‘গত চারটা বইমেলায় আমার ১১টা উপন্যাস বের হয়েছে। এর মধ্যে ২টা বইয়ের খরচ কোনোরকমভাবে উঠে আসলেও বাকিগুলো পুরোই ফ্লপ খাইছে। তাই চিন্তা করেছি এবার উপন্যাস বের করলে একটাই করবো সেটা হবে একটার মতো একটা।’
মনে মনে সব চিন্তা-ভাবনা করে বসলাম উপন্যাসটা লিখতে কিন্তু সমস্যা বাঁধলো গল্প নিয়ে। কি গল্প নিয়ে উপন্যাসটা লেখা যায়। গল্প যা-ই হোক তা যেনো ‘ছ্যাঁকা খাওয়া গল্প’ না হয়। কারণ আগের উপন্যাসগুলো লিখে যা বুঝলাম এখন আর মানুষ ‘ছ্যাঁকা খাওয়া উপন্যাস’ খায় না।
দরজা জানালা আটকে কাগজ আর কলম নিয়ে বসলাম। গভীর ধ্যানে বসলাম দেখি কোন গল্প মাথায় আসে কি না। নাহ আসছে না। ভাবলাম একটা সিগারেট ধরালে দেখি কোন গল্প কিনা, হ্যাঁ পেয়েছি। একটি লাশের আত্মকথন, কিন্তু লাশটা কি ছেলে নাকি মেয়ে, বৃদ্ধ নাকি টগবগে তরুণ, কোন মা নাকি শিশু। একটা কাজ করলে কেমন হয় লটারি করি যে কোয়ালিটির লাশের নাম উঠবে সেটা দিয়েই উপন্যাসটা লিখব।
লটারি করার দরকার নেই আপনি আমাকে নিয়ে উপন্যাস লিখেন।
দরজা জানালা বন্ধ ঘরে যুবতি একটা মেয়ের কেেণ্ঠ এমন আওয়াজ শুনে পেছনে তাকাতেই দেখি দাউদাউ করা আগুন গায়ে নিয়ে একটা মেয়ে স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
কোন কিছু চিন্তা না করেই হাতের কাছে একগ্লাস পানি ছিলো সেটা ছুঁড়ে মেরেছি। জানি যেই আগুন তাতে এক গ্লাস কেন ১০ গ্লাসেও নেভানো যাবে না। তাড়াহুড়ো করে এদিক এদিক তাকিয়ে দেখলাম আশেপাশে কোথাও পানি নেই। থাকবে কি করে আমি মনে হয় আমার ঘরে নেই। সবকিছু কেমন যানি অপরিচিত লাগছে। দামিদামি টাইল্স দিয়ে বাঁধানো একটা ঘর। ঘরের প্রতিটি কোনায় কোথায় ফুল দিয়ে সাজানো গোছান। দামিদামি সব ফার্নিসার। এক কথায় এটা একটা স্বর্গরাজ্য। এতো চাকচিক্যের মাঝে বিভোর হয়ে আমি পানির কথা ভুলেই গিয়েছি।
থাক আর পানি খুঁজতে হবেনা। আর পানি দিয়েও লাভ নেই।
কে তুমি?
আপনার উপন্যাসের নায়িকা।
নায়িকা মানে?
আপনিইতো একটু আগে বললেন একটা লাশের আত্মাহুতির গল্প নিয়ে উপন্যাস লিখবেন। আমি সেই উপন্যাসের নায়িকা পদপ্রার্থী।
তুমি আত্মহত্যা করেছ?
কি মনেহয় আপনার?
এইযে গায়ে যে আগুন দেখছেন। সে আগুন আমি নিজেই লাগিয়েছি।
কেন?
আগে কথা দিতে হবে আমাকে নিয়ে উপন্যাস লিখবেন কিনা?
কথা দিতে পারছি না, তবে তোমার গল্পটা যদি ভালো মনেহয় আমার কাছে তাহলে অবশ্যই।
হঠাৎই বাহির থেকে একজন “ইরা, ইরা” বলে ডাকছেন। ভেতর থেকে আগুনে ঝলসানো মেয়েটা “আসছি মা” বলে উঠলো।
তোমার নাম ইরা?
হ্যাঁ আমিই ইরা। আর যে মহিলাটি ডাকছেন উনি হচ্ছেন আমার মা। আমি এই ঘরের একমাত্র মেয়ে।
তা তোমার আত্মহত্যার কারন?
আজ থেকে ৩বছর আগের কথা। সবেমাত্র এস,এস,সি দিয়েছি, ৩মাস অবসর অনেক ঘুরে বেড়িয়েছি এই ৩মাস, একদিন টিভিতে দেখি আগামিকাল এস এস সির রেজাল্ট দিবে, মা অগ্রিম দোকান থেকে মিষ্টি আনিয়ে রাখলেন, রেজাল্টের দিন সবাই অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি কখন বাবা ফোন করে বলবে ইরা এ প¬াস পেয়েছে। দুপুর ২টার বাবার ফোন, মা কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে আসছেন আমার দিকে তখন আমার আর বুঝতে বাকি রইলনা ঘটনাটা আসলে কি? মনের দুঃখে আমার এই রুমে এসে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম।
এই রুমে মানে?
হ্যাঁ যে রুমে আপনি এখন বসে আছেন।
মা বাবার বড় স্বপ্ন ছিলো আমাকে নিয়ে, মেয়েকে ডাক্তার বানাবে। কিন্তু আমার একজনের কারনে সংসারের সবার স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলো অতএব এই একজনের আর বেঁচে থাকার অধিকার নেই। দড়িতে ঝুলে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করলেও বাসায় কোন ফ্যান না থাকাতে সেটা সম্ভব হলো না। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করবো।
তারপর?
তারপর আর কি? এই যে দেখছেন। প্রথমে বাসার কেউ টের পায়নি আস্তে আস্তে যখন ধুঁয়া পুরো বাড়ি ছড়িয়ে পড়ল তখন সবাই আমার দরজার কাছে এসে দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি। দরজাগুলো ছিলো রাঙ্গামাটির কাঠ দিয়ে তৈরি। বাবা যখন রাঙ্গামাটি ছিলেন তখন পাঠিয়েছেন।
কি করেন তোমার বাবা।
পুলিশ অফিসার।
বিশ্বাস করবেননা ভাইয়া, অনেক চেষ্টা করেছি বাঁচার জন্য। আগুনে পোড়া যে কতটা যন্ত্রণার সেটা তখন বুঝতে পেরেছি। তাছাড়া চিন্তা করেছি সামান্য একটা রেজাল্টের জন্য পরিবারের সবার চোখে পানি জড়ানোর কোন অধিকার নেই আমার। যতক্ষণে এটা বুঝতে পেরেছি ততক্ষণে আমার শরীরের ৮০ শতাংশই পুড়ে গেছে। পরে পাশের বাসার একজন বারান্দায় মই দিয়ে উঠে আমাকে উদ্ধার করেন হাসপাতালে নেয়ার পথেই. . .
আচ্ছা তোমার গল্পটা আমি মাথায় রাখলাম। কিন্তু এইটাদিয়েতো গল্প হয় উপন্যাস নয়।
তারপরেও চেষ্টা করবেন।
আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি এখন যাও তোমার মা অনেক্ষন ধরে তোমাকে ডাকছেন।
মেয়েটা চলে যাচ্ছে দেখে আমিও মেয়েটার পেছনে পেছনে ঘরের বাহিরে এসে দেখি আমি আমার বাসার উঠনে দাঁড়িয়ে আছি আর মেয়েটিকেও দেখছি না। কোথায় জেন হাওয়া হয়ে গেলো।
আবার আমার ঘরে এসে বসলাম কাগজ কলম নিয়ে, হাত কাঁপছে কপাল ঘামাচ্ছে মনে হচ্ছে মেয়েটা এই বুঝি আমার পেছনে এসে বলছে “আমায় নিয়ে লিখুন”
হাতমুখ ধুয়ে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে আগুন ধরাতে গিয়ে দেখি ম্যাচ নেই টেবিলে চেয়ার থেকে উঠে যখনই ম্যাচের জন্য ঘুরে দাঁড়ালাম দেখি একজন গর্ভবতী মহিলা আমাকে একটা ম্যাচ দিয়ে বলছেন এই নেও বাবা আগুন।
কে আপনি? এখানে কি চান।
আমাকে তুমি চিনবেনা। আমার নাম রাজিয়া। তুমি যে একটা উপন্যাস লিখবে ভাবছ, সেটা তুমি আমাকে নিয়ে লিখতে পারো।
তা আপনার আত্মহত্যার কারন?
মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আমি, বাবা-মা অনেক কষ্ট করে আমাকে বিয়ে দিয়েছে পাশের গ্রামে। স্বামীর সংসারে প্রথম ১বছর সুখে কাটলেও সমস্যা বাঁধে আমার প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়াতে। শ্বশুর শাশুড়ীর অনেক ভালো মানুষ, কিন্তু আমার স্বামীই একটু খারাপ ব্যবহার করতেন কটু কথা শুনাতেন। মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে সব সহ্য করেছি।পরের বছর আবারও মেয়ে হলো, তখন শুরু হলো শারীরিক নির্যাতন।এদিকে দু নাতিনকে নিয়ে ওনারা বেজায় খুশি,সারাদিন আদর আর খেলায় মাতিয়ে রাখতেন।পরের বছর আমি আবারও গর্ভবতী,আতঙ্কিত পুরো পরিবার।
কারন?
কারন আমার স্বামী বলেছেন এবার যদি মেয়ে হয় তাহলে আমাকে তালাক দিয়ে দেবে। জমানো কিছু টাকা নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার পরীক্ষা দেখেন এটাও মেয়ে। এখন আমার আত্মহত্যা ছাড়া আমি আর কোন পথ খুঁজে না পেয়ে ঝাঁপ দিলাম নদীতে।
ঝাঁপ দেয়ার পর কেন জানি মনে হলো আমার পেটের মেয়েটা বলছে, মা তুমি তোমার মনের কষ্টে আত্মহত্যা করছ এতে আমি বাধা দিবোনা কিন্তু তুমি তোমার ৩মেয়েকে হত্যা করার অধিকার রাখোনা। বিশ্বাস করো বাবা তখন অনেক চেষ্টা করেছি বাঁচার জন্য। তবে নিজের জন্য নয় আমার ৩মেয়ের জন্য শ্বশুর শাশুড়ীর জন্য আমার বাবা মায়ের জন্য, কিন্তু ততক্ষণে আমি নদীর গভীর অতলে। দুদিন পর আমার লাশ ভেসে উঠেছে এই ঘাটে।
এই ঘাটে মানে?
হ্যাঁ তুমি এখন যে ঘাটে বসে আছো।
আচ্ছা আচ্ছা আপনি এখন আসুন, দেখি আপনাকে নিয়ে লেখা যায় কিনা। তবে গল্পটা সুন্দর।
গল্প বলছ কেন বাবা, এটাতো বাস্তব।
হ্যাঁ বাস্তব। এবার আপনি আসুন।
আসি বাবা বলে মহিলাটি আবার নদীতে ঝাঁপ দিলে পানির ঝাপটা এসে আমার চোখে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে গায়ের জামাটা দিয়ে মুখ মুছে চোখ মেলে দেখি আমি আমার খাটের উপর বসে আছি।
কিছুই বুঝতে পারছিনা আমি। গল্পতো গল্পই, কিন্তু এখানে দেখি গল্পের মুখ্য চরিত্র গুলো আমার সামনেই ঘুরোঘুরি করছে। আমি স্বপ্ন দেখছি নাতো?
না আপনি স্বপ্ন দেখছেননা, স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি, ছোট সংসার সাজানোর স্বপ্ন, চারটা ডালভাত খেয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন। মা বাবা আর ছোট দুইটা ভাইবোনের মুখে হাসি দেখার স্বপ্ন।
কে আপনি।
আমি রাহুল।
আপনার মাথা কোথায়?
কেউ খুঁজে পায়নি। ট্রেনের চাপার রাস্তার সাথে মিশে গেছে।
তা আত্মহত্যার কারণ?
আপনি কীভাবে বুঝলেন আমি আত্মহত্যা করছি।
কারণটা বলুন। তবে সংক্ষেপে।
আচ্ছা, ঢাকা ভার্সিটি থেকে মাস্টার্স শেষ করে বহু জায়গায় চাকরি খুঁজেছি। সব জায়গায় একই কথা ঘুষ লাগবে। কেউ সরাসরি বলে কেউ একটু ঘুরিয়ে বলে। শিক্ষার দিক্ষার দিকে তাকিয়ে ছোট খাট কোন চাকরিতে এপ¬াই করিনি। শেষ যে ইন্টারভিউ দিয়েছি সেটা ছিলো একটা প্রাইভেট ব্যাংক। ভাইবা শেষ চাকরি মোটামুটি ও কে কিন্তু সমস্যা বাঁধলো টাকা নিয়ে। এক লাখ টাকা ওনাদের দেয়ার পরেও ওনারা আরো দু লাখ টাকা চেয়ে বসেছেন। বলেন এই দুলাখ টাকা না দিতে পারলে চাকরি হবে না। প্রথমে যে একলাখ টাকা দিয়েছি সেটা বাবার শেষ জমিটুকু বিক্রির টাকা। একদিকে সংসারে অভাব অন্যদিকে জমি বেচা। অফিস থেকে ১লাখ টাকা ফেরত নিয়ে মাথা নিচু করে চলে আসলাম। বাবাকে টাকাগুলো ম্যানিগ্রাম করে একটা চিঠি পাঠিয়েছি।
কি লিখেছেন চিঠিতে?
এটুকুই লিখেছি “বাবা আমি চাকরি থেকে অবসরে যাচ্ছি”
তারপর?
তারপর, বাড়ির কাছে এসেই ট্রেনের নিচে মাথা দেই। বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা, যখন ট্রেনটা আসছে তখন আমার কেন জানি মনে হয়েছে, আমার বাবা আমাকে বলছে “বাবা আমি যতদিন আছি তুই সংসার নিয়ে চিন্তা করিস না” মা বলছেন “কোথায়রে আমার রাহুল” ছোট ভাইটা বলছে “ভাইয়া আমি আর তুই মিলে গরু পালন করবো, তোর চাকরির দরকার নাই” ছোট বোনটা বলছে “ভাইয়া আমার বিয়ে নিয়ে তুমি চিন্তা করোনা” কিন্তু ততক্ষণে আমার এই দেহ আটটা ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে।
কাহিনী সুন্দর, শিক্ষিত লাশ।
আসেন ভাই আপনাকে ট্রেনে উঠিয়ে দেই।
না থাক আমি একাই উঠতে পারব। আপনি বরং আপনার মাথাটা খুঁজে বের করুন।
শিক্ষিত লাশটাকে বিদায় দিয়ে ট্রেনে উঠলাম। ট্রেনের ভিতরটা দেখতো ঠিক আমার ঘরটার মত। জানালা দিয়ে মাথা বের করে শিক্ষিত লাশটা দেখতে গিয়ে দেখি আমার উঠন ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। জানালা থেকে আমার মাথাটা বের করেই দেখি মুখে রক্ত নিয়ে একজন দাড়িওয়ালা মুরুব্বি আমার পেছনে।
কি দাদা আপনার চেহারা দেখেতো মনে হয় আপনি চাকরি হারিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
চাকরি হারায়নি, নিজে থেকেই অবসর নিয়েছি। আর আত্মহত্যাও করিনি।
তাহলে আপনার মুখে রক্ত কেন, বিষ খেয়েছেন?
না।
তাহলে আমার মনেহয় আপনি ইরার বাবা, মেয়ের শোকে বিষ খেয়েছেন।
না।
তাহলে নিশ্চই আপনি রাজিয়ার স্বামী, স্ত্রীর শোকে আত্মহত্যা করেছেন।
না।
ও আচ্ছা আসলে আমি আপনাকে চিনতে ভুল করেছি, আপনি হচ্ছেন রাহুলের বাবা। আমি এতক্ষণ আপনাকেই খুঁজছি, আপনার বয়সও বেশি অতএব কাহিনীও হবে লম্বা।
মুরুব্বি ঠাস করে আমার গালে একটা চড় বসিয়ে বললেন। আমি ইরার বাবা না, রোকেয়ার স্বামীও না আর রাহুলের বাবাও না। আমি তোর দাদা, তাছাড়া এগুলো রক্ত নয় এগুলো পানের পিক। মুরুব্বির চড় খেয়ে বাস্তবে ফিরে দেখি উনি আসলেই আমার দাদু।
কি হয়েছে তোর? সেই কখন থেকে তোর মা ভাত নিয়ে বসে আছে। তোর দেরি দেখে আমি খেয়ে পেলেছি। আমিতো ভেবেছি তুই ঘুমিয়ে আছিস, আয় খেতে আয়।
লেখক : দেওয়ান মো. কাউছার
|| আপডেট: ০৯:৪৩ পিএম, ২৮ নভেম্বর ২০১৫, শনিবার
এমআরআর