গত বছরের নভেম্বরে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্ন্নাতকোত্তর শেষ করেছেন তারেক মাহমুদ। অনার্স শেষ করার পরই চাকরি যুদ্ধে নামেন তিনি। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি নিয়োগ পরীক্ষা দিয়েছেন। বিসিএস-এর প্রস্তুতির জন্য কোচিং করেছেন এক বছর। চাকরি যুদ্ধে মাহমুদের সব চেষ্টা ছয় মাস ধরে থমকে আছে করোনার কারণে। শহর ছেড়ে অবস্থান করছেন গ্রামের বাড়িতে। কৃষি নির্ভর পরিবারের বড় সন্তান মাহমুদ এখন নিজেকে বোঝা মনে করছেন পরিবারের জন্য।
শওকত হোসেনের স্নাতকোত্তর শেষ হয়েছে বছর দেড়েক আগে।
নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছেন দেড় বছর ধরে। ভেবেছিলেন একটা চাকরি হয়ে যাবে শিগগির। কিন্তু করোনাকালে একরাশ হতাশা নিয়ে এসেছে শওকতের জন্য। রাজধানীতে মেস ভাড়া দিয়ে থাকা শওকত এখন দুশ্চিন্তা নিয়ে দিন পার করছেন রাজশাহীর গ্রামের বাড়িতে।
শুধু কি মাহমুদ আর শওকত। তাদের মতো লাখো শিক্ষিত তরুণের অসহায় সময় কাটছে। কঠিন পরিস্থিতি নিগূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি তারা। এমনতিতে দেশের চাকরি যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে একটি চাকরি জুটানো ভাগ্যের বিষয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করে তরুণদের রীতিমতো যুদ্ধে নামতে হয় চাকরির জন্য। এমন অবস্থায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে থেমে যায় সব ধরনের নিয়োগ। ধ্বস নামে বেসরকারি চাকরিতে। অন্যদিকে চাকরিরত অনেকে বেকার হয়েছেন এই সময়ে। এমন পরিস্থিতিতে চাকরির বাজারে নতুন আসা তরুণদের সামনে বড় এক চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হয়েছে। সামনে কখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়, কখন চাকরির বাজার আগের অবস্থায় ফিরে এই অপেক্ষায় লাখো শিক্ষিত চাকরি প্রার্থী।
এক সংকটের সঙ্গে আরেক সংকট যুক্ত হয়ে দেশের শিক্ষিত তরুণ সমাজের সামনে যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে তা নিয়ে শঙ্কিত দেশের সমাজ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সামনে তরুণদের কথা চিন্তা করে সরকারকে কর্মসংস্থানমুখী প্রকল্প হাতে নিতে হবে। একইসঙ্গে প্রয়োজনে ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (অউই) যৌথ প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের উপর করোনা মহামারির প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। একদিকে কারো চাকরি হারানোর ভয় অন্যদিকে চাকরিতে নিয়োগ পাওয়া হতাশার মাঝে এক বিভাজন সৃষ্টি করে। কঠিন সময়ের মাঝেও বেকারত্বের প্রকোপ বাড়তে থাকে। কারো একটি চাকরি হারানোর ফলে নতুন একটি চাকরি পাওয়ার প্রহর গুণতে হচ্ছে। আইএলও বলছে, বেকারত্ব বাড়ছে এমন ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ১২তম।’ বিশ্ব পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। বর্তমানে মোট বেকারত্বের মধ্যে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা সব থেকে বেশি। ডিগ্রি লাভ করার পর মানসম্মত চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত বেকারই থেকে যাচ্ছে। এর মধ্যে পাবলিক, প্রাইভেট, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেশি। লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্সের তথ্য মতে, ‘শিক্ষিত বেকারের হার সব থেকে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার।
সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস’র গবেষণায় দেশে মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তরুণদের এক-তৃতীয়াংশ পুরোপুরি বেকার বলে যে তথ্য উঠে এসেছে তা উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। গবেষণায় দেখা যায়, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। বাকিদের মধ্যে ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ সার্বক্ষণিক চাকরিতে, ১৮ দশমিক ১ শতাংশ পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক কেএএস মুর্শিদের নেতৃত্বে একটি দল ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সের শিক্ষিত তরুণদের নিয়ে ফেসবুক ও ই-মেইলের মাধ্যমে এই অনলাইন জরিপ পরিচালনা করেছে
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বর্তমানে দেশে কতোসংখ্যক শিক্ষিত বেকার রয়েছে তার নির্দিষ্টি কোনো পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। তবে জেনারেলি ১৩ শতাংশের কথা আমরা বলেছিলাম। এই সময়টা একেবারেই সংকটের সময়। এই সময়টাতে যারা শিক্ষিত তাদের জন্য, এমনি জব মার্কেটকে আমরা যদি একটি পিরামিডের মতো চিন্তা করি তাহলে দেখবো- আমাদের দেশে নিচের দিকে যতো জব আছে উপরের দিকে সেভাবে জব ক্রিয়েট হয় না। আর এখন ক্রাইসিসের কারণে এই পিরামিডটা আরো সরু হয়ে গেছে। ফলে উপরের দিকে আরো সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। তবে এখন যদিও নতুন করে আবার কাজ শুরু হচ্ছে কিন্তু সেটা যতোটা না নিচের দিকে কাজ সৃষ্টি করছে উপরের দিকে ঠিক ততোটা কাজ সৃষ্টি করছে না। উপরনু্ত এখন সবাই এক ধরনের কস্টকাটিং লিবারে আছেন। এটা প্রাইভেট সেক্টর এবং সরকারের ভেতরেও আছে। তারাও এখন লোক কম নিয়ে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে কীভাবে কাজ করা যায় সেই চিন্তা করছে। এটা মার্কেটকে আরো সঙ্কুচিত করে দেবে। যারা বেকার এটা তাদের জন্য আরো দুশ্চিন্তার কারণ। এই অবস্থায় সরকারের কর্মসংস্থান সহায়ক যে সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড রয়েছে। যেগুলো বাজেটের ভেতরে নেয়া আছে, নতুন করে নয়। বাজেটে নেয়া কর্মকাণ্ডগুলোই যদি আরো বাড়ানো যায়- যেটা এই সংকটকালেও দরকার, আবার কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করতে পারে।
এর মধ্যে হতে পারে গ্রামীণ অবকাঠামো, স্থানীয় পর্যায়ে অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প নেয়া- এতে নিচের দিকে এবং উপরের দিকেও প্রচুর কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এছাড়া স্বকর্মসংস্থানেও যদি কেউ যেতে চায় সেক্ষেত্রে ঋণের ব্যবস্থা করার কথা ছিল কিন্তু সেগুলো দেয়া হচ্ছে না বিভিন্ন রকমের কারণ দেখিয়ে। এই জায়গাগুলোতে সরকারের ভূমিকা নেয়ার সুযোগ আছে। আরেকটি বিষয় হলো যে, দেশের মানুষের যদি চাহিদা বাড়ে, আয় বাড়লে তখন সে জায়গাতে বিভিন্ন শিল্প খাতে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তবে সেটা বেশকিছুটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ফলে এখন যে সময়টা যাচ্ছে এটা শেষ হলেও শিক্ষিত যারা তাদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একটা বড় সময় অপেক্ষায় থাকতে হতে পারে। এই সময়টাতে যেসব বিকল্প কিছু কাজের চাহিদা বাড়ছে- আইটি বেইজ, মার্কেট সার্ভিস, হোম ডেলিভারি, ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টর, হেল্থ সেক্টরসহ এই ধরনের কর্মক্ষেত্রে কাজের সুযোগ বাড়ছে; সেগুলোর জন্য তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রস্তুত হতে পারে। মধ্যবর্তী সময়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রস্তুত থাকা যাতে পরবর্তীতে চাহিদা মোতাবেক অ্যাপ্লাই করতে পারে।
সিপিডি’র সম্মানীত ফেলো বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এই মুহূর্তে দেশে প্রতি চারজনে একজন যুবক বেকার এবং প্রতি তিনজনে একজন শিক্ষিত যুবক বেকার। অর্থাৎ যে যতো শিক্ষিত সে ততো বেকার থাকছে। এই সময়ে দেশের যুবসমাজ একটা অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে পড়েছে। কারণ আগেই তাদের কর্মসংস্থানের বাজার অনেক দুর্বল ছিল এখন করোনা মহামারির পরে কী হবে আমরা জানি না। আমি খুবই জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করছি বারবার যে, এই যুবসমাজের জন্য একটি অবশ্যই বেকার ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি এদের জন্য সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা না করি তাহলে বাংলাদেশে গত ১০ বছরে সরকারের যে বড় অর্জন সেটি দুর্বল হয়ে যাবে। এজন্য কর্মসংস্থান একটি বড় বিষয়। এদিকে মনোযোগ দেয়া খুবই জরুরি। (মানবজমিন)