কারো মৃত্যু নিয়েই উল্লাস করা ঠিক না। আজ আপনি আরেকজনের মৃত্যুতে উল্লাস করবেন, ট্রল করবেন, কাল আপনারটা নিয়েও হবে। হয়তো একদিন এমন সংস্কৃতি বন্ধ হবে। কারণ প্রকৃতি কখন বিরূপ হয়ে যায় আমরা কেউ আগাম বলতে পারি না। অতীতেও দেখেছি, এখনো দেখছি ট্রল কালচার।
একটি জীবনের পরিমাপ্তির পর তার কি হবে তা আমাদের জানার বাইরে। আমরা শুধু আফসোস করতে পারি। দোয়া করতে পারি। কার কোন ভালো কাজ তাকে পুলসিরাত পার হতে সহায়তা করবে জানি না।
তাই ভালো কাজের সাথে, মানুষের সেবা ও কল্যাণকর কাজের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখলে একদিকে যেমন মন ভালো থাকে, অপরদিকে এর জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা হয়তো আমাদের জীবনের পরিধি বাড়িয়ে দিতে পারেন। কারণ তিনি ছাড় দেন। ছেড়ে দেন না।
করোনা এসে আমাদের দেখিয়ে দিল জীবন অত্যন্ত তুচ্ছ। দিনরাত শুধু করুণ মৃত্যুর খবর। অনেকেই বলছেন, আর নিতে পারছি না। কবে আলো আসবে!
মনে পড়ল, এবারের বাজেটে বক্তৃতার এক জায়গায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত উদ্ধৃত করেছিলেন।
জাতীয় সংসদে বলেছেন, প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সৃষ্ট দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার মানুষকে এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা। পাশাপাশি দেশের মানুষের অন্ন বস্ত্র জোগানোর জন্য চাকাও সচল রাখা। এ জন্য তিনি মহান রাব্বুল আলামীনের সহায়তা চেয়েছেন।
তিনি পবিত্র কোরআনের সুরা আল বাকারার ১৫৫ নম্বর আয়াত উদ্ধৃত করে বলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আমি অবশ্যই তোমাদেরকে কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষায় ফেলবই। মাঝে মধ্যে তোমাদেরকে বিপদের আতঙ্ক, ক্ষুধার কষ্ট দিয়ে, সম্পদ, জীবন, পণ্য-ফল ফসলহানির মধ্য দিয়ে। আর যারা কষ্টের সাথে নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে তাদেরকে সুখবর দাও।
আমরা জানি, অনেক দুঃসংবাদ নিয়ে আমরা বেঁচে আছি। করোনার সাথে যুদ্ধ করে করে কেউ হেরে যাচ্ছেন, কেউ ফিরে পাচ্ছেন জীবন। যারা চলে যাচ্ছেন তাদের আর কোনো ভালো কাজ করার সুযোগ নেই।
কিন্তু আমরা যারা বেঁচে আছি, আমাদের সেই সুযোগ রয়েছে। আমরা যদি চেষ্টা করি হয়তো সুন্দর পৃথিবীতে আরো কিছু সময় বেঁচে থাকতে পারব।
হুমায়ূন আহমেদ মৃত্যুর ঠিক কয়েকদিন আগে এমন এক উপলব্ধির কথা শাওনকে বলেছিলেন, যদি আরেকটু সময় পেতাম। আরো কিছু কাজ হয়তো করার সুযোগ পেতাম। জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই।
মানুষের এই বাঁচার আকুতি গানে কবিতায় গল্প উপন্যাসেও পরতে পরতে রয়েছে। কেউ চায় না মরে যেতে। কিন্তু জীবন নিয়ে পৃথিবীতে আসার সময় তার কাঁধে মৃত্যুর রশিটাও ঝুলিয়ে দেয়া হয়। এরপর শেষ দিন পর্যন্ত তাকে অনেক সুবিধা দেয়া হয়।
চোখের যে শক্তি তা আর কোনো যন্ত্রে নেই। শোনার যে ক্ষমতা তার আর কোনো বিকল্প নেই। এই যে করোনায় আমাদের মুখ ঢেকে দিল মাস্ক দিয়ে। যদি এমন হতো যে, রোগটা চোখের! তখন কী অবস্থা হতো? আসলে নানা ধরনের বিপদসঙ্কেত দিয়ে আমাদের সতর্ক করা হয়। যাতে ভেদাভেদ ভুলে সত্য উপলব্ধি করি।
বিজ্ঞানীরা মানুষের অবিকল মানুষ তৈরি করে চ্যালেঞ্জ দিতে পারেন, কিন্তু তার ভিতরে জীবন দিতে পারবেন না। কারণ ওই বিজ্ঞানীর জীবনটাই তো মহান সৃষ্টিকর্তার দেয়া। মানুষের আছে সীমাবদ্ধতা। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা অসীম।
ক্ষুদ্র এই জীবনে আমাদের মূল্য ওই বেঁচে থাকার মাঝেই। মরে যাবার পর শরীরটা আমার থাকে না। সব চলে যায় তার কাছে, যিনি পৃথিবীতে সৃষ্টির সেরা জীব করে আমাদের তৈরি করেছেন। কিন্তু আমরা নিজেরাই সেই সেরা জীবনের মূল্যটা দিই না।
মানুষকে মানুষ মনে করি না। সুবিধা অনুযায়ী আমরা একেক সময় একেক কাতারে সামিল হই। কাতার ভেঙে আবার একে অন্যের সমালোচনায় সোচ্চার হই। নিজের কাজের চেয়ে অন্যেরটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাই। এ কারণে দিন শেষে আমাদের নিজেদের হিসাবের খাতায় নাম্বার ওঠে কম।
এই করোনায় আমরা এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। তবুও নিজেরটা বাদ দিয়ে অন্যেরটা নিয়ে সমালোচনার হাত রাখি বাড়িয়ে। আমজনতার পাশাপাশি এই করোনায় এখন পর্যন্ত দুজন মন্ত্রী, এমপি, সিলেটের সাবেক মেয়র, একজন সচিবের স্ত্রীসহ অনেকে চলে গেছেন। চিকিৎসক সাংবাদিক পুলিশ প্রশাসনসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ চলে যাচ্ছেন।
আসুন আমরা তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আর অতীতে কারও মৃত্যু নিয়ে কেউ খুশি হয়েছিল, কেউ উল্লাস করেছিল, সে কারণে এখনো করতে হবে- এমন কোনো কথা নেই।
আগেই বলেছি, মৃত্যুর পর ওই ব্যক্তির সব শেষ। থাকে তার কাজ। ভালো কাজ হলে তার সুবিধা তিনি মরণের পরও পাবেন। বাকিটা আমাদের জানার বাইরে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জানেন, কাকে কোন পরীক্ষায় রেখেছেন। কাকে নিয়ে যাবেন। কাকে রাখবেন। ধৈর্য্য ধরতে হবে সব প্রতিকূল অবস্থায়।
করোনা আমাদের জীবনের এক নতুন অধ্যায়।নতুন সময় ডাক দিয়েছে। শিক্ষা নেবার জন্যই হয়তো এই সময়টা আমাদের সামনে আসল। যাতে করে আমাদের দম্ভ কমে। বড়াই, অহঙ্কার কমে। মানুষের কাতারে থাকি।
আসুন আমরা একে অপরের কল্যাণে পাশে থাকি। ভালো থাকার চেষ্টা করি নিজের জন্য, পরিবার ও কাছের মানুষের জন্য। দেশের স্বার্থে। আরো পড়ুন- করোনা থেকে রক্ষায় চাঁদপুরের কৃতি সন্তান সাংবাদিক মিজান মালিকের ‘প্রার্থনা’
লিখেছেন : মিজান মালিক
দৈনিক যুগান্তরের হেড অব ক্রাই এন্ড ইনভেস্টিগেশন
ও যমুনা টেলিভিশনের টিম থ্রি সিক্সটি ডিগ্রির সম্পাদক