১৯১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পদ্মার ভাঙনে পড়েছে মোট ১ হাজার ৭৪৯ বর্গকিলোমিটার। আর পলি পড়ে গড়ে উঠেছে ১ হাজার ৩১৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা। দুর্বল ও অপরিণত মাটির কারণে সবচেয়ে বেশি ভেঙেছে মাওয়া, শরীয়তপুর ও চাঁদপুর। এ বছর তো বটেই, ১০৫ বছর ধরে পদ্মাপারের মানুষ সবচেয়ে বেশি ভাঙনের শিকার হয়েছে। (প্রথম আলো)
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশবিষয়ক সংস্থা নাসা এক গবেষণায় জানিয়েছিল, ১৯৬৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে ৬৬ হাজার হেক্টরের (প্রায় ২৫৬ বর্গমাইল বা ৬৬০ বর্গকিলোমিটার) বেশি এলাকা পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে, যা ঢাকা শহরের আয়তনের প্রায় আড়াই গুণের সমান। প্রতিবেদনে পদ্মাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ নদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আর গত ডিসেম্বরে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান সাময়িকী স্প্রিংগার নেচার ১০৫ বছরে পদ্মার ভাঙন নিয়ে আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ১৯১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ে পদ্মার ভাঙনের শিকার হয়েছে এর দুই পারের ১ হাজার ৭৪৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা। আর পলি পড়ে গড়ে উঠেছে ১ হাজার ৩১৬ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ এই সময়ে ভাঙাগড়ার খেলায় পদ্মাপারের মানুষ ৪৩৩ বর্গকিলোমিটার ভূমি হারিয়েছে।
স্প্রিংগার নেচার–এর গবেষণাটির দলনেতা অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আশরাফ দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মতো বিশাল দুটি নদী অববাহিকার পানি পদ্মার মতো একটি সরু নদী দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে। আর মাওয়া থেকে শরীয়তপুর পর্যন্ত পদ্মার যে শাখাটি তৈরি হয়েছে, তা বড়জোর ২০০ বছর আগের। আর এর দুই পাশের ভূখণ্ড অনেক অপরিণত ও দুর্বল মাটি দিয়ে গঠিত। ফলে বর্ষার সময় পানিপ্রবাহ বেড়ে গেলেই সেখানে ভাঙন বেড়ে যায়। আর এ ধরনের
একটি নদীর ভাঙন সামলাতে প্রতিবছর যেভাবে বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা–ও সঠিক পদ্ধতি নয়। সামগ্রিকভাবে পুরো নদীর পানি ও পলির প্রবাহের ধরন এবং দুই পাড়ের মাটির গঠনকে বিবেচনায় নিয়ে ভাঙনরোধে উদ্যোগ নিতে হবে।
গবেষণাটির সঙ্গে যুক্ত গবেষকেরা বলেন, পদ্মায় প্রতিবছর ১৭ বর্গকিলোমিটার ভাঙে, আর ১৩ বর্গকিলোমিটার গড়ে। সেই হিসাবে বছরে আমরা চার বর্গকিলোমিটার জমি হারাচ্ছি।
স্প্রিংগার নেচার সাময়িকীর গবেষণায় দেখা গেছে, ১০৫ বছরে ৪৩৩ বর্গকিলোমিটার জমি হারিয়েছে পদ্মাপারের মানুষ
এত বেশি ভাঙনের কারণ হিসেবে গবেষণাটিতে মূলত বন্যা ও বন্যার সঙ্গে আসা বিপুল পরিমাণ পলিমাটিকে দায়ী করা হয়েছে। একই সঙ্গে পদ্মা নদীকে শাসন করতে গিয়ে এর দুই পারে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে, অর্থাৎ বাঁধ দেওয়া হয়েছে। সেগুলো
নদীর সঙ্গে মূল: ভূখণ্ডের প্লাবনভূমির সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। ফলে বন্যার সঙ্গে আসা পলি প্লাবনভূমিতে ছড়িয়ে না পড়ে, নদীর বুকেই জমা হতে থাকে। যে কারণে নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে বন্যা ও ভাঙনের পরিমাণ বাড়ছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, পলির কারণে পদ্মার বুকে চারটি বড় চর তৈরি হয়েছে। শরীয়তপুর, চাঁদপুর, ফরিদপুর ও মাদারীপুরের কাছে ওই চরগুলো বন্যার পানিপ্রবাহে বাধা পায়। ফলে পানি বঙ্গোপসাগরে দ্রুত নামতে বাধা পেয়ে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়। একই সঙ্গে চরে বাধা পেয়ে পানি নদীর তীরে ভাঙনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।
এ বছরের বর্ষাতেই পদ্মার ভাঙন অস্থায়ীভাবে ঠেকাতে এরই মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রায় ৫০ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। শুধু শরীয়তপুরে এ পর্যন্ত ১০ কোটি টাকা খরচ করেও ভাঙন সামলানো যাচ্ছে না। এরই মধ্যে জেলার প্রায় আট কিলোমিটার এলাকা ভাঙনের শিকার হয়েছে।
জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, পদ্মা পৃথিবীর অন্যতম গতিশীল নদী। বিশেষ করে বর্ষাকালে এটি কোথায় কখন ভাঙন ঘটাবে, তার পূর্বানুমান অনেক সময় করা যায় না। তবে এই নদী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অবশ্যই একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা দরকার। একই সঙ্গে নদীটির চরগুলোতে ও দুই তীরে অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে আরও সাবধান হতে হবে।
বার্তা কক্ষ,১৬ আগস্ট ২০২০
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur