স্কাইপে ঈদের দিনে বিদেশে থাকা মায়ের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করে দেশে থাকা ছেলেমেয়েরা।
তাহমিনার এবার ঈদে মন খারাপ। কেননা, তাঁর বাবা-মা ঢাকায় নেই। ঈদ করতে তাঁরা রমজান মাসের আগেই কানাডায় তাহমিনার বড় বোন সানজানার বাসায় গেছেন। ওখানেই ঈদ করবেন তাঁরা। প্রতিবছরের মতো তাহমিনার ঈদের দিন বাবার বাড়ি যাওয়া হবে না, রাতের খাবারটা বাবার বাড়ি খেতেন, সেটাও হবে না। তাঁর মেয়েও পাবে না নানা-নানির কাছ থেকে ঈদের সেলামি। এ কারণে এবার ঈদকে তাঁর তেমন ঈদ ঈদ মনে হচ্ছে না। তাহমিনা বলেন, ‘ঈদে হয়তো অফিস থেকে লম্বা ছুটি পাব। কিন্তু ছুটিটা অর্থহীন মনে হচ্ছে। শ্বশুর-শাশুড়ি বেঁচে নেই। শহরে মা-বাবাই ছিলেন সবচেয়ে আপনজন। আপুকে হিংসা হচ্ছে। ইস্, ওরা কত মজা করবে ওখানে। আমার সব মজা মাটি।’
রিমার অবশ্য কোনো ঈদই মায়ের সঙ্গে করা হয় না। রিমার বড় ভাই থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে, কয়েক বছর ধরে অভিবাসী ভিসায় তাঁদের মা বছর বছর যুক্তরাষ্ট্রে যাতায়াত করছেন। গ্রীষ্মকালটা বেশি ওদেশে থাকা হয় বলে কোনোবারই ঈদের সময় মাকে কাছে পান না রিমা। ‘খুবই ফাঁকা ফাঁকা লাগে জানেন?’ বললেন রিমা। ‘ঈদের দিনগুলোতে এত বেশি আম্মাকে মিস করি। ঈদের মতো একটা উৎসবে মা কাছে থাকেন না বলে সব আনন্দই মাটি হয়ে যায়। ঈদের সকালে কাজ সেরে নতুন জামাকাপড় পরে স্কাইপ বা মেসেঞ্জারে দূরে থাকা মায়ের সঙ্গে কথা বলে মন খারাপ কাটাই।’
প্রত্যেক মানুষেরই ঈদের দিন ঘিরে থাকে নানা রঙিন স্মৃতি। ছেলেবেলার নতুন জামা লুকিয়ে রাখা, ঈদের চাঁদ দেখে আনন্দে উদ্বেল হওয়া, মায়ের হাতের মজাদার সেমাই আর পোলাও-মাংসের স্বাদ, মুরব্বিদের সালাম করে নতুন টাকার নোট হাতে পাওয়া—এই আনন্দময় স্মৃতিগুলো প্রতি ঈদে ঘুরে ঘুরে আসে। বড় হয়ে হুবহু এই ব্যাপারগুলো না ঘটলেও অন্য রকম আনন্দ পেতে তাই আমরা ছুটে যাই গ্রামের বাড়িতে, মফস্বল শহরে, বাবা-মা বা প্রিয়জনদের কাছে।
সন্তানদের মধ্যে নিজেদের শৈশবের পুনরাবৃত্তি দেখতে ভালো লাগে তখন। বয়স্ক মা হয়তো এখন নিজের হাতে রান্না করতে পারেন না, কিন্তু আনন্দে আটখানা হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন। আপনজনদের কাছে পাওয়ার আশাতেই তো প্রতি ঈদে লাখ লাখ মানুষ দারুণ কষ্ট আর হয়রানির মধ্যেও ঢাকা থেকে বাড়ির পথে রওনা দেন।
দিন বদলেছে। এখন কেবল সন্তান নয়, বাবা-মায়েরাও ঈদ উপলক্ষে দূরে যাত্রা করেন। অনেক পরিবারে কোনো সন্তান থাকে দেশের বাইরে, ঈদের সময় তারা নিয়ে যায় বাবা-মাকে। অনেক সময় পাকাপাকিভাবে দেশ ছাড়েন বাবা-মা অভিবাসী হয়ে, কখনো আবার দূর দেশে থাকা নাতি-নাতনিকে সঙ্গ দিতে তাঁদের দেশ ছাড়তে হয়। দেশে রয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েরা তখন হা-হুতাশ করতে থাকে।
কথা হচ্ছিল এমন একজন মায়ের সঙ্গে, যিনি তাঁর মেয়ের কাছে প্রায়ই গিয়ে থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। মেয়ে ওখানে পড়াশোনা করছেন, তাঁর সন্তানদের দেখভাল করতে যেতে হয় মাকে। এদিকে দেশে তাঁর একমাত্র ছেলে সারাক্ষণ অসন্তুষ্ট হয়ে থাকে। ‘গেলবার লম্বা সময়ের জন্য চলে গিয়েছিলাম যখন, ঈদও করেছিলাম ওখানে, আমার ছেলে রীতিমতো ডিপ্রেশনে ভুগতে শুরু করেছিল। ফোন করলেই রেগে গিয়ে বলত, তুমি তোমার মেয়ের কাছেই থাকো। আমার কথা আর মনে করার দরকার নেই।’ হাসি থামিয়ে একটু মন খারাপই করলেন তিনি—‘কী করব বলো? মেয়েও তো আমারই সন্তান। আমি না থাকলে ওর পড়াশোনাই যে বন্ধ করে দিতে হয়। এদিকে ছেলের জন্য প্রাণ কাঁদে। দেশে ফিরে দেখি ছেলে রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এবার আবার যাওয়ার কথা ছিল, অনেক ভেবেচিন্তা ঠিক করেছি, ঈদের পর যাব। মেয়ে অস্থির হয়ে পড়েছে, কিন্তু কী আর করা!’
জীবীকার প্রয়োজনে সন্তানেরা ছড়িয়ে পড়েছেন দেশ থেকে দেশে, নানা মহাদেশে। কিন্তু নাড়ির টান তো আছেই। সারা বছর ব্যস্ততার মধ্যে কাটলেও ছেলেমেয়েরা চায় উৎসবে বাবা বা মা তাদের কাছেই থাকুক। ঈদের দিনটা মায়ের মুখ না দেখলে চলে? কিন্তু মা তো আর কারও একার নন। যেখানেই থাকুন তিনি, দূরে থাকা সন্তানদের জন্য তাঁরও ঠিকই মন পোড়ে। হাসিমুখে বলেন রিজিয়া বেগম, ‘সন্তানের প্রতি ভালোবাসা তো আর ভাগ করা যায় না, বুঝলে? কাউকে একটু কম, কাউকে বেশি—মা তো আর এভাবে ভালোবাসতে পারে না। তাই কাছে না থাকলেও ভালোবাসার কমতি হয় না একটুও। অভিমানী সন্তানেরা বুঝুক আর না বুঝুক।’
নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ০৬:৪৫ পি.এম, ২৭ জুন ২০১৭,মঙ্গলবার
ইব্রাহীম জুয়েল