রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগে অধ্যয়নকালে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে একটি মেসে ভাড়া থাকতেন মিরাক্কেল চ্যাম্পিয়ান আবু হেনা রনি। একদিন তার পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা। পকেটে টাকা নেই। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, কোথায় যাবেন কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।
কারাগারের পাশে মেস হওয়ায় ওই পথে নিয়মিত যাতায়াত করতে রনি। ফলে জেল কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার কিছুটা সম্পর্কও তৈরি হয়। সেই সুবাদে সেই দিন জেলখানার বন্দিদের জন্য যেখানে রান্না হয় সেখানে চলে গেলেন তিনি। ওদের কাছ থেকে এক বাটি ভাতও চেয়ে নিলেন।
মেসে ফিরে যখনই ভাত নিয়ে মুখে দিতে যাবেন এমন সময় রনির চোখের সামনে মায়ের মুখটা ভেসে উঠলো। খাবারটা নিয়ে তখনই বাসে চেপে নাটোরে নিজ বাড়িতে ফিরে আসলেন।
পরে মায়ের হাতে ভাতটা তুলে দিলে তিনি তরকারি দিয়ে মেখে নিজে মুখে না নিয়ে সব খাবার বাবার মুখে তুলে দিলেন। এভাবেই আবু হেনা রনি তার মায়ের বহুদিনের একটি স্বপ্ন পূরণ করেন। কারণ রনির মা রনিকে প্রায়ই বলতেন, ‘তোর বাপেরে আমি জেলের ভাত খাওয়াইয়া ছাড়মু।’
বুধবার বিকেল আনুমানিক ৩টা। গুলশান ১ নম্বরে ইমানুয়েলস্ রেস্টুরেন্টের মিলনায়তনে অনলাইন নিউজ পোর্টাল এর প্রতিনিধি সম্মেলনে উপস্থিত দর্শকশ্রোতা রনির মুখে এ কাল্পনিক গল্প শুনে হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। কিন্তু তার মিনিট কয়েক আগেও তারা সবাই এ গল্পকে রনির মেস জীবনের বাস্তব গল্প মনে করে সিরিয়াস হয়ে দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে বসেছিলেন।
এই হলেন মিরাক্কেল চ্যাম্পিয়ান বাংলাদেশের গর্ব আবু হেনা রনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রিধারী রনিকে কেউ চিনতেন নিজ প্রতিভাগুণে। তিনি এখন এপারবাংলা ওপার বাংলার খুবই জনপ্রিয় একজন স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান। যিনি তার দর্শক শ্রোতাকে স্ট্যান্ড আপ কমেডির মাধ্যমে নিখাদ আনন্দ দেন, হাসাতে হাসাতে পেটে খিল ধরান। খুব সহজেই আপন করে নিতে জানেন।
আবু হেনা রনিকে কাছে পেয়ে কৌতূহলবশত জানতে চেয়েছিলাম মিরাক্কেলের আগের রনি আর চ্যাম্পিয়ান রনি কেমন ছিলেন, এখন কেমন আছেন আর তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাই বা কি?
অনলাইন নিউজ এ প্রতিবেদকের সঙ্গে এক সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে আবু হেনা রনি জানান, ‘ছোটবেলা থেকেই বন্ধুদের সঙ্গে অনেক মজা করতাম। কিন্তু এটা নিয়ে যে কখনও কোনো বড় কিছু সম্ভব তা কখনোই ভাবিনি। মূলত স্কুল কলেজে মজার মজার অভিনয় হতো সেখানে অংশগ্রহণই ছিল টার্গেট।’
রনি বলেন, ‘যখন দর্শক হিসেবে কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতাম, তখন ঠিকমতো বসার জায়গা পেতাম না। কিন্তু লক্ষ্য করতাম- যারা মঞ্চে গান বা অন্য কোনো পারফরমেন্স করেন সেই অভিনেতার জন্য গ্রিন রুমে থাকার ব্যবস্থা হয়। অভিনেতা যখন মঞ্চে উঠেন সবাই আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। মঞ্চে ভাল কিছু করতে পারলে ভাল বসার জায়গা পাওয়া যাবে, এটাই ছিল প্রাথমিক স্বপ্ন।’
তিনি গান গেয়ে বড় কিছু হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখনও পর্যন্ত গলায় তেমন সুর ছিল না বলে ২০০০ সালে স্কুলের ১৬ ডিসেম্বরের অনুষ্ঠানে মঞ্চে পারফরমেন্স করার সুযোগটুকুও পাননি। ২০০৩ সালে নাটোর থেকে এসএসসি, ২০০৫ সালে রাজশাহী বরেন্দ্র কলেজ থেকে এইচএসসি ও পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।
২০১১ সালে বগুড়া থেকে মিরাক্কেলে অডিশন দিয়ে কলকাতায় যাওয়ার সুযোগ পান।
মিরাক্কেলে কেমন করে পারফরমেন্সের প্রস্তুুতি নিতেন জানতে চাইলে রনি জানান, ‘সেখানকার শিক্ষা পদ্ধতিটাই এমন যে সব পারফরমারদের দৈনিক ১৬/১৭ ঘণ্টা একসঙ্গে থাকতে হয়, সারাক্ষণ নতুন নতুন জোকস নিয়ে ভাবতে হয়, যারা গ্রুমার থাকেন তাদের সঙ্গে আলোচনা করে অনুমোদন পেলে পারফরমেন্সের রিহার্সেল করতে হয়।’
মিরাক্কেলে ২০১২ সালে চ্যাম্পিয়ান হবেন এমনটি ভাবেননি। সারাক্ষণ পারফরমেন্স নিয়ে চিন্তায় থাকতেন, টেনশনে থাকতেন।
ওই বছর অপূর্ব তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলেও অন্যান্য সকলেই খুব ভাল পারফরমার ছিল বলে জানান রনি।
তিন বিচারক শ্রীলেখা মিত্র, রজতব দত্ত ও পরান বন্দোপাধ্যয়ের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন, পারফরমেন্সের আগে পরে কথা হতো কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে আবু হেনা রনি জানান, ‘বিচারকদের সঙ্গে পারফরমারদের সবার সম্পর্কই খুব ভাল ছিল। তবে পারফরমেন্সের আগে পরে ব্যাক স্টেজে কখনই বিচারকদের সঙ্গে দেখা করতাম না। পারফরমেন্স দিয়ে সব সময় তাদের কাছে যেতে চাইতাম এবং পরিশ্রম করে ভাল পারফরমেন্স করে তাদের সবার ভালবাসা অর্জনে সমর্থ হয়েছিলাম।’
দেশে ফেরার পর কেমন সাড়া পেয়েছিলেন জানতে চাইলে আবু হেনা রনি জানান, কলকাতায় থাকাকালে বুঝতে পারেননি মিরাক্কেলের চ্যাম্পিয়ান হওয়ার সুবাদে বাংলাদেশে আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা পেয়ে গেছেন। তবে বিমানবন্দরে নেমেই বুুঝতে পেরেছেন যে তিনি রীতিমতো সেলিব্রেটি হয়ে গেছেন।
মিরাক্কেল চ্যাম্পিয়ান হয়ে আসার পর কেমন করে দিনকাল কাটছে জানতে চাইলে রনি বলেন, ‘বর্তমানে ফিল্ম, নাটক ও অন্যান্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছি। বাংলাদেশে ‘স্বপ্ন যে তুই’ ও ‘পদ্মপাতা’ দুটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করছি। চলচ্চিত্র দুটি মুক্তিও পেয়েছে এবং বেশ সাড়াও পেয়েছি।’
এছাড়া কলকাতায় পিযুষ সাহা পরিচালিত ‘তুই আমার রানি’ নামে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন এবং সেটি মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে বলেও তিনি জানান।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে আবু হেনা রনি বলেন, ‘স্ট্যান্ড আপ কমেডি আমাকে জীবনে অনেক সাফল্য দিয়েছে। এখন বাংলাদেশকে সেই সাফল্যের অংশীদার করতে স্ট্যান্ড আপ কমেডিকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করছি।’
মিরাক্কেল ২০১২ সিজনে বাংলাদেশ থেকে যে সকল প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেছিলেন বা যারা স্ট্যান্ড আপ কমেডি করেন তারা সকলে মিলে বুনো পায়রা নামে একটি কমেডি ক্লাব গড়ে তুলেছেন। ৭টি বিভাগে এর শাখাও খোলা হয়ে গেছে।
রনি জানান, তারা চান এসব ক্লাবে এসে স্ট্যান্ডআপ কমেডি কিভাবে করতে হয় তার নিয়মকানুন জেনে শিখুক এবং বহু রনি বের হয়ে আসুক।
সবশেষে রনি বললেন, ‘স্ট্যান্ডআপ কমেডি আমাকে সুনাম, ভালবাসা ও অর্থবিত্ত সব দিয়েছে। এখন সারাজীবন এটাকে পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে সময় ব্যয় করতে চাই। (জাগো নিউজ)
নিউজ ডেস্ক : আপডেট ৫:২৬ পিএম, ২০ মে ২০১৬, শুক্রবার
এইউ
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur