কানাডাফেরত শিক্ষার্থী নাজমা আমিন। ২৪ বছর বয়সী এই শিক্ষার্থী ১০ মাস আগে কানাডা গিয়েছিলেন গ্রাজুয়েশন করতে। পেটের ব্যথা নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে এসেছিলেন চিকিৎসা করাতে। তবে ব্যথা থেকে মুক্ত তো হতে পারেননি; লাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন তিনি।
মেয়ের এই মৃত্যু নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী বাবা আমিন উল্লাহ বললেন, “আমার মেয়ে কানাডাফেরত শুনেই তিন-চারজন ডিউটিরত নার্স ‘করোনা করোনা’ বলে আওয়াজ তোলেন। ওয়ার্ডে শুরু হয় ছোটাছুটি। তার করোনা টেস্ট করা হয়। রিপোর্ট আসার আগে কেউ তার সামনে আসেনি। আমার সামনে মেয়েটার জান গেছে দুপুর ১টায়। বিকেল ৫টায় যখন আইইডিসিআরের রিপোর্টে তার করোনা নেগেটিভ পাওয়া যায়, তখন তার মরদেহ আমাদের দেয়া হয়।”
ক্ষুব্ধ বাবা বলেন, চিকিৎসক-নার্সদের অবহেলায় আমার মেয়ে মারা গেছে।
নাজমা আমিন কানাডার সাসকাচোয়ান প্রদেশের ইউনিভার্সিটি অব রেজিনে গ্রাজুয়েশন করছিলেন। সারাবিশ্বে করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখে বাবা-মার অনুরোধে ৯ মার্চ ঢাকায় ফিরে আসেন। শুক্রবার (১৩ মার্চ) দুপুরে বাবাকে ‘পেটে প্রচণ্ড ব্যথা’ বলে জানান নাজমা।
বাবা আমিন উল্লাহ দুপুরে ধানমন্ডির বাংলাদেশ মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তাকে একটি ইনজেকশন পুশ করা হলে সুস্থ অনুভব করেন তিনি। এরপর তারা চলে যান বাড়ি।
আমিন উল্লাহ বলেন, ‘রাতে মেয়ের আবার পেট ব্যথা অনুভূত হলে তাকে মোহাম্মদপুরের আল মানারাহ হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানকার চিকিৎসক বলেন, তার শরীর ভালো নয়, আইসিইউ লাগবে। সেই হাসপাতালে আইসিইউ খালি ছিল না। তখনই তাকে তেজগাঁওয়ের একটি হাসপাতালে নেই। সেখানেও আইসিইউ খালি না পেয়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাই। তারা আমাকে বলেন, নাজমার চিকিৎসার জন্য একটি মেশিন দরকার। এ হাসপাতালে দুটি মেশিন রয়েছে, যার একটি নষ্ট আরেকটি আরেকজন রোগীকে দেয়া হয়েছে। তারা ঢামেকে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।’
শনিবার (১৪ মার্চ) ভোর ৬টায় ঢামেকে আনা হয় নাজমাকে। সার্জারি বিভাগের ২১৯ নম্বর ওয়ার্ডে অধ্যাপক ডা. এ বি এম জামালের তত্ত্বাবধানে রাখা হয়।
নাজমার বাবা বলেন, ‘ঢামেকে নেয়ার পর তাকে স্যালাইন-অক্সিজেন দেয়া হয়। নাকে পাইপ দিয়ে পেটের ময়লা বের করা হয়। ১২টার সময় তার পেট ব্যথাটাও কিছুটা কমে। ১২টার পর ওয়ার্ডের নার্সদের শিফট পরিবর্তন হয়।’
“নতুন শিফটের ডিউটিরত ডাক্তার-নার্সরা এসে আমার মেয়ের কাছে সমস্যা ও রোগের বিষয়ে জানতে চান। আমার মেয়ে প্রথমেই বলে যে, সে কানাডা থেকে এসেছে ৯ মার্চ। এই শুনেই নার্সরা দূরে চলে যান। এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। ‘করোনা করোনা’ গুঞ্জন করতে থাকেন। তারা একে অন্যকে বলতে থাকেন, ‘বিদেশ থেকে আসছে, সেহেতু করোনা হয়েছে’।”
‘এরপর থেকে আমার মেয়েকে কোনো চিকিৎসা দেয়া হয়নি। একপর্যায়ে আইইডিসিআর থেকে এসে আমার মেয়ের লালাসহ অন্যান্য নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। দুপুর ১টার দিকে আমার মেয়ের শরীর খারাপ হতে থাকে। কেউ তাকে দেখতে সামনেও আসেনি। আমার সামনেই মেয়েটার জান চলে গেল। কেউ আসেনি’— কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলেন আমিন উল্লাহ।
নাজমার লালা পরীক্ষায় রেজাল্ট নেগেটিভ আসে। নাজমার বাবা বলেন, ‘মেয়ে মারা যাওয়ার পরও কেউ সামনে আসেনি। ১টায় মারা গেল, তারা আমাকে তখন লাশও দেয়নি। পরে আইইডিসিআর থেকে আমার মেয়ের করোনা টেস্টের রেজাল্ট দেয়া হলো। রেজাল্ট ছিল ‘নেগেটিভ’। মেয়ের করোনা হয়নি- নিশ্চিত হওয়ার পর বিকেল ৫টার দিকে লাশ আমাকে বুঝিয়ে দিল তারা।’
“মেয়েটাকে নিজের হাতে কবরে রেখে আসলাম, অথচ মরার সময়ও কেউ তার সামনে আসল না। কার কাছে বিচার চাইব? দেশে তো বিচার নাই। বেশি কথা বললে আবার ময়নাতদন্ত করা হতো। তাই ‘রক্তশূন্যতার কারণে মেয়ের মৃত্যু হয়েছে’— আমি চিকিৎসককে এ কথা বলে লাশ এনে দাফন করি।” চাপা কষ্ট আর আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলেন আমিন উল্লাহ।
নাজমার তদারকির দায়িত্বে ছিলেন সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এ বি এম জামাল।
l) hতিনি বলেন, ‘যখন জানা গেল মেয়েটি কানাডা থেকে এসেছে, জ্বর-কাশি আর শ্বাসকষ্ট ছিল, তখন ওয়ার্ডে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নার্সরাও প্যানিক (আতঙ্কিত) ছিল। পাশাপাশি ওয়ার্ডে অন্য রোগীদের স্বজনরাও সেখানে ছোটাছুটি শুরু করেন। এরপর আমরা ডিরেক্টর স্যারকে বিষয়টি জানালে তিনি আইইডিসিআরে ফোন দিয়ে দ্রুত কনসালটেন্ট এনে স্যাম্পল (নমুনা) নিতে বলেন। তারা র্যাপিড টেস্ট করিয়ে রেজাল্ট দেয়। রেজাল্ট নেগেটিভ ছিল, অর্থাৎ তিনি করোনা আক্রান্ত ছিলেন না। তবে রেজাল্ট আসার আগেই তার মৃত্যু হয়। আমরা মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে মরদেহের ময়নাতদন্ত করতে চেয়েছিলাম। তবে তার বাবা এতে অস্বীকৃতি জানান।’
চিকিৎসকদের দায়িত্ব অবহেলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সকাল থেকে তিনজন চিকিৎসক তাকে স্ট্যান্ডবাই (তাৎক্ষণিক) দেখেছে এবং চিকিৎসা দিয়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর যখন তার হিস্ট্রি জানতে চেয়েছে, তখনই প্যানিকিং (আতঙ্ক) সিচুয়েশন তৈরি হয়। এত লোকের মধ্যে কারা বিশৃঙ্খলা করেছে তাদের ডিটেক্ট করা কষ্টকর।’
মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বুধবার মেয়েটি ফার্মেসি থেকে একটি ব্যথানাশক ওষুধ কিনে খেয়েছিল। খালি পেটে এসব ওষুধ খেলে অন্ত্র ফুটো হয়ে যায়। আমরা সন্দেহ করছি, তার অন্ত্রে ছিদ্র ছিল বা ফাটল ছিল। অর্থাৎ, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল জটিলতায় তার মৃত্যু হয়। তাকে যখন ভর্তি করা হয়, তখন তার শরীর থেকে প্রচুর তরল বের হয়ে গেছে।’
দায়িত্ব অবহেলার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমি এখন রাউন্ডে আছি, ব্যস্ত আছি। এখন কথা বলতে পারব না।’