করোনাভাইরাস শনাক্তকরণে দেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে গড়ে ৮০ জনের টেস্ট হচ্ছে। মোট জনসংখ্যার অনুপাতে যা একেবারেই কম। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশের তুলনায় এ রোগের টেস্টে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে। আর বেশি শনাক্ত হয়েছে বিশ্বের এমন দেশগুলোতে টেস্টের হার প্রতি ১০ লাখে ১০ হাজারের ওপর।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা টেস্টের ওপর জোর দিয়ে আসছে। গত মঙ্গলবার সংস্থাটি প্রকাশিত সর্বশেষ করোনাভাইরাস প্রতিরোধবিষয়ক কৌশলপত্রে বলেছে, এখন পর্যন্ত এ রোগের কোনো টিকা বা সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই। টেস্টের মাধ্যমে দ্রুত রোগী শনাক্ত করা এবং তার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা গেলে এই ভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হবে। তাই সাধারণ জনগণের মধ্যে করোনা শনাক্তকরণ টেস্ট করতে দেশগুলোকে সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
১৬ এপ্রিল বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, নমুনা টেস্ট আরও বাড়ানো হবে। তাতে সারা দেশের পরিস্থিতি বোঝা যাবে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
বর্তমানে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মোট ১৭টি ল্যাবরেটরিতে কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের টেস্ট হচ্ছে। এসব ল্যাবরেটরিতে দিনে সাড়ে চার হাজারের বেশি নমুনা টেস্ট করার সক্ষমতা থাকলেও এখন পর্যন্ত এক দিনে সর্বোচ্চ টেস্ট হয়েছে ১ হাজার ৯০৫টি। ফলে বিদ্যমান ল্যাবরেটরিগুলোর সক্ষমতার অর্ধেকের বেশি অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা শনাক্তকরণের টেস্ট বাড়লে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যাও বাড়বে। পর্যাপ্ত টেস্ট না হওয়ায় করোনা–আক্রান্ত ব্যক্তি আইসোলেশনে না থেকে সাধারণভাবে চলাফেরা করেন। এতে একজনের মাধ্যমে আরও অনেকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের টেস্ট শুরু করে। শুরুতে বিদেশফেরত এবং তাঁদের সংস্পর্শে না এলে টেস্ট করা হয়নি। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হন। ৩০ মার্চ থেকে টেস্টকেন্দ্রের আওতা বাড়ানো শুরু হয়।
বর্তমানে ঢাকার নয়টি এবং ঢাকার বাইরে আটটি ল্যাবরেটরিতে কোভিড–১৯ শনাক্তকরণের টেস্ট হচ্ছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৪ হাজার ৮৬৮ জনের টেস্ট করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ২৩১ জনের।
পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটার শুরু থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের করোনাবিষয়ক হালনাগাদ তথ্য দিয়ে আসছে। গতকাল সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ওয়ার্ল্ডোমিটারের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখে ৮০ জনের করোনার টেস্ট করা হচ্ছে।
অন্য দেশে টেস্টের চিত্র
ওয়ার্ল্ডোমিটারের হিসাব অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি টেস্ট হচ্ছে মালদ্বীপে। দেশটিতে প্রতি ১০ লাখে টেস্ট ৫ হাজার ৩৬৩ জনের টেস্ট করা হচ্ছে। প্রথম রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৭ মার্চ। এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত রোগী ২১ জন।
ভুটানে প্রতি ১০ লাখে ১ হাজার ৫১১, পাকিস্তানে ৩৩২, শ্রীলঙ্কায় ২২৩, নেপালে ২১৬ এবং ভারতে ১৭৭ জনের টেস্ট করা হচ্ছে। ভারতে প্রথম রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৩০ জানুয়ারি। এ পর্যন্ত শনাক্ত মোট রোগী সাড়ে ১১ হাজার ছাড়িয়েছে।
আক্রান্ত শীর্ষ দেশগুলোয় করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সব দেশেই এক থেকে দেড় মাস পরে বড় ধরনের উত্থান ঘটেছে আক্রান্তের সংখ্যায়। দেশগুলো ব্যাপকভিত্তিক টেস্টের মাধ্যমে রোগী শনাক্ত করেছে। একই সঙ্গে সংক্রমণ প্রতিরোধে লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব রক্ষায় জোর দেওয়াসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে।
ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, ইতালিতে প্রতি ১০ লাখে ১৭ হাজার ৭৫৮, জার্মানিতে ১৫ হাজার ৭৩০, স্পেনে ১২ হাজার ৮৩৩, যুক্তরাষ্ট্রে ৯ হাজার ৩৬৭ এবং দক্ষিণ কোরিয়াতে ১০ হাজার ৪২৬ জনের করোনা শনাক্তের টেস্ট করা হচ্ছে। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ায় রোগী শনাক্তের প্রথম থেকে টেস্টের ওপর জোর দিয়ে আসছে। সংক্রমণের বিস্তারও তারা অনেকটা সামলে নিয়েছে।
প্রথম রোগী শনাক্তের ৩৯ দিন পার হয়েছে। এখনো দিনে সর্বোচ্চ টেস্ট দুই হাজারের কম।
বাংলাদেশের চেয়ে কিছুটা কম টেস্ট হচ্ছে আফ্রিকার দেশগুলোতে। এসব দেশে সংক্রমণ এখনো ততটা বিস্তৃত হয়নি। প্রতি ১০ লাখ মানুষের বিপরীতে ৫০ জনের কম টেস্ট হচ্ছে এমন দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে নাইজেরিয়া, হাইতি, জিম্বাবুয়ে, ইথিওপিয়া।
দেশে টেস্টের আওতা বাড়ছে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা জানিয়েছেন, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে আরও ১১টি নতুন টেস্টকেন্দ্র চালু করা হবে। কেন্দ্রগুলো হলো কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, মুগদা মেডিকেল কলেজ, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ, দিনাজপুরের এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ এবং বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ।
টেস্টের সংখ্যা বাড়লে করোনা শনাক্তকরণ কিটের প্রয়োজন হবে। ১১ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে জানানো হয়, দেশে করোনা শনাক্তকরণ কিটের মজুত রয়েছে ৭১ হাজার। এরপরে আরও চার দিন স্বাস্থ্য বুলেটিন হলেও কিটের মজুত কত, তা জানানো হয়নি।
তবে টেস্টকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়লেও এগুলোর পুরো সক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাঠপর্যায়ে যাঁরা নমুনা সংগ্রহ করছেন, তাঁরা যথেষ্ট প্রশিক্ষিত নন। ফলে পর্যাপ্ত নমুনা পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে সঠিক প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ না করায় নমুনা নষ্টও হয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে যে পদ্ধতি (পিসিআর) ব্যবহার করে শনাক্তকরণের টেস্ট করা হচ্ছে, সেটিও বেশ জটিল। এই টেস্ট করার মতো দক্ষ টেকনিশিয়ানেরও সংকট রয়েছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে অনেকে নমুনা দিতে চাচ্ছেন না, টেস্ট কম হওয়ার এটা বড় কারণ।
সার্বিক বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজীর আহমেদ বলেন, দেশে যে পরিমাণ করোনা শনাক্তের টেস্ট হচ্ছে, তা সন্তোষজনক নয়। টেস্টকেন্দ্রগুলোর লোকবল ও মানেও ঘাটতি রয়েছে। নমুনা সংগ্রহ মানসম্মত না হলে সঠিক ফল পাওয়া যাবে না। তিনি দ্রুত দক্ষ লোকবলসহ কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে বলেন, টেস্ট বেশি হলে রোগ ছড়ানোর আগেই রোগী চিহ্নিত করা সম্ভব। এতে সংক্রমণ রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতেও সুবিধা হবে।।(প্রথম আলো)
বার্তা কক্ষ, ১৬ এপ্রিল ২০২০