর অবদানের জন্যে ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তৎকালীন পিজি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন এ মহাবিদ্রোহী ও প্রেমিক পুরুষ। কবির ইচ্ছানুসারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ২০২৪ সালের ডিসম্বরে তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদার স্বীকৃতি দেন। ২৪ মে ২০২৫
আবদুল গনি
২৪ মে ২০২৫
এজি