চাঁদপুর টাইমস নিউজ ডেস্ক :
ওরা কারা? ভিডিওচিত্র ধারণ করে শিশুকে নৃশংসভাবে হত্যার সাহস ওরা পেলো কোত্থেকে? এই প্রশ্নটিই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সিলেটবাসীর মনে। ঠাণ্ডা মাথায় শিশুটিকে হত্যার পর লাশ গুম করার চেষ্টা, অন্যদিকে ভিডিও চিত্র ধারণ সবই যেনো পরিকল্পিত ঘটনা? ক্লিন মার্ডার বলতে যা বোঝায় তা। ছোট্ট একটি শিশুর ওপর এভাবে কেন নৃশংসতা চালালো তারা, কেনইবা হত্যা করলো তাকে? এমন জিজ্ঞাসা দিনভর ছিলো স্থানীয়দের মনে।
তবে অনুসন্ধানে খুনের কারণ হিসেবে যে ঘটনাটি সামনে এসেছে তা একেবারেই ‘তুচ্ছ’। সেদিন হত্যাকারীদের পার্টসের দোকানের সামনে রাখা একটি ভ্যানগাড়িতে হাত দেওয়ার ‘অপরাধে’ খুন করা হয় রাজনকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় সে ‘চোর’! অথচ ঘটনার দিন স্থানীয় সালুটিকর বাজারে সবজি বিক্রি করে বাড়ি ফিরছিলো সে। প্রায় প্রতিদিনই এমনটি করে রাজন। রমজান মাসে স্কুল বন্ধ থাকায় মা ছেলেকে সবজি বিক্রি করতে পাঠান বাজারে। অন্যদিনের মতো সেদিনও সবজি বিক্রি করতে গিয়েছিলো সে, আর ফিরে আসেনি।
অপরাধ ভ্যানগাড়িতে হাত
ভ্যানগাড়িতে হাত দেওয়ার অপরাধে চোর আখ্যা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় রাজনকে। আর তাকে ‘চোর’ আখ্যা দিয়ে আটক করে চৌকিদার ময়না মিয়া। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাশ্ববর্তী ‘খান ওয়ার্কশপের’ এক কর্মচারি জানান, ঘটনাটি ঘটে সেদিন সকাল ৯টায়। তার দাবি, মা মটরপার্টসের দোকানের সামনে একটি ভ্যানগড়ি রাখা ছিলো, ছেলেটিকে (শেখ সামিউল আলম রাজন) তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চৌকিদার ময়না তাকে আটক করে মারধর করে মুহিতের মোবাইলে ফোন করে। মুহিত ছেলেটির হাত পা ভেঙে ছেড়ে দিতে বললে চৌকিদার তার অপর ভাই আলীকে ফোন করে। আলী সৌদি প্রবাসী ভাই কামরুলকে নিয়ে ঘটনাস্থলে আসে। একই সময়ে ঘটনাস্থলে আসে তাদের অপর ভাই শামীম। এরপর রাজনের উপর শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন। চুরির অভিযোগ এনে তাকে পেটোতে থাকে কামরুলসহ অন্যরা। ভিডিওটি ধারণ করে আলীর দোকানের এক কর্মচারী।
যেভাবে ইন্টারনেটে হত্যাকাণ্ডের ভিডিও
নিজের বাহাদুরি জাহির করতে সৌদি প্রবাসী এক বন্ধুকে নোকিয়া সি-ফাইভ সেটে ধারনকৃত ভিডিওটি হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে পাঠায় কামরুল। ঐ বন্ধু সেটি ইন্টানেটে আপ করলে এলাকাবাসীর নজড়ে আসে। অন্যদিকে এলাকাবাসীর হাতে আটক মুহিত পুলিশের কাছে হত্যাকাণ্ডের সাথে তার সম্পৃক্ততা স্বীকার করে। মুহিতের দেওয়া তথ্য অনুযায়ি জালালাবাদ থানার এস আই জাকির হোসেন তাদের বাড়ি থেকে ঘটনার পরদিন ভিডিওচিত্র ধারনকরা মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করেন। মোবাইলটি এখন জালালাবাদ থানায় রয়েছে।
পুলিশের অবহেলায় পালিয়েছে আসামী!
পুলিশের অবহেলাতেই রাজন হত্যাকারীরা পালিয়েছে বলে দাবি করেছেন এলাকাবাসী ও রাজনের পরিবারের সদস্যরা। তাদের দাবি, পুলিশ প্রথমে মামলাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিতের চেষ্টা করে। একটি অপমৃত্যু মামলা সাজিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। আর এ কারনেই মামলার অন্য আসামীরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
নিহত শিশু রাজনের পিতা সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাদেআলী গ্রামের মাইক্রোবাস চালক শেখ আজিজুর রহমান জানান, আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি আমার ছেলের খুনি কামরুল সৌদী আরব পালিয়ে গেছে। সে সৌদী প্রবাসী ছিলো। ঘটনার পরদিনই সে পালিয়ে যায়।
আজিজুর রহমান বলেন, মুহিত গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই অন্য খুনিরা আমাকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। তারা বলছে- ‘তোর ছেলেরে মারছি। অখন তোরে মারিফালাইমু।’
সিলেট জালালাবাদ থানার ওসি আক্তার হোসেন জানান, কামরুল সৌদী আরব পালিয়ে গেছে বলে তিনি শুনেছেন। তবে নিশ্চিত হতে পারেন নি। এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। ইমিগ্রেশনকেও কামরুলের ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
ফাঁসির দাবিতে অপরাধীদের ছবিসংবলিত পোষ্টার
রাজন হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে সিলেটে পোষ্টারিং করা হয়েছে। ‘ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই-রাজন হত্যার বিচার চাই’ শিরোনামে করা হয়েছে পোষ্টারটি। এতে বিভৎস নির্যাতনের ছবি, লাশ গোম করার চেষ্টার ছবি এবং হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত চারজনের ছবি দেওয়া হয়েছে। এলাকাবাসীর দাবি, হত্যাকারীদের সনাক্ত করতে এবং হত্যাকারীরা যেনো পার পেয়ে না যায় সেজন্য এই পোস্টরিং করা হয়েছে।
আলী, বিএনপি থেকে আওয়ামীলীগে
সিলেটে শিশু রাজন হত্যা মামলার অন্যতম আসামী আলী। শহরতলীর কুমারগাও এলাকায় আলীর ৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। মা মোটর ওয়ার্কশপ, মা মটর পার্টস এবং তিনকন্যা রেষ্টুরেন্টের মালিক তিনি। যে পার্টসের দোকানের সামনের ভ্যানগাড়িতে হাত দেওয়ার অপরাধে রাজন খুন হয় সেই পার্টসের দোকানের মালিক এই আলী। তিনি একজন সুযোগ সন্ধানী মানুষ। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, এতকাল বিএনপির রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বিএনপি ছেড়ে আওয়ামীলীগে যোগদেন আলী। স্থানীয় দুই আওয়ামীলীগ নেতার হাতে ফুল দিয়ে সিলেট সদর উপজেলা বিএনপির প্রচার সম্পাদক আলী যোগ দেন আ’লীগে।
মুহিত, শামীম ও কামরুল তার আপন ভাই। কামরুল সৌদি আরবে থাকে। বিগত ৬ রমজান ৩ মাসের ছুুটিতে সে বাড়িতে আসে। মুহিত ও শামীম আলীর সাথে তার ব্যবসা দেখা শোনা করে।
সেদিন হত্যাকাণ্ডের পর লাশ বস্তায় ভরে গুম করতে গিয়ে জনতার হাতে ধরা পড়ে মুহিত। স্থানীয়রা তাকে আটকের পর পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
পুলিশের টিম গঠন, এলাকাবাসীর আল্টিমেটাম
শিশু রাজনের খুনিদের ধরতে প্রশাসনের প্রতি ১২ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে এলাকাবাসী। রোববার রাতে সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাদেআলী গ্রামে নিহত রাজনের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ সমাবেশে এলাকাবাসী এ আল্টিমেটাম দেয়। ১২ ঘন্টার মধ্যে সকল খুনিরা গ্রেফতার না হলেতারা সিলেট অচল করার মতো কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা দেয়।
রবিবার রাত ১১ টায় বিক্ষোভ সমাবেশে এলাকার মুরব্বী আশরাফ চৌধুরী, নিজাম উদ্দিন, আবদুজ জহিরসহ অন্যান্য বক্তারা অভিযোগ করেন, দিনে দুপুরে একটি শিশুকে এভাবে নির্যাতন ও হত্যার পরও পুলিশ তাদের সক্রিয়তা দেখাচ্ছে না। তবে এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ বলেন, আসামীদের ধরতে পুলিশ সব চেষ্টা করছে।
এদিকে, হত্যাকারীদের গ্রেফতারে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ একটি টিম গঠন করেছে। রোববার রাতে মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার রহমত উল্লাহকে প্রধান করে এই কমিটি গঠন করা হয়।
এদিকে, রবিবার রাতে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার কামরুল আহসান। এসময় তিনি স্থানীয়দের সাথে কথা বলে হত্যাকারীদের গ্রেফতারে পুলিশ তৎপর রয়েছে বলে জানান।
রাজন নেই বিশ্বাস হচ্ছেনা পিতা-মাতার
রাজন নেই-একথা বিশ্বাস হচ্ছেনা তার পিতা-মাতার। চতুর্থ শ্রেণী পড়–য়া তাদের ছেলে মারা গেছে এ কথা মানতে পারছেন না তারা। কারো সাথে তাদের শত্র“তা নেই। তাহলে কেন খুন হতে হলো রাজনকে-এমন প্রশ্ন রাখেন আজিজুর রহমান আলম।
আলম বিএনপি নেতা কর্নেল (অব) আলী আহমদের গাড়ি চালক। ড্রাইভিংয়ের পাশাপাশি বাদেআলী এলাকায় সবজি চাষ করে তা বিক্রি করে পরিবারের চাকাকে গতিশীল রেখেছেন তিনি। তার দুই সন্তানের মধ্যে রাজন ছিলো বড়। অপর সন্তান রাব্বি আলম সাজনের বয়স (৮)। বাবার কাছে সাজন বার বার জানতে চায়, তার ভাই কোথায়? কোনো উত্তর দিতে পারেন না তিনি।
আলম বলেন, আমরা গরীব। তবে আমরা চোর না। অথচ এই অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হলো আমার ছেলেকে। আমি বিচার চাই। হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।
আপডেট : বাংলাদেশ সময় : ০৫:০৪ অপরাহ্ন, ২৯ আষাঢ় ১৪২২ বঙ্গাব্দ, মঙ্গলবার ১৪ জুলাই ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ
চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/এমআরআর/২০১৫
চাঁদপুর টাইমস ডট কম–এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, আলোকচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করা বেআইনি