বিদ্রোহীকবি কাজী নজরুল ইসলাম মূলত: কোনো নির্দিষ্ট কাজে নিয়মিত না থাকলেও তার বিভিন্ন কাজের পরিবেশে বিভিন্ন অভিজ্ঞতায় বিদ্যমান ছিল। তিনি কবিতা,গল্প,উপন্যাস,প্রবন্ধ নাটক রচনা করেন। সবচাইতে বেশি লিখেন সংগীত। বাংলা সাহিত্যে নজরুলই সর্বাধিক গানের রচয়িতা ছিলেন। যার সংখ্যা ২ হাজার ৮শ’র মত ।
তিনি গানের রচয়িতাই ছিলেন না;তিনি ছিলেন একজন সুরশিল্পী ও কণ্ঠশিল্পী। বিপুল অবদান রয়েছে তাঁর সংগীতে। এরপরও বৃটিশ পরিচালিত হিজ মাস্টার ভয়েজ রেকর্ড কোম্পনী কাজ করার সুযোগ দেয় নি। তাহলে আর্থিকভাবে তিনি অনেক উপকৃত হতেন। নজরুল হাসির গানও রচনা করেন। তাঁর গানে ছিলো- বৈচিত্র্য বিলাসী।
তিনি সুরকার হিসেবেও প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেন এবং অর্থও প্রচুর আয় করেন। এসময় তিনি রেকর্ড বিক্রির একটি দোকানও খুলেন। এর নাম ছিল ‘কলগীতি’। যার ফলে তিনি একটি গাড়িও ক্রয় করেন। একসময় এসব শেষ হয়ে যায়। তাই অভাব-অনটন তাঁর কমেনি। তৎকালীন বই প্রকাশকগণ তাঁকে আর্থিকভাবে সবচেয়ে বেশি ঠকিয়েছেন। কবি নজরুল ১৯২৯ সালে রক্তকমল,মহুয়া ও কারাগার নাটকের গান রচনা করেন।
১৯৩১ সালে নজরুলের আলোয়া নাটকের অভিনেতাও হন। সিরাজ-উজ-দোলা নাটকেও রচনা করেন। এ জন্য তাকে অভিনেতাও বলা হতো। ১৯৩৮ সালের অক্টোবর মাসে কবি কলকাতা বেতারে যোগদান করেন। সেখানে গীতি নাট্য ও সংগীত চালাতেন। বেতারে তাঁর সঙ্গীত পরিচালকের পদ ছিল।
১৯৩২ সালে পুতুলের বিয়ে নাটকটি রচনা করে প্রকাশ করেন। ১৯৩৪ সালে তার ধ্রæব নাটকে তিনি অভিনয় করেন। ১৯৩৫ সালে পাতালপুরি চলচ্চিত্রে গীত রচনা করেন। মুক্তি পায় চলচিচত্র সাপুড়ে
১৯৩৯ সালে প্রমীলা নজরুল পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন। ১৯৪৯ সালে নজরুলের পুন:প্রকািশত নবযুগের প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৪১ সালের কবি সম্রাট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুতে তাৎক্ষণিক রবিহারা ও সালাম অন্তরবি কবিতাটি রচনা করেন। ব্রিটিশ আমলে কবি বিভিন্ন ছদ্মনাম ব্যবহার করে তাঁর রচিত কবিতা ও প্রবন্ধ পত্র-পত্রিকায় পাঠাতেন। ছদ্ম নামের মধ্যে ছিলÑকহলন মিত্র,সারথি,শ্যামসুন্দর, বনফুল পাইওনিয়া ও ধূমকেতু।
বিদ্রোহীকবি কাজী নজরুল ইসলামের চলচ্চিত্রে ও আলোকচিত্রে প্রবল ঝোঁক বা আকর্ষণ ছিল। কবিতা ও নানা লেখালেখির পাশাপাশি গানের সুর, সংযোজন হিসেবে কাজ করেছেন। অভিনয়ও করে না তিনি। তিনি চলচ্চিত্রে প্রত্যক্ষভাবে চিত্র পরিচালক গীতিগারি, সুরকার, কাহিনীকার,চিত্রনাট্যকার,অভিনেতা,গীতিকার গায়ক ও সংগঠক ছিলেন। ঠিক কখনও কোথাায় সর্বপ্রথম চলচ্চিত্র শুরু হয় তা জানা না থাকলেও ১৯৩১ সালে তৎকালীন ভারতবর্ষের কলকাতায় চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়।
১৯৩১ সালে তিনি কলকাতায় বিখ্যাত চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান ম্যাডান থিয়েটারর্সের যুবভান্ডারী নিযুক্ত হন। তাঁর দায়িত্ব ছিল শিশুদের কণ্ঠ হ্রাসআপ করা। তিনি চলচ্চিত্রের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে যুক্ত হন। তিনি নিউয়েটাার্স,পাইওনিয়ার ফিল্ম,কালী ফিল্ম, দেবদত্ত ফিল্ম,ফজলা ব্রাদাস চলচ্চিত্রে সম্পৃক্ত ছিলেন।
কবি নজরুলের চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে নারী বৃত্তি (১৯৩১), প্রহ্রাস গান ও সুর এবং ধ্রæব (১৯৩২) যুগ্ম পরিচালনা করেন ১৯৩৪ সালেÑগিরিশচন্দ্র ঘোষের কাহিনী অবলম্বে ‘ধ্রুব’ চলচ্চিত্রে কবি নারীদের ভ‚মিকা, অভিনয় করেন। ১৯৩৫ সালে পাতালপুরী সঙ্গীতে ১৯৩৫ পরিচালনা করেন। ১৯৬৬ সালে গ্রহের কব সঙ্গীত পরিচালনা, ১৯৮ সালে জল বাংলা অভিনয় ও গোরা সঙ্গীত পরিচালনা,বিদ্যবতী কাহিনী, ১৯৩৯ সালে সাপুড়ে, ১৯৪১ সালে নন্দিনী,১৯৪২ সালে চৌ-রাঙ্গগী সংগীত পরিচালনা, ১৯৪১-৪২ সালে শেরে বাংলা নামে টাইগার পিকাচর্স নামে বাঙালি মুসলিমানদের জন্য চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
১৯২৮ সালে গ্রামোফোন কোং নজরুল সঙ্গীত রচয়িতা ও প্রশিক্ষক, ১৯২৯ সালে বেতারের সান্ধ্যকালীন অধিবেশন ‘নারী’ কবিতাটি নিজ কণ্ঠে পরিবেশন করা হয়। তৎকালীন ধর্মীয় রক্ষণশীলদের আক্রমনের ভয়ে তিনি একটি ছবিতে‘স্বরস্বতী’তে’ ছদ্ম নাম ব্যবহার করেন। চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম ভারতীয় মহিলা সঙ্গীতে পরিচালক ছিলেন।
তথ্যসূত্র : মো.হাবিবুর রহমান রচিত ‘ছোটদের নজরুল,নবারূণ ও বাংলাদেশ সচিত্র মাসিক প্রত্রিকা,শেখ মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম রচিত-‘নজরুল জীবনের ট্য্রাজেডি’,ডা.আনিস আহমেদের সম্পাদনায় ‘কাজী নজরুলের জীবনী’ এবং ওয়েবসাইড থেকে সংগৃহীত ছবি) (১০ম পর্ব শেষ-চলবে আরও ক’টি পর্ব )
লেখক : আবদুল গনি,সাবেক শিক্ষক ,সাংবাদিক ও সাধারণ সম্পাদক, নজরুল গবেষণা পরিষদ ,চাঁদপুর । ১০ জুন ২০২১