আদালত অবমাননার দায়ে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক-মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে অর্থদণ্ড দিয়েছেন আদালত। রায় ঘোষণার পর থেকে এই দুই মন্ত্রীর ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। সচিবালয় থেকে পাড়ার চা স্টল―সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে।
কিন্তু এই বিষয় নিয়ে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এবং তাদের আইনজীবীরা। পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর সাংবিধানিক রিভিউ করবেন কি না সেই বিষয়টি ভাবছেন তারা। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে কোনো নির্দেশনা আসলে রায় পর্যন্ত অপেক্ষা নাও করতে হতে পারে।
মন্তব্য জানতে চাইলে অভিযুক্ত মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘রিভিউ করব।’ আবার পরক্ষণেই বলেন, ‘এখনো আইনজীবীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হয়নি। তাদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেব।’ তার আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এখনো সিদ্ধান্ত নেইনি। পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে চিন্তা করব।’
খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম নিজে কোনো মন্তব্য না করে তার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে পরামর্শ দেন। এই মামলায় কামরুল ইসলামের আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, ‘দেখেন সরকার কী করে। আমি তো সরকার না। বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্য আমি করতে পারি না। আইনগতভাবে নানা গোলমাল আছে।’
রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আলোচিত এ মামলায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি অবশ্য সাংবাদিকদের বলেছেন, দণ্ড হলেও মন্ত্রিত্বে কোনো বাধা নেই। বিপরীতে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহবুব হোসেন বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী তার ক্যাবিনেটে দণ্ডপ্রাপ্ত কোনো সদস্য রাখবেন কি না এটা উনার বিষয়। তবে, দুই মন্ত্রীর উচিত পদত্যাগ করা। না হলে প্রধানমন্ত্রীকেই তাদের পদত্যাগে বাধ্য করা উচিত।
সম্ভাব্য চার পথ
পূর্ণাঙ্গ রায়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। রায় প্রকাশ পেলে রিভিউ আবেদন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কোনো দিকনির্দেশনা আসা। কিংবা দণ্ডিত মন্ত্রীদ্বয়কে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ঘোষণা। সম্ভাব্য এই চারটি পথকে সমাধান দেখছেন সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কোনো মন্ত্রিপরিষদ সদস্যের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রায় আসেনি। তাই এই বিষয়ে কোনো নজিরও বলতে পারছেন না অ্যাটর্নি জেনারেল, সাবেক আইনমন্ত্রীসহ বিশিষ্ট আইনজীবীরা।
সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের নয়া সভাপতি (এখনো দায়িত্ব নেননি) ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন রিভিউ আবেদনের বিষয়ে বলেন, ‘রিভিউ আবেদন হবে কি না তা নির্ভর করবে পূর্ণাঙ্গ রায়ের ওপর। রায় না দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।’
সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ বিচারপ্রার্থীকে রায় রিভিউ করার অধিকার দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘সংসদের যেকোনো আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে এবং আপিল বিভাগ কর্তৃক প্রণীত যেকোনো বিধি সাপেক্ষে আপিল বিভাগের কোনো ঘোষিত রায় বা প্রদত্ত আদেশ পুনর্বিবেচনার ক্ষমতা উক্ত (আপিল) বিভাগের থাকিবে।’
এ বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট আরিফ খান বলেন, ‘রিভিউ আবেদন যে কেউ করতে পারেন। তবে, সেই রিভিউ যুক্তিগ্রাহ্য কি না তা বিবেচনার এখতিয়ার একমাত্র আদালতের। কারণ রিভিউয়ে পূর্ববর্তী রায়ের এমন কোনো বিচ্যুতি দেখাতে হবে যাতে করে বিচারপ্রার্থী অবিচারের সম্মুখীন হয়েছেন।’
নিয়ম অনুযায়ী যে কোর্ট থেকে রায় হয় সেই কোর্টেই রিভিউ আবেদন করতে হয়। তবে, পূর্ণাঙ্গ রায়ে যদি মন্ত্রীদ্বয়ের আদালত অবমাননার কারণে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা থাকে তাহলে নতুন করে উদ্যোগের প্রয়োজন নাও হতে পারে।
এর বাইরে প্রধানমন্ত্রী নিজে থেকেই দণ্ডিত মন্ত্রীদ্বয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সংবিধানে ৫৮(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘প্রধানমন্ত্রী যেকোনো সময়ে কোনো মন্ত্রীকে পদত্যাগ করিতে অনুরোধ করিতে পারিবেন এবং উক্ত মন্ত্রী অনুরূপ অনুরোধ পালনে অসমর্থ হইলে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) রাষ্ট্রপতিকে উক্ত মন্ত্রীর নিয়োগের অবসান ঘটাইবার পরামর্শ দান করিতে পারিবেন।’
চতুর্থ বিকল্প হিসেবে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যে কোন দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যে কোন দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে।’
তবে, আইনজ্ঞদের মতে, যেকোনো উপায়ে দুই মন্ত্রী পার পেলেও নৈতিক জায়গাতে তাদের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে গেছে। এই দিক থেকে তাদেরকে এই পদ থেকে সরানো না হলে অথবা নিজেরা সরে না গেলে ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে খারাপ নজির হিসেবে থাকবে।
একটি বিকল্প চিন্তা
দুই মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ একজন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আপাতত তারা পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা করলেও সম্ভাব্য বিকল্প চিন্তা করে রাখছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই আইনজীবী বলেন, প্রথম দিনের শুনানিতে আদালত দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অবমাননার কথা তুলেছিলেন। কিন্তু রায়ের দিন দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিবেদনটিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এই জায়গায় ফাঁক দেখিয়ে রায়ের বিষয়ে রিভিউ চাইতে পারেন তারা।
তবে, এই বিষয়ে সবকিছুই নির্ভর করছে আদালতের রায়ের ওপর। তবে, প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে কোনো নির্দেশনা আসে তাহলে সেখানেই যবনিকাপাত ঘটতে পারে বহুল আলোচিত এই আদালত অবমাননা মামলার।
শপথ ভঙ্গের পরিণতি কী?
নিয়ম অনুযায়ী মন্ত্রীদের দায়িত্ব নেওয়ার আগে শপথ গ্রহণ বাধ্যতামূলক। মন্ত্রীরা তাদের শপথে ‘আমি . . . . . . .সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ (বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা) করিতেছি যে, আমি আইন অনুযায়ী সরকারি পদের কর্তব্য বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব।’
‘আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব;’
‘আমি সংবিধানের রক্ষণ সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব; এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহীত আচরণ করিব;’
এর আগে ২০ মার্চ প্রথম শুনানির দিন দুই মন্ত্রীর কাছে আপিল বিভাগ জানতে চেয়েছিলেন, আপনারা শপথ ভঙ্গ করেছেন, দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন এর পরিণতি কী? সে বিষয়ে কোনো সদুত্তর না দিয়ে ২৭ মার্চও নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন উভয় মন্ত্রী।
এই বিষয়ে আইনজ্ঞরা পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির মামলার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, আদালতে ৩০ সেকেন্ডের দণ্ডপ্রাপ্ত পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী প্রথমে পদত্যাগ করেননি। কিন্তু, পরবর্তীতে আরেকটি চ্যালেঞ্জিং রিটে গিলানিকে প্রধানমন্ত্রী পদের থাকার অযোগ্য ঘোষণা করেছিলেন সে দেশের আদালত।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিষয়ে মন্তব্যকারী ক্ষমতাসীন দলের দুই মন্ত্রীও যদি আদালতের রায়ের বিষয়ে সম্মান জানিয়ে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ না নেন তাহলে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের বিষয়ে রিট হতে পারে। সেখানে গিলানির ভাগ্যও বরণ করতে হতে পারে বলে আদালত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
প্রসঙ্গত…
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আপিল বিভাগের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর বিচার কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে প্রধান বিচারপতি এবং অ্যাটর্নি জেনারেলকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেন (৫ মার্চ) এই দুই মন্ত্রী। তার পরিপ্রেক্ষিতে, মন্তব্য করার কারণ দর্শানোর সুযোগ এবং দুই দফা শুনানির পর ২৭ মার্চ প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে সাত দিনের জেলের দণ্ড দেন আদালত। বাংলাদেশের ইতিহাসে দায়িত্বরত মন্ত্রীর দণ্ড পাওয়ার নজির এই প্রথম।
সূত্র : দ্য রিপোর্ট
||আপডেট: ০৪:১২ অপরাহ্ন, ২৮ মার্চ ২০১৬, সোমবার
চাঁদপুর টাইমস /এমআরআর
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur