চাঁদপুর সদর উপজেলার বালিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম সাপদি গ্রামের বাসিন্দা ও ফরক্কাবাদ ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেনীর মেধাবি শিক্ষার্থী ফরহাদ হোসেন অন্তর (১৬) প্রেমের পরীক্ষা দিতে গিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়েছে।
তার এই অকাল মৃত্যুর পেছনে দায়িত্ব অবহেলার দায় নেবে কে? অভিভাবক কিংবা সমাজ কেউ কি দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারবে? তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার কারণে সামাজিক অবক্ষয় হয়েছে সঠিক, এটি নিয়ন্ত্রণ করা কার দায়িত্ব? এতসব প্রশ্নের উত্তর আর এই ধরনের মৃত্যুর ঘটনা রোধ করতে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক আন্দোলন খুবই জরুরি হয়ে পড়ছে বলে অনেকেই মতামত দিয়েছেন।
ঘটনা সূত্রে ও অনুসন্ধান করে জানাগেছে, ফরহাদ তাদের বাড়ির কাছেই নানার বাড়ি জমাদার বাড়িতে থেকে লেখা-পড়া করতো।
তার পিতা মো. মুনসুর আহেমদ প্রবাসী। মালয়েশিয়া থাকেন। ২০১৯ সালে ফরক্কাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ফরহাদ এসএসসিতে এ+ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
তার নানার বাড়ির শরীফ জমাদার স্বপনের কন্যা ও ফরক্কাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী শারমিন আক্তার মাসুমার সাথে দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্ক ছিলো। অপ্রাপ্তদের এ প্রেমে ছিলো মন ভরা আবেগ আর দুর্লভ স্বপ্ন। । ঠিক এই বয়সে এ প্রেমিকযুগল অভিভাবক ও আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে সাড়া-সিদ্ধান্ত না পেয়ে অজানা পথেই হাঁটতে থাকে। মৃত্যুর আগে ফরহাদ তার ফেসবুক ওয়ালে এমনটিই দাবি করেছেন।
অপরদিকে মাসুমা আবেগের বশবর্তী হয়ে ফরহাদকে অভিনব প্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রস্তাব করে। আর এতেই ফরহাদ মাসুমার সাথে অভিমান করে ঘুমের ও নানীর ডায়াবেটিস ঔষুধ সেবন করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চেষ্টা করে।
বিষয়টি দু’পরিবারেই জানতো, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেননি।
সর্বশেষ গত জুন মাসের ২৮ তারিখে প্রেমিকার মাসুমার বাবা-মা ফরহাদের নানার বাসায় গিয়ে ফরহাদকে কঠোর ভাষায় বকা-ঝকা দেয় এবং বলে ফেলে, ‘তুই বিষ খেয়ে মরতে পারিস না’।
এতেই ফরহাদ মনে ক্ষোভের জন্ম হয় বিষপান করে। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তার নানী ও মাসহ স্বজনরা প্রথমে তাকে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে এনে ভর্তি করায়। সদর হাসপাতালে ৩ দিন চিকিৎসা চলার পর অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপতালে রেফার করে চিকিৎসক।
এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফরহাদ গত শুক্রবার (৫ জুলাই) রাতে মারা যায়। পরদিন শনিবার (৬ জুলাই) বাদ আছর বাড়িতে নামাজে জানাযা শেষে তার দাফন সম্পন্ন হয়।
ফরহাদের নানা ইসমাইল চাঁদপুর টাইমসকে জানান, ‘ফরহাদের মৃত্যুর পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়না তদন্ত হয়। কিন্তু সেই তদন্ত রিপোর্ট এখনো পাওয়া যায়নি। হয়তো হাসপাতালে থেকে পরে থানায় পাঠানো হবে। এই ঘটনায় তাদের পরিবার থেকে কোন ধরনের আইনি প্রদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে তিনি জানান।’
ফরহাদের মা হাজেরা বেগম চাঁদপুর টাইমসকে জানান, প্রায় সময়ই মাসুমা আমাদের ঘরের ফ্রিজে মাছ, মাংস ও পানি রাখার জন্য আসতো। আসলে ফরহাদের সাথে কথা বলতো। কিন্তু তাদের মধ্যে কি কথা হতো, তা আমি জানতাম না। এর মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আমাদের বাড়িতে পারিবারিক বৈঠক হয়। তখন তাদের দু’জনের মধ্যে আর যেনো সম্পর্ক না থাকে সে বিষয়ে দু’পরিবারের মধ্যে মৌখিত সিদ্ধান্ত হয়।
তারপরেও মাসুমা আমার ছেলের সাথে স্কুলে আসার পথে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করতো। পরে আমি আমার ছেলেকে বলেছি, সে যে তোর সাথে এসে কথা বলে তার প্রমাণ রেখে দিতে।
কিন্তু প্রমাণ সংগ্রহ করার আগেই মাসুমা ও তার পিতা মাতা আমাদের বাড়িতে এসে ছেলেকে ঘরের সামনে পেয়ে অকথ্য ভাষায় গাল মন্দ করে এবং বিষ খেয়ে মরে যাওয়ার জন্য বলে।
ঠিক ওইদিন মাগরিবের নামাজের পরে আমার ছেলে ঘরে এসে বমি করতে থাকে। কিন্তু সে আমার কাছে স্বীকার করতে চায়না বিষ পান করেছে। অনেক্ষণ পরে সে স্বীকার করে ঘাসের ঔষধ খেয়েছে। আমার তখনই সন্দেহ নামাজ পড়ে আসার পথে মাসুমার পিতা-মাতা তাকে জোর করে বীষ পান করিয়ে দিয়েছে অথবা ওই কীটনাশকটি তার হাতে দিয়ে দিয়েছে। মাসুমার পিতা কৃষি কাজ করেন, তার ঘরে সব সময়ই কীটনাশক থাকে। আমার ছেলে এই অল্প সময়ে কীটনাশক পাবে কোথায়। আশপাশে কোন কীট নাশকের দোকানও নেই।
তিনি আরো জানান, মৃত্যুর পূর্বে আমার ছেলে মোবাইলে মেসেজ দিয়ে লিখেছেন, আমিত স্বপন মামার (মাসুমার বাবা) কোন ক্ষতি করিনি, কিন্তু তিনি আমার কেন এত ক্ষতি করলেন। আমি ইচ্ছা করলে উনার ক্ষতি করতে পারতাম। তাত করিনি। সে মুখে অনেক কথা বলতে চাইছে, কিন্তু কীটনাশক পান করার পর তা মুখ ক্ষত হয়ে যায়। সে কথা বলতে পারেনি।
ফরহাদের নানী রহিমা বেগম চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, আমার নাতি আমার কাছে থেকেই পড়ালেখা করতো। এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। আমাদের বাড়ির শরীফ জমাদার স্বপনের মেয়ে মাসুমার সাথে আমার নাতির প্রেমের সম্পর্ক ছিলো জেনে মেয়ের পিতা-মাতাকে একাধিকবার জানাই।
তারা কোন ধরণের ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো আমার নাতি ফরহাদকে হুমকি ধমকি দেয়। তারা আমার ঘরে এসে বলে নাতিকে গালাগাল দিয়ে বলে, ‘এই তোদের কোনো কোনো জায়গা-সম্পদ নেই নেই, তুই কেন আমাদের মেয়ের সাথে প্রেম করিস”। ২৮ জুন তারা আবার এসে আমার নাতিকে মারধর করে এবং বলে “তুই মরিস না কেন? বিষ খেয়ে মর।” এই কথার পরেই আমার নাতি বিষ খেয়ে মরেছে।
তিনি আরো বলেন, মাসুমা একাধিকবার আমার নাতি ফরহাদ হোসেনকে বলেছে “ আমাকে ভালোবাসো সেটার প্রমান দাও।” এটা শুনে আমার নাতি একাধিকবার ঘুমের ঔষুধ পান করে। এই ধরনের ঘটনা মেয়ের বাবা স্বপন জমাদার জেনেও মেয়েকে শাসন করেনি কিংবা কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি বরং উল্টো আমার নাতিকে হুমকি দেয়।
রহিমা বেগম আরো বলেন, ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর এলাকার বাসিন্দা ও নয়াহাট কলেজের প্রভাষক মোহাম্মদ হোসেন আমাকে চাপ দেয়, যেন ঘটনাটি কোন সাংবাদিককে জানানো না হয়। যদি জানানো হয়, তাহলে আমাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিবে। এলাকার একটি মহল প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতে চক্রান্ত করে যাচ্ছে।
এই বিষয়ে কথা বলার জন্য মাসুমাদের বাড়ীতে গিয়ে তার পিতার খোঁজ করা হয়। কিন্তু তিনি বাড়ীতে নেই বলে জানিয়ে দেয় এবং কিছুক্ষণ পরেই তার পক্ষ নিয়ে বলার জন্য নয়ারহাট কলেজের শিক্ষক মোহাম্মদ হোসেনকে বাড়িতে পাঠায়।
শারমিন আক্তার মাসুমা জানায়, তার সাথে ফরহাদের কোন সম্পর্ক ছিলো না। তার সাথে কোন ছবি তুলে নাই। তার নামও ঠিক করে জানেন না। মানুষের কাছে শুনেছেন তার নাম অন্তর। অথচ ফরহাদের মোবাইলে তাদের উভয়ের অন্তরঙ্গ অনেক ছবি পাওয়া যায়। এমনকি মাসুমার জন্মদিনের কেক কিনে স্কুলে পাঠায় ফরহাদ। সেই কেক মাসুমা সহপাঠীদের নিয়ে স্কুলে জন্মদিন পালন করে।
মাসুমার মা ফেরদৌসি বেগম জানান, তার মেয়েকে ফরহাদ স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে বিরক্ত করত। তবে কখনো পারিবারিকভাবে বিয়ে কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক নিয়ে কথা বলার জন্য আসেননি।
এই বিষয়ে ফরক্কাবাদ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ হাসান খান বলেন, ঘটনাটি আমরা পরে জেনেছি। খুবই দুঃখজনক ঘটনা। এই ধরনের ঘটনায় উভয়পক্ষের অভিভাক দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। এটি একটি সামাজিক অবক্ষয় বটে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়েকে এই ধরনের অবস্থায় অভিভাবকদেরকে খোলা মেলা কথা বলা প্রয়োজন ছিলো। তাদেরকে বুঝিয়ে এই ধরনের কাজ থেকে বিরত রাখতে পারতেন।
চাঁদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পদোন্নতি প্রাপ্ত পুলিশ সুপার) মো. মিজানুর রহমান ঘটনাটি জেনে খুবই দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এই ধরনের ঘটনায় পিতা-মাতাকেই ভূমিকা নিতে হবে। কারণ তার সন্তান কোথায় থাকে, কি করছে, কার সাথে মিশছে এসব বিষয়গুলো পিতা-মাতাই সবার আগে জানেন। আর সন্তাদের নৈতিক শিক্ষা খুবই প্রয়োজন। পরিবার থেকেই তারা নৈতিক শিক্ষা গ্রহন করেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই শেখার অনেক কিছু আছে, তবে তা সীমিত আকারে। মূল ভুমিকা পরিবার থেকেই আসবে। এই ধরনের ঘটনা আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে। কিন্তু মূলত সন্তান যখন বড় হয়, তার শারিরীক ও আচরণগত পরিবর্তন আসে তখনকার সময়টা বেশী নজর দেয়া প্রয়োজন। পিতা-মাতাকে কোন ধরনের লজ্জা কিংবা জড়তার মধ্যে না থেকে সন্তানের বন্ধু হতে হবে। এখন সময় হয়েছে সমাজের মধ্যে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা এবং সকলেই এগিয়ে আসা।
তিনি আরো বলেন, ফরহাদের মৃত্যুর ঘটনাটি খুবই করুন। কারণ সে একজন মেধাবী ছাত্র ছিলো। তার কাছ থেকে জাতি অনেক কিছু পেতো। পারিবারিক ভুল কাউন্সিলিংয়ের কারণে একাটি মেধাবী ছাত্রের মৃত্যু হলো।
তারিখ: ০৭-০৭-২০১৯খ্রি.
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur