উর্দু ভাষায় আম বয়ানের মধ্য দিয়ে তুরাগ নদীর তীরে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হয়েছে। বাংলাসহ কয়েকটি ভাষায় অনুবাদ করে শোনানো হয় এ বয়ান। জুমার নামাজের পর বয়ান করবেন মাওলানা ইসমাইল গুদর, আসরের পরে মাওলানা জুবায়ের আহমদ ও মাগরিবের পরে মাওলানা আহমদ লাট। এসব বয়ানের বাংলা অনুবাদ করবেন বাংলাদেশের মাওলানা ওমর ফারুক।
শুক্রবার ১৩ জানুয়ারি ফজর নামাজের পর বয়ান শুরু করেন পাকিস্তাানের মাওলানা জিয়াউল হক।
প্রথম পর্বের বিশ্ব ইজতেমা শুরুর আগের দিন (বৃহস্পতিবার) থেকেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে ইজতেমা ময়দান। মুসল্লিরা ময়দানে জায়গা না পেয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ফুটপাত ও মাঠের আশেপাশের খোলা জায়গায় অবস্থান নিয়েছেন। এদিকে একদিন আগে বৃহস্পতিবার ফজরের নামাজের পর থেকেই প্রাথমিক আ’ম বয়ান শুরু হয়েছে।
এবার ইজতেমায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের আলেমরা মূল বয়ান করবেন। তাবলিগের ৬ উসুলের এ বয়ান রোববার আখেরি মোনাজাতের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত চলবে। বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষা-ভাষীদের জন্য তাৎক্ষণিক তরজমা করা হয়। হেদায়েতি বয়ান শেষে আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে প্রথম পর্বের ইজতেমা শেষ হবে।
ইজতেমা আয়োজক কমিটির মুরুব্বি প্রকৌশলী মাহফুজ জানান,বুধবার থেকেই তাবলীগ মুসল্লিরা দলে দলে ইজতেমা ময়দানে এসে মাঠে নিজ নিজ খিত্তায় অবস্থান নিচ্ছেন। লাখ লাখ মুসল্লির উপস্থিতিতে ইজতেমা ময়দান পূর্ণ হয়ে গেছে। আখেরি মোনাজাতের পূর্ব পর্যন্ত মুসল্লিদের এ আগমন অব্যাহত থাকবে।
আজ শুক্রবার দেড়টার দিকে ইজতেমা মাঠে দেশের বৃহত্তম জু’মার নামাজ অনুষ্ঠিত হতে পারে। কাকরাইল মসজিদের মুরুব্বি মাওলানা জোবায়ের জু’মার নামাজে ইমামতি করবেন। ময়দানে আসা মুসুল্লিদের জমিয়ে রাখতে বৃহস্পতিবার ফজরের পর থেকে আ’ম বয়ান শুরু হয়। ঈমান-আমলের এ বয়ান শুনতে ইজতেমা ময়দানের মুসুল্লিরা মশগুল রয়েছেন।
ময়দানের পশ্চিমে তুরাগ নদীর পূর্ব পাশে নির্মিত মিম্বরে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ইমাম এবং উত্তর-পশ্চিমে বিদেশি মুসল্লিদের কামড়ার পাশে বয়ান মঞ্চে বয়ানকারী অবস্থান করবেন। আখেরি মোনাজাত বয়ান মঞ্চ থেকে পরিচালনা করা হবে। প্রায় ১ বর্গ কিলোমিটারের ইজতেমা মাঠকে বাঁশের খুঁটির ওপর চটের ছাউনির প্যান্ডেলে মুসল্লিদের বয়ান শোনার জন্য লাগানো হয়েছে বিশেষ মাইক। লাগানো হয়েছে পর্যাপ্ত বৈদ্যুতিক বাতি।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার কেচুয়া গ্রামের আব্দুল জব্বার জানান, জায়গা পেতে ঝামেলা হতে পারে ভেবে আগে দুইদিন আগেই চলে এসেছি। দুই বছর আগে গত ইজতেমায় মাঠে জায়গা না পেয়ে সড়কে বসতে হয়েছে। পৌষের হিমেল হাওয়া থাকলেও দুই বছর পর ইজতেমা অনুষ্ঠিত হওয়ায় তিনি আনন্দিত।
টাঙ্গাইলের সখিপুর উপজেলার বাসিন্দা আলমগীর হোসেন জানান, তিনি গত সাত বছর ধরে নিয়মিত ইজতেমা মাঠে আসেন। গত দুই বছর ইজতেমা আয়োজন বন্ধ থাকায় ঢাকায় আসা হয়নি। দুই বছর ইজতেমা বন্ধ থাকায় এবারের ইজতেমায় মুসল্লিদের উপস্থিতি বেশি হতে পারে ভেবে একদিন আগেই ময়দানে এসে অবস্থান নিয়েছে।
এবারের ইজতেমায় সাধারণ মুসল্লিরাও উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে আগেভাগেই অবস্থান নিয়েছে এবং অধিক সংখ্যক মুসল্লি হয়েছে। অনেকই মূল শামিয়ানার নিচে স্থান না পেয়ে সড়কের পাশে ফুটপাতে পলিথিন টানিয়ে অবস্থান নিয়েছেন।
আরব,ইউরোপসহ কয়েকটি দেশের মুসল্লিরাও ইতোমধ্যে ইজতেমা মাঠের বিদেশি মেহমানদের প্যান্ডেলে অবস্থান নিয়েছেন। বিদেশি তাবলিগ অনুসারী মুসল্লিদের জন্য মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণে আধুনিক সুবিধা দিয়ে আলাদা থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
জুবায়েরের অনুসারীদের মিডিয়া সমন্বয় কারী দায়িত্বে থাকা জহির ইবনে মুসলিম বলেন, সাথিরা সকাল থেকেই স্রোতের মতো আসতে শুরু করেছেন। আশা করছি এবার রেকর্ডসংখ্যক লোক হবে। এখানে বিদ্যুৎ, পানি, প্যান্ডেল তৈরি, গ্যাস সরবরাহ প্রতিটি কাজই আলাদা আলাদা গ্রুপের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। মুসল্লিরা তাবলিগ জামাতের শীর্ষ আলেমদের বয়ান শোনেন এবং ইসলামের দাওয়াতি কাজ বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দেওয়ার জন্য জামাতবদ্ধ হয়ে বেরিয়ে যান। বিদেশিরা ইজতেমা ময়দানের উত্তর-পশ্চিম পাশে অবস্থান নিচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন,সভাপতিহীন বিশ্ব ইজতেমার এতো বড় আয়োজন প্রতিবছরই অত্যন্ত সু-শৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন হয়। পুরো ইজতেমা ময়দানকে মুরুব্বিদের পরামর্শে সাজানো হয়। ময়দানে জেলাভেদে মুসল্লিদের অবস্থান, রান্না-বান্না করার স্থান, টয়লেট, অজুখানা, গোসলখানা সবই সুর্নিদিষ্ট করা থাকে।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) আনিসুর রহমান জানান, ৩০জন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে মোবাইল কোর্ট কাজ করবে। পুরো টঙ্গীজুড়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচরণ করবেন। ইজতেমা ময়দান ও আশেপাশের এলাকালায় ছিনতাই-পকেটমারসহ অপরাধ কার্যকলাপ রুখতে টহল টিমসহ থাকবে পর্যাপ্ত ওয়াচ টাওয়ার ও সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা।
টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাববধায়ক জাহাঙ্গীর আলম জানান, মুসল্লিদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য বিভাগ পাঁচটি ক্যাম্প করেছে। সেখান থেকে ২৪ ঘণ্টা বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে। এ হাসপাতালে ইজতেমা উপলক্ষে ৭টি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল মোতায়েন থাকবে। বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতি বছরের মতো বিন্যামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হবে।
গাজীপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আলমগীর মিয়া জানান, ৩১টি টয়লেট বিল্ডিং একসঙ্গে ৯ হাজার মুসল্লি ব্যবহার করতে পারবেন। ইজতেমা ময়দানের পশ্চিম পাশে তুরাগ নদীর ওপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ৫টি ভাসমান সেতু নির্মাণ করেছে মুসল্লিদের পারাপারের জন্য।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) আলমগীর হেসেন বলেন, ট্রাফিক বিভাগকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আব্দুল্লাহপুর থেকে ধীরাশ্রম একটা সেক্টর,মুন্নু গেইট থেকে কামারপাড়া ব্রিজ, কামারপাড়া ব্রিজ থেকে ভোগড়া চৌরাস্তা,ভোগড়া চৌরাস্তা থেকে তিনশ ফিট রাস্তা এবং চৌরাস্তা কোনাবাড়ী হয়ে ডাইভারশন রোড পর্যন্ত।
জিএমপি কমিশনার মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম জানান, ইজতেমা ময়দান ও আপফাশের এলাকায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পোশাকে ও সাদা পোশাকে দু পর্বে ১০ সহস্রাধিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্বে থাকবেন। জিএমপি’র পক্ষ থেকে ১৪টি কন্ট্রোলরুম বসানো হয়েছে। ওয়াচ টাওয়ার, ডগ স্কোয়াড টিম, মোবাইল পেট্টোল টিম, বম্ব ডিস্পোজাল টিম নৌ-পুলিশ ও র্যাবের হেলিকপ্টার টহল থাকবে। তারা ইজতেমার ভেতর-বাইরেসহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় অবস্থান করবেন।
১৩ জানুয়ারি ২০২৩
এজি