করোনাভাইরাসের চিকিৎসা নিয়ে জালিয়াতির ঘটনায় অভিযুক্ত রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম ব্যক্তিগত জীবনেও বহুরূপী প্রতারক। জালিয়াতি প্রকাশের পর সাদিয়া আরাবী নামের এক স্ত্রীর পরিচয় জানা গেলেও সহকর্মীরা বলছেন, তাঁরা সাহেদের আরো দুই স্ত্রী দেখেছেন।
একজনের নাম চৈতি। এ ছাড়া লিজা ও মার্জিয়া নামে সাহেদের অফিসে দুই নারী কর্মকর্তা আছেন। তাঁদের একজন তাঁর বিয়ে করা বউ বলেও সন্দেহ কর্মীদের। একাধিক স্ত্রী থাকলেও পরস্পরের কাছে বিষয়টি এত দিন গোপন থেকে গেছে।
তদন্তকারী ও সহকর্মীদের সূত্রে জানা গেছে, লিজা ও মার্জিয়া ছাড়াও সাদিয়া ও হিরা মণি নামে দুই তরুণীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল সাহেদের। পাসওয়ার্ড দেওয়া প্রাইভেট রুমে তাঁদেরই প্রবেশাধিকার ছিল। কাজ হাসিল করতে সুন্দরী পাঁচ বান্ধবীকে বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতেন সাহেদ। আর্থিক জালিয়াতির জন্য বহুরূপী সাহেদের বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন স্বাক্ষর। লেনদেনের ক্ষেত্রেও তিনি ভিন্ন স্বাক্ষর ব্যবহার করতেন। একেকটি লেনদেন দেখার দায়িত্বে ছিলেন একেকজন সহযোগী।
সাহেদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন অভিযোগের তথ্য পাচ্ছেন পুলিশ ও র্যাবের তদন্তকারীরা। ৩২টি মামলার পর তাঁর বিরুদ্ধে আরো ২৩টি জালিয়াতি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। আর্থিক লেনদেনে প্রতারণার শিকার হয়ে মামলা করা ভুক্তভোগীরাই র্যাবকে এসব তথ্য দিয়েছেন। দায়িত্বশীলরা বলছেন, সাহেদকে গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। পুলিশ ১১ জুলাই শনিবার সাহেদের উত্তরার কার্যালয়ে তল্লাশি চালিয়ে তাঁর পাসপোর্ট, কম্পিউটারসহ কিছু আলামত জব্দ করেছে।
সাহেদের সাবেক এক নারী কর্মী পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমি তো সাহেদের তিনটি বউ দেখছি। তাদের একজন প্রিয়তির আম্মু (সাদিয়া আরাবী), যে বনানীতে থাকে। নাজিয়ার আম্মুকেও তো কিছুদিন আগে কক্সবাজার থেকে আটক করছে। আরেকজনের নাম চৈতি, সে-ই তার অরজিনাল বউ জানতাম। তার যে আর কোনো বউ আছে তা জানতাম না। পরে বাকিদের ব্যাপারে জানি।’ তিনি আরো বলেন, ‘মার্জিয়া নামের একজনকে শুধু শুধুই বেতনের নামে প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা দিতে হতো। স্যার তাকে বিয়ে করছে; কিন্তু অন্যদের সামনে হয়তো সেটা দেখাচ্ছে না। লিজা ম্যাডামও মনে হয় তার বিবাহিত ছিল। অনেক খবরদারি করত। মার্জিয়াকে নিয়ে একবার অনেক ঝগড়া হয়েছিল।’
সাহেদের স্ত্রী (পরিচয় পাওয়া) সাদিয়া আরাবীকে গতকাল কয়েকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি। র্যাবের তদন্তকারীরাও একই রকম তথ্য পেয়েছেন বলে জানান। একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সাহেদের পাঁচজন সুন্দরী বান্ধবী ছিলেন। তাঁদের একজন অফিসের ঘনিষ্ঠ কর্মী লিজা। সাদিয়া ও হিরা মণি নামের দুজনও তাঁর সুরক্ষিত পাসওয়ার্ড দেওয়া কক্ষে সময় কাটাতেন। সাহেদ সুন্দরী তরুণীদের বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে কাজ বাগিয়ে নিতেন।
সূত্র জানায়, কয়েকটি ব্যাংকে নিজের অ্যাকাউন্টের জন্য সাহেদ পৃথক স্বাক্ষর ব্যবহার করেন। সরবরাহকারীসহ বিভিন্ন ব্যাবসায়িক লেনদেনে তিনি ভিন্ন স্বাক্ষর ব্যবহার করতেন। এ কারণে অনেক সময় চেক প্রত্যাখ্যাত হতো।
এদিকে গতকাল বিকেলে উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরে সাহেদের রিজেন্ট গ্রুপের অফিসে তল্লাশি চালান পুলিশের তদন্তকারীরা। এ সময় র্যাবের দলও উপস্থিত ছিল। উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা বলেন, ‘আসামিদের রিমান্ডে দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে তথ্য সংগ্রহে তল্লাশি চালানো হয়। রিজেন্ট চেয়ারম্যান সাহেদের পাসপোর্ট, একটি কম্পিউটার, হার্ড ডিস্কসহ কিছু আলামত জব্দ করা হয়। যেহেতু স্থানটি সিলগালা তাই র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সহায়তা নেওয়া হয়। তল্লাশিকালে পাসপোর্ট পাওয়ার পর আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে সাহেদ দেশেই আছেন।’
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পর বিভিন্ন সূত্রে সাহেদের বিরুদ্ধে ৩২টি মামলার তথ্য পাওয়া যায়। পরে তিন ভুক্তভোগী মামলা করার তথ্য জানান। গতকাল পর্যন্ত আরো ২০ ভুক্তভোগী পাওয়া গেছে, যাঁরা টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় আগেই মামলা করেছিলেন।
প্রসঙ্গত, গত ৭ জুলাই উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে করোনার পরীক্ষা ও চিকিৎসায় প্রতারণার আলামত পাওয়া যায়। এরপর মিরপুরের শাখায়ও প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে ধারাবাহিক অভিযানে রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদের নানামাত্রিক প্রতারণার তথ্য উঠে আসে।
ঢাকা ব্যুরো চীফ, ১২ জুলাই ২০২০