বাংলাদেশে সরকারি বেসরকারি প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ শোনা যায়। সম্প্রতি একটি বেসরকারি ও একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক যৌন নিপীড়নের অভিযোগে শাস্তি পেয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ প্রকাশ্যে কম এলেও সাধারণ শিক্ষার্থী এবং ভুক্তভোগীরা বলছেন প্রকৃতপক্ষে এ সমস্যা আরো ব্যাপক।
চতুর্থ বর্ষে ছাত্রী থাকাকালীন পরীক্ষার খাতায় নম্বর নিয়ে জটিলতার কথা বলে এক ছাত্রীকে বাসায় ডেকে হয়রানি করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের সঙ্গে ফোনে কথপকথনের রেকর্ড রেখেছিলেন ছাত্রীটি যেটি ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে কাজ করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঐ ছাত্রী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “স্যার ফোন দিয়ে বললেন যে পরীক্ষার খাতায় আপনার কোয়েশ্চেন নাম্বারই নাই সো আপনার আনসারতো আমি একসেপ্ট করতে পারিনা। সেক্ষেত্রে আপনাকে জিরো দিতে হবে আমার। আমি আপনাকে জিরো দিতে চাইনা আপনি কী করতে পারেন আমার জন্য। পরে যেটা হয়েছে যে উনি যখন আমার কাছাকাছি আসলেন এবং আমাকে অ্যাপ্রোচ করার চেষ্টা করছিলেন, আমি বললাম যে স্যার আমি বাসায় যাব”।
এ ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে প্রথমে সাময়িক বরখাস্ত এবং দোষী প্রমাণিত হওয়ায় পরে গত বছর তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়।
ঐ ছাত্রী বলেন, “অনেক স্বপ্ন নিয়ে পড়ালেখা করতে গেলে আমারতো মার্কসটা একটা ইমপরট্যান্ট ফ্যাক্ট। ওই ভয়টা দেখালেতো স্টুডেন্টের আর কিছু করার থাকে না”
সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় আমার তিনিও নাম প্রকাশ করতে রাজী হননি। এ ছাত্রী জানান শিক্ষাসফরে গিয়ে বিভাগের শিক্ষকের অনাকাঙ্খিত আচরণের শিকার হন তারা কয়েকজন।
“স্যার একটা কমেন্ট করলো, এটা খারাপ উদ্দেশ্যে না ভাল উদ্দেশ্যে এটাতো আমরা বুঝি আমরাতো ছোট না। আর আমরা যখন বিচার চাইতে গেলাম তখন এরকম একটা ভাব যে রেপ হয়নি তার মানে বিচার হবে না। নিপীড়ন মানে কি শুধুই রেপ হওয়া”।
এই ছাত্রী জানান, ছোটখাট যৌন হয়রানির শিকার হলে মেয়েরা বলতে চায় না। আর অভিযোগ আনা হলে তার ব্যাখ্যা এবং প্রমাণে বহুভাবে হয়রানির শিকার হতে হয় মেয়েদেরকেই।
“শিক্ষকরা ক্লাসে এত খারাপভাবে বকা দিত যে শেষ পর্যন্ত একটা মেয়ে সুইসাইড করতে যায়। আমরা আটটা মেয়েই একই মানসিক কন্ডিশনে ছিলাম”।
সম্প্রতি বেসরকারি আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় ওই শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। সেখানকার শিক্ষার্থীরা বলছেন অনেক আগে থেকেই ওই শিক্ষক ছাত্রীদের হয়রানি করে আসছে কিন্তু নানামুখী চাপে মেয়েরা এগুলো প্রকাশ করেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দেবশ্রী বলেন, “অনেক সময় আমরা মেয়েরা এ ঘটনাগুলো নিজেরা চেপে যাই। কিন্তু আমাদের ভার্সিটিতে শেষ পর্যন্ত কয়েকটি মেয়ে যদি মুখ না খুলতো ওরা যদি না বলতো তাহলে আমাদের এ আন্দোলন সফল হতো না”।
২০০৯ সালে উচ্চ আদালতের একটি রায়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে বেশকিছু দিকনির্দেশনা দেয়া হয়। ওই নির্দেশনায় অনাকাঙ্খিত স্পর্শ, সরাসরি বা ইঙ্গিতে যৌন আবেদন, এরকম উক্তি বা মন্তব্য, ক্ষমতা ব্যবহার করে যৌন সম্পর্ক স্থাপন বা তার চেষ্টা, উত্যক্ত করা, পর্ণোগ্রাফী দেখানো, হয়রানির জন্য ছবি তোলা, ভিডিও করা, এবং প্রতারণার মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা এরকম ১২টি আচরণকে যৌন হয়রানি বলা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির মতো স্পর্শকাতর এ বিষয়টি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খোলামেলা আলোচনায় হলো কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে।
সানজানা নামে একজন জানান, “তুমিতো অনেক সুন্দর, তোমার চুলটাতো অনেক সুন্দর এই ধরনের কথাবার্তা কিন্তু টিচাররা বলে। আমাদের হয়তো শুনতে জিনিসটা একটু অবাক লাগছে কিন্তু টিচাররা কিন্তু এসমস্ত কথাবার্তা বলেন। একস্ট্রিম পর্যায়ে যখন যায়, সহ্যের বাইরে যখন যায় তখনই হয়তোবা আমরা এটা বলি”।
আরাফাত নামে একজন বলছিলেন, “আমরা দেখেও অনেক সময় এগুলো না দেখার ভান করি এটাই সমস্যা্”।
শিক্ষার্থী রাজুর প্রশ্ন যাদের কাছ থেকে আমরা শিখবো তারা যদি এমন করে তাহলে আমরা শিখবো কার কাছে। আমরা নৈতিকতা শেখার জায়গাটা কোথায়?
জিকুর মতে, “তাকানো অঙ্গভঙ্গী সবকিছুই থাকে ডিফারেন্ট। সেটা আমরা বুঝতে না পারলেও একটা মেয়ে খুব ভালভাবেই বুঝতে পারে”।
ফারজানা নামের একছাত্রীর কাছে এরকম হয়রানি শিকার হলে কোথায় অভিযোগ করবেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “এটি আমি জানিনা কিন্তু সেখানে গেলে যে কাজ হবে সেটার কোনো ইয়ে নেই যেহেতু টিচার”।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন রোধ কমিটি থাকলেও এই শিক্ষার্থীর মতো অনেকেই সেটি জানে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির প্রধান ডক্টর নাসরীন আহমাদ দাবি করেন, “আমরা সেই পরিবেশটা ক্রিয়েট করতে পেরেছি যাতে সে আমাদের কাছে অকপটে আসতে পারে আমাদের কাছে নির্দ্বধায় তার মনের কথাটা বলতে পারে”।
অন্যদিকে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি থাকার কথা থাকলেও সরকারি ৩৯টির মধ্যে ১০টি এবং বেসরকারি ৯২টির মধ্যে ৫৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি নেই।
জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, কমিটি যেখানে সেগুলো সক্রিয় নয়। “তারা যদি ঘটনাগুলো প্রকাশ করে শাস্তির আওতায় নিত তাহলে কিন্তু এটা কমে আসতো। আবার যার যে কানেকশন আছে, কারো পুলিশের সঙ্গে সম্পর্ক আছে যার কারো পলিটিক্যাল লিডারের সাথে সম্পর্ক আছে। কোনো না কোনো কানেকশন দিয়ে তারা কিন্তু এটা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে” ।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডক্টর শফিকুল ইসলাম বলেন,“ এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর, মানহানিকর অমার্যাদাকর এবং এটা বিকৃত রুচির পরিচায়ক বলে মনে করি। দুই একটা ঘটনা দিয়ে সব শিক্ষককে মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না”। (প্রতিবেদনটি করেছেন, আবুল কালাম আজাদ, বিবিসি)
: আপডেট ১১:৫৫ পিএম, ১২ মে ২০১৬, বৃহস্পতিবার
ডিএইচ