আমাদের টাকায় আমাদের সেতু ; বাংলাদেশের পদ্মাসেতু। পদ্মার দক্ষিণে দেশের ২১ টি জেলার ৩ কোটি মানুষের সাথে সুনিবিড় সম্পর্ক তৈরি করে দিয়েছে এ সেতু। পদ্মানদীর ওপর নির্মিত বলেই এর নাম ‘ পদ্মা সেতু ’ করা হয়েছে। প্রকৃতিগত ভাবেই হিমালয়ের উৎপত্তিকৃত ভারতের গঙ্গা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করায় এর নাম হয়ে যায় পদ্মানদী। ভারতের ফারাক্কা থেকে দৌলতদিয়া পর্যন্ত পদ্মানদীর দৈর্ঘ্য ১৮৫ কি.মি.। দৌলতদিয়া থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ১০২ কি.মি.। হিমালয় থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত পদ্মার দৈর্ঘ্য ২৮৭ কি.মি.। চাঁদপুর পানি বোর্ডের এক সূত্রে জানা গেছে- পদ্মানদী চাঁদপুর মোলহেড থেকে ২৩ কি.মি. মতলব উত্তরের এখলাছপুর নামক স্থানে মেঘনার সাথে মিলিত হয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মা একটি খরস্রোতা নদী।
১৮৯৪ সালের ডিসেম্বরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লিখেন, ‘ বর্ষার সময় পদ্মা আপনার সহস্র ফণা তুলে ডাঙ্গার উপর ছোবর মারতে মারতে , গর্জন করতে করতে, কেমন করে আপনার প্রকান্ড বাঁকা লেজ আছড়াতে আ্ছড়াতে, ফুলতে ফূলতে চলত, সেই দৃশ্যটা মনে পড়ে ..। ’ কত কবিতা, গানে, উপন্যাসে, গল্পে পদ্মা এসেছে তার মহিমা নিয়ে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম গানে ভাষায় লিখেছেন, ‘ পদ্মার ঢেউরে মোর শূন্য হৃদয়-পদ্মা নিয়ে যারে ..’। যা বাংলদেশের পল্লীগীতির জনক আব্বাস উদ্দিনের কন্ঠে গেয়েছেন ।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ৩ কোটি লোক বসবাস করে। বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াতের ক্ষেত্রে নানান সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে এ সমস্ত সমস্যা অনেকটাই ঘুচবে। দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল এবং ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সেতুর শেষ স্প্যানটি স্থাপন করে বাংলাদেশ সরকারের সেতু বিভাগ একটি বিশাল মাইলফলক অর্জন করেছে। সঠিক করে বলতে হলে বলা যায় – পদ্মা সেতু একটি নতুন পর্বের সূচনা করেছে। একটি একক রেলপথ থাকবে, যা মাওয়ার মুন্সীগঞ্জ থেকে জাজিরা এবং শরীয়তপুরকে সংযুক্ত করবে। পদ্মা সেতুর ফলে মংলা থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে এবং রেলপথ যোগাযোগ ব্যবস্থা সংযুক্ত হবে এবং এ বন্দরগুলো ঢাকা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে সরাসরি সংযোগ পেতে সহায়তা করবে।
পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল থেকে ঢাকায় পৌঁছতে কম সময় লাগবে। যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলের মানুষরা ১২-১৩ ঘন্টা ব্যয় করে ফেরি ও নৌকা দিয়ে নদী পার হতো শহরে আসতে। কখনো বৈরি আবহাওয়ার কারণে নদী পার হওয়াও বেশ কঠিন হয়ে যেত। তখন বন্ধ থাকত নদী পারাপার। এবার পদ্মা সেতুটি চালুর ফলে আর কাউকে বিরতি নিয়ে ভ্রমণ করতে কিংবা বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না। এখন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ভ্রমণে প্রায় ৩ ঘন্টা সময় কমে আসছে।
এ সেতু নির্মাণ হওয়ার ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলো ‘ ইকোনমিক জোন ’ হিসেবে সফলতা পেতে পারে। যেহেতু যাতায়াতে সময় এবং ভোগান্তি দু’টোই কমে আসছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি অঞ্চলের জন্য সাতটি বিশেষ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করা হয়েছে। চারটি খুলনা ও বাগেরহাটে, দুটি বরিশালে এবং একটি ভোলাতে। এ সমস্ত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে দেশি- বিদেশি সকল প্রকার বিনিয়োগ আনা হচ্ছে বা দ্বার উম্মুক্ত হলো ।
প্রতিবেশি দেশগুলো বিশেষ করে ভারত থেকে আরও বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা তৈরি হবে। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণে প্রায় বিরাট একটা ‘শিল্প বিপ্লব’ প্রত্যক্ষ করবে সমগ্র বাংলাদেশ। শুধু বাংলাদেশ নয় প্রতিবেশি দেশগুলোও এর সুফল ভোগ করবে। এতে দেশে বিনিয়োগ যে বৃদ্ধি পাবে তা অবধারিতভাবেই বলা যায়। বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতীম দেশ নেপাল, ভুটান এবং ভারতের উত্তর-পূর্ব দিকে কৃষিপণ্য ও অন্যান্য মালামাল পরিবহনও বেশ সহজ হবে। এখন পর্যন্ত মংলা এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর দিয়ে চলাচলের ফলে পরিবহন বাধার কারণে এ অঞ্চলে নগরায়ন এবং শিল্পায়ন তেমন একটা সমৃদ্ধ হতে পারেনি। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার সাথে সাথে প্রাথমিক বিদ্যুৎ সংযোগ সরবরাহ, বিভিন্ন ধরণের ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের রপ্তানিমুখী ব্যবসা বাণিজ্য তৈরি হবে।
পটুয়াখালী ও খুলনার মতো অঞ্চলে বড় বড় বন্দরগুলো আগে থেকেই উপস্থিতি রয়েছে। তাই পদ্মা সেতুর জন্য এটি নগরায়নের কেন্দ্রস্থল নি:সন্দেহে হতে পারে। পদ্মা সেতুর প্রভাব বেশ সুদূর প্রসারী। জন জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্র সকলেই এর সুফল পাবে। পদ্মা সেতু এমন একটি স্বপ্ন। প্রায় দু’ দশক ধরে বাংলাদেশের মানুষ দেখে যাচ্ছিলেন। এটি কেবল সেতু নয় বাংলাদেশের জন্য সুদিনের চাবিকাঠি।
বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা ২০০১ সালে পদ্মানদীর ওপর পদ্ম্া সেতু নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সকল প্রকার প্রস্তÍুতি সম্পন্ন করে মাওয়া-জাজিরা পদ্মার পয়েন্টে এ সেতু নির্মাণের স্থান নির্ধারণ করে সব্বোর্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ২০০১ সালের ৪ জুলাই তিনি পদ্মাসেতুর ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন।
নানা প্রতিকূলতার পরও পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজটি অনেকাংশে শেষ হয়েছে ২০২২ সালের জুনে এবং এটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় ২৪ জুন ২০২২। সব মিলিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করলে পদ্মা সেতু এ অঞ্চলের মানুষদের ভাগ্য বদলে দিবে। পদ্মা সেতুর ফলে মংলা থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে এবং রেলপথ যোগাযোগ ব্যবস্থা সংযুক্ত হবে ।
বাংলাদেশের সবচাইতে বড় সেতু পদ্মাসেতু এবং বিশে^ ১২২তম সেতু। পদ্মাসেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কি.মি. এবং প্রস্থ ১৮.১৫ মিটার। দু’পাশের সংযোগ সড়কের দৈর্ঘ্য ১২.১১ কি.মি.। এর মধ্যে মুন্সীগঞ্জের মাওয়ার অংশের দৈর্ঘ্য ১.৬ কি.মি. এবং শরিয়তপুর অংশের দৈর্ঘ্য ১.২৪ কি.মি.। নদী শাসন করা হয়েছে ১৪ কি.মি.।
ফলে জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে ১, ৪ শ ৭৪ হেক্টর। সড়কটি ৪ লেনে। পিলার ৪২টি। এর উচ্চতা দেশের প্রচলিত একটি ৪০ তলার ভবনের সমান। সেতু নির্মাণের যাছাই-বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছর। কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালে এবং শেষ হয় ২০২২ সালের জুনে। ২৫ জুন ২০২২ সালে বেলা ১২ টার সময় বাংলাদেশের মধ্যমনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাছিনা এর উদ্বোধন করেন।
পদ্মাসেতু নির্মাণে ৭শ প্রকৌশলী ও ১৭ হাজার শ্রমিকের ( ২০২২ -২০১৪ ) ৮ বছর সময় লেগেছে। এটি নির্মাণে ৩ লাখ ৯৭ হাজার ১শ ৬৮ মে.টন লৌহ , ৩২ লাখ ৩৭ হাজার ১’ শ ৩০ মিটার পাথর, ৬ লাখ ৮৫ হাজার ৮শ ১৯ মে.টন সিমেন্ট, ৮০ লাখ মে.টন কংক্রিট ব্লক এবং ১ কোটি ২০ লাখ ৯৭ হাজার ৯শ ১৪ টি ইট ব্যবহার করা হয়েছে। আমাদের নিজস্ব অর্থে নির্মাণ ব্যয়-৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। বাস্তবায়ন করে সেতু কর্তৃপক্ষ ও সেতু বিভাগ। সেতুর নিচ দিয়ে অনায়াসে ১৮.৩ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত যেকোনো জলযান যাতায়ত করতে পারবে। সেতু দিয়ে ১ শ ৬০ কি.মি বেগে যাত্রীবাহী ট্রেন এবং ১শ ২০ কি.মি .বেগে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলে রেলট্র্যাক স্থাপনের কাজ চলছে। প্রতিদিন উভয় দিকে ৮০ টি ট্রেন চলবে। পরিবেশ সুরক্ষায় ২০১২ সালে থেকে প্রায় ২ লাখ গাছ রোপণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ি থেকে মাওয়া এবং পাচ্চর থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কি.মি দীর্ঘ দৃষ্টিনন্দন দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে ।
পদ্মাসেতুর কারণে পাশ^বর্তী এলাকা, নদীতীরের মানুষের জীবনধারায় ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হতে শুরু করেছে । মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উন্নীত হওয়ার যে স্বপ্ন তা বাস্তবায়নে এ সেতু হবে অন্যতম চালিকাশক্তি। উন্নয়নের সোপান। স্বপ্নের এ সেতুকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ। তাই আমরা গর্বের সাথে বলতে পারি – আমাদের টাকায় আমাদের সেতু ; বাংলাদেশের পদ্মাসেতু। তথ্য সূত্র : সচিত্র বাংলাদেশ, সংখ্যা জুন ও সেপ্টেম্বর ২০২২ ।
লেখক : আবদুল গনি , শিক্ষক , প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক , চাঁদপুর টাইমস, চাঁদপুর । ১৪ এপ্রিল ২০২৩ ।
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur