দীর্ঘ ২৯ বছর পেটের ভেতর সুই, সুতা, টিস্যু ও গজ নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ফরিদগঞ্জের রেমিট্যান্স যোদ্ধা মো. মহসিন গাজী। নরক যন্ত্রণা ভোগ করে চলছেন তিনি ।
সৌদি আরবে চিকিৎসকদের ইচ্ছাকৃত ভুল চিকিৎসার বিষয়ে সহযোগিতা চেয়ে তা পাননি বাংলাদেশী দূতাবাস থেকে। বরং উল্টো তার বিরুদ্ধে দিয়েছে মিথ্যা তথ্য। তাকে সহযোগিতা না করে দূতাবাসের লোকজন মামলার কারণে জরিমানার মুখে পড়া চিকিৎসক ও তাদের কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করেছে।
এরকমই নানা বঞ্চনার কথা জানিয়ে সৌদি আরবে দায়েরকৃত মামলার জরিমানা আদায়ে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বর্তমান সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত এর কাছে সহায়তা প্রার্থনা করেছেন অসহায় মহসীন গাজী।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার গোবিন্দপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের নলডুগি গ্রামের বাসিন্দা মহসীন গাজী জানান, ১৯৮৭ সালে তিনি চাকুরির উদ্দেশ্যে সর্বস্ব বিক্রি করে সৌদি আরব যান। সেখানে দার আল হাসনা আহম্মদ আল গাতানীর অধীনে চাকুরিরত অবস্থায় ১৯৯২ সালে পেটের ব্যথাজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে সেখানকান ‘আবহা’ জেলার ‘আছির হাসপাতালে’ ভর্তি হন।
হাসপাতালের ডাঃ আলী সেহেরি, ডাঃ মোহাম্মদ ইয়াইয়া সেহেরি তার অ্যাপেনডিসাইটিজ অপারেশনের নামে তাকে অন্য অপারেশন করান বলে তিনি জানান। এ সময় তার ডান পাশ থেকে কিডনি ও বাল্ব তাদের দেশের অসুস্থ রোগীর সাথে বদল করে ফেলে এবং অপারেশনের পর পেটের ভেতর সুঁই, সুতা, গজ, টিস্যু ও ফরেন বডি রেখে দেয়। এর ফলে তিনি সুস্থ না হয়ে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাধ্য হয়ে ওই হাসপাতালে দীর্ঘ নয় মাস চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ না হওয়ায় কর্তৃপক্ষ তাকে দেশে ফেরৎ পাঠায়।
দেশে এসেও তিনি সুস্থতা অনুভব না করলেও সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে জীবিকার তাগিদে ১৫/০৮/১৯৯৫ তারিখে দ্বিতীয় বার সৌদি আরবে যান। সেখানে প্রায় ১ বছর তিনি কোনো কাজ করতে পারেন নি।
পেটের ব্যথা দিন দিন বাড়তে থাকায় ১৯৯৬ সালের রমজান মাসের ১১ তারিখে পুনরায় চিকিৎসার জন্যে রিয়াদ কিং খালেদ হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। সেখানকার ডাঃ দোহাইয়ান দ্বিতীয় অপারেশনেও ভুল করে পেটের ভেতর হতে ফরেন বডি গজ টিস্যু বের না করে হাসপাতাল থেকে বের করে দেন।
ওই সময়ে এই বিষয়ে রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানানোর পরও তারা এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। কিন্তু সৌদি আরবের নিয়মানুযায়ী দূতাবাস যদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তার পক্ষ হয়ে মামলা করতো ও সহযোগিতা করতো তাহলে ওই সময়ে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হতো অভিযুক্তরা। কিন্তু বাংলাদেশের দূতাবাস তা না করে ওই দেশের চিকিৎসকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আর্থিক সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সময় ক্ষেপণ করে। বরং রোগীরা মামলা করলে তার বিরোধিতা করে এবং তাদের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায় না।
মহসীন গাজী বলেন, ভাগ্যগুণে আমি অদ্যাবধি বেঁচে থাকলেও বেশির ভাগ রোগী এভাবে মারা যায়। পরবর্তীতে বেশ ক’বার মামলা করার পর সর্বশেষ গত ১৪/১১/২০১৪ সালে আভা জেলার আমির ফয়সাল বিন খালেদের অফিসে ডাক্তার আলী সেহেরী, ডাক্তার ইয়াইয়া সেহেরী ও ডাক্তার দোহাইয়ান এই তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করি (মামলা নং : ১২০১৭)।
মামলা করার পর মামলা পুনরায় তদন্তের জন্যে আমাকে খামিস মুসায়েত জেনারেল হাসপাতালে পাঠালে সেখানে ডাক্তাররা পরীক্ষা করেন। জেনারেল সার্জন ডাঃ ওয়াগি গান্নাম, ডাঃ জাওয়েদ মালিক, ডাঃ আহমদ আল কুয়ারনি, ডাঃ তুরকি আল বাসার এবং ডাঃ আহমেদ কামালের নেতৃত্বে মেডিকেল বোর্ড মিটিং করে রিপোর্ট দেন আমার পেটের ভেতর হতে ফরেন বডি, তাওয়াল, গজ, টিস্যু, ক্লিনিকস্ এগুলো বের না করায় সর্বদা ব্যথা হচ্ছে। পরবর্তীতে রিয়াদের আমির ফয়সাল বিন বান্দর অফিসের রিপোর্ট অনুযায়ী ১ম ও ২য় অপারেশন করা ডাক্তারদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করি। মামলাটি দীর্ঘদিন চলার পর তাদেরকে ২ লাখ রিয়াল জরিমানা করা হয়।
কিন্তু জরিমানা না দিয়ে তারা জোরপূর্বক অন্যায় অবৈধভাবে আমাকে দেশে পাঠিয়ে দেয়।
এ ব্যাপারে সেই সময় বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশস্থ সৌদি দূতাবাস কর্তৃপক্ষের সাথে সাক্ষাৎ করি। তারা সকল কাগজপত্র দেখে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করবে বলে আশ্বস্ত করে। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো কাজ করে নি।
আমি আমার মেডিকেল রিপোর্ট ও মামলার সকল কাগজপত্র ২৩/১০/২০১৬ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে, প্রবাসীকল্যাণ বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর জমা দিয়েছি। কিন্তু অদ্যাবধি কোনো সদুত্তর পাইনি।
মহসীন গাজী বলেন, আমরা প্রবাসে গিয়ে দেশের জন্যে রেমিটেন্স আনলেও আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। তিনি বলেন, শুধু তিনি নন, বিদেশে কর্মরত লাখ লাখ শ্রমিক এভাবে নির্যাতনের শিকার হলেও দূতাবাস ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সহযোগিতা করে না।
মহসীন গাজীর স্ত্রী সেলিনা আক্তার জানান, তার স্বামী গত ২৯ বছর ধরে ব্যথা নিয়ে প্রতিটি দিন পার করছেন। একবেলা ঔষধ না খেলে তিনি ব্যথার যন্ত্রণা সহ্য করতে পারেন না। দুই ছেলে দুই মেয়ে নিয়ে তার সংসার চালানো দুরহ হয়ে দাড়িয়েছে। দুই মেয়ে অনার্স মাষ্টাস পাশ করলেও তদবিরের অভাবে চাকুরি পাচ্ছে না।
প্রতিবেদক:শিমুল হাছান,২৯ এপ্রিল ২০২১
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur