প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রছাত্রীদের মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বইপত্র সাজিয়ে রাখার কোনো বস্তু নয়, তোমাদের পড়তে হবে। জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আগামী দিনে তোমাদের মধ্য থেকেই দেশের নেতা-প্রধানমন্ত্রী হবে। কাজেই সেভাবেই নিজেদের তৈরি করতে হবে।
বৃহস্পতিবার(৮ সেপ্টেম্বর) সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ২০১৬’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করতে দেশের ছাত্রসমাজ, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দল ও তাদের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে শতভাগ নিরক্ষরমুক্ত করতে সব শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সবার উদ্যোগেই আমরা এ দেশকে দ্রুতই নিরক্ষরমুক্ত ঘোষণা করতে পারব, যদি সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজ নিজ এলাকার নিরক্ষরদের শিক্ষিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষার মাধ্যমে আমরা জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে এনেছি। সারা বিশ্বে শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ কম বলে ছেলেমেয়ে সমতা আনার কথা বলা হয়। আর আমাদের দেশে উল্টো। এখানে মেয়েদের সংখ্যা বেশি বলে এখন ছেলেদের এগিয়ে আনতে হবে।’
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমরা দেশের সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশে উন্নীত করতে সমর্থ হয়েছি। সমগ্র বাংলাদেশে আমাদের জনপ্রতিনিধিরা আছেন, রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা আছেন, পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকেরা রয়েছেন; প্রত্যেকেই যদি উদ্যোগ নেন…আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশটা আমাদের। আমাদেরই এই দেশকে গড়ে তুলতে হবে। যাতে আমরা মর্যাদার সঙ্গে চলতে পারি। দেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে এবং দারিদ্র্যমুক্ত করতে শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘সমগ্র বাংলাদেশে আমাদের জনপ্রতিনিধিরা আছেন, রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা আছেন; পাশাপাশি যেসব সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রয়েছেন এবং বিভিন্ন শ্রেণিপেশার নাগরিকেরা যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকে যদি উদ্যোগ নেন যে আমাদের এলাকায় কোনো নিরক্ষর থাকবে না এবং আপনি তাদের সাহায্য করবেন—নিজ নিজ উদ্যোগ নিলেই আপনারা দেখবেন যে আমরা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘এই দেশটা আমাদের। আসুন, সবাই মিলে আমরা এই দেশকে গড়ে তুলি, যাতে আমরা মর্যাদার সঙ্গে চলতে পারি। আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধামুক্ত-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হব।’
তিনি বলেন, ‘আমি শিক্ষকদের উদ্দেশে বলব, আপনারা একটা মহৎ পেশায় আছেন। জাতির পিতা প্রায়ই বলতেন, “সোনার বাংলা গড়ার জন্য সোনার মানুষ চাই।” আপনারা হচ্ছেন সেই মানুষ গড়ার কারিগর।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনারা পারেন নীতি ও মূল্যবোধের চর্চা শিখিয়ে দেশের প্রতিটি শিশুকে আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে। ভালো-মন্দ কিংবা ন্যায়-অন্যায় বিবেচনার জ্ঞান এবং দেশাত্মবোধের শিক্ষা দেওয়া আপনাদের দায়িত্ব।’
তাঁর সরকারের শিক্ষা সম্প্রসারণের উদ্যোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দীর্ঘ ২১ বছর পর ’৯৬-এ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিলাম। আমাদের পদক্ষেপের ফলে মাত্র দুই বছরে সাক্ষরতার হার ৪৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়ায়। এ অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ “ইউনেসকো সাক্ষরতা পুরস্কার ১৯৯৮” লাভ করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোটের ২০০১-২০০৬ শাসন আমলে সাক্ষরতার হার বাড়েনি। উল্টো কমে ৪৪ শতাংশে নেমে যায়।
দেশে এখন সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সাক্ষর জ্ঞানহীন মানুষ দৃষ্টিশক্তি থাকতেও একধরনের দৃষ্টিহীনতায় ভোগেন। তাই সবার মনের-জ্ঞানের চোখ খুলে দিতে, আপন ভালো-মন্দ বুঝে নিতে আমরা ব্যাপকভিত্তিক সাক্ষরতা কার্যক্রম গ্রহণ করেছি।’ তিনি প্রতিবছর ১ জানুয়ারি দেশব্যাপী বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, ‘আমরা গত সাত বছরে বিনা মূল্যে ১৯৩ কোটি বই বিতরণ করেছি। ১ জানুয়ারি ২০১৬ দেশব্যাপী “বই উৎসব” পালিত হয়েছে।’
প্রাথমিক ও গণমুখী শিক্ষার প্রসারে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার ২০১০ সালে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে। যেখানে প্রাথমিক শিক্ষা-শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশ, আচরণ ও ভাষা শেখানোর মৌলিক স্তর হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
মাধ্যমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বৃত্তি উপবৃত্তি চালুর কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে দেড় হাজার দরিদ্র-মেধাবী ছাত্রছাত্রীকে বৃত্তি দিচ্ছি।’ তিনি বলেন, এক হাজার কোটি টাকার সিড মানি দিয়ে ‘প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা-সহায়তা ট্রাস্ট’ গঠন করেছি। এখান থেকে প্রাথমিক হতে ডিগ্রি পর্যন্ত ১ কোটি ২৮ লাখ ছাত্রছাত্রীকে বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ৪৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্প ৬৪ জেলা’ নামে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ ২০১৪ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সহকারী শিক্ষকের বেতন একধাপ বাড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ছাত্রছাত্রী ঝরে পড়ার হার আমরা ২৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে ২০০৭ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ৫০ দশমিক ৫ শতাংশ।’ ঝরে পড়া রোধকল্পে মিড-ডে মিল চালুর জন্য সমাজের বিত্তবানদের তিনি এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
শিশুকল্যাণ ট্রাস্ট এবং আনন্দ স্কুল প্রতিষ্ঠায় সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিশুকল্যাণ ট্রাস্টের আওতায় ৯১টি ‘শিশুকল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেছি। এসব বিদ্যালয়ে ছাত্রসংখ্যা ২০ হাজার। এদের প্রাথমিক স্তরে ৬০০ ও মাধ্যমিক স্তরে ৮০০ টাকা করে প্রতি মাসে বৃত্তি দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, দেশের ৫২টি জেলার ১৪৮টি উপজেলায় ১ হাজার ১৪০ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ১২ হাজার ৫৬৭টি ‘আনন্দ স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেছি। ফলে ঝরে পড়া ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সী ৭ লাখ ২০ হাজার শিশু দ্বিতীয়বার প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে।
শারীরিক ও মানসিক বিকাশ এবং ক্রীড়ানৈপুণ্য বাড়াতে প্রাথমিকে ছাত্রদের জন্য বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ এবং ছাত্রীদের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১০ সাল থেকে প্রতিটি বিদ্যালয়ে ‘স্টুডেন্টস কাউন্সিল’ গঠিত হচ্ছে। তাদের প্রশিক্ষণের জন্য কক্সবাজারে ‘লিডারশিপ ট্রেনিং সেন্টার’ নির্মিত হচ্ছে। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য হুইলচেয়ার, হিয়ারিং এইড, ক্র্যাচসহ অন্যান্য সরঞ্জাম দেওয়া হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানের বক্তৃতা পর্ব শেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মোহাম্মদ আসিফউজ্জামান এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রুহুল আমিন সরকার অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে ইউনেসকোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভার একটি শুভেচ্ছাবাণীও পড়ে শোনানো হয়।(প্রথম আলো)
নিউজ ডেস্ক ।।আপডটে, বাংলাদশে সময় ০৭:০৯ পিএম,৮ সেপ্টেম্বন ২০১৬ বৃহস্পতিবার
এইউ