১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে এখন মাদকসেবীর সংখ্যা ৭০ লাখ ৷ আর এখানে এখন মাদক হিসেবে ব্যবহারের শীর্ষে রয়েছে ইয়াবা নামের এক ধরনের উত্তেজক ট্যাবলেট ৷ এছাড়াও হেরোইন,গাঁজা এবং ফেনসিডিলের ব্যবহারও উল্লেখ্যযোগ্য হারে বাড়ছে ৷ এ মাদকের ছোবল যে কোনোভাবেই থামাতে হবে। প্রতি বছর ২৬ জুন আসে আবার যায় । নতুন নতুন প্রতিপাদ্যও দেয়া হয়। প্রাথমিকভাবে ধূমপান থেকেই মাদকের রাস্তা বা পথ দেখা দেয় ।
ধুমপানের কারণে আমাদের দেশে অনেকেই ক্যান্সার ও যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। রক্তনালী শুকিয়ে গিয়ে গ্যাংগিং রোগেও আক্রান্ত হচ্ছে। ধুমপান শুধু সিগারেট তা নয়, পানের সাথে জর্দা ও সাদা পাতা ধুমপানের আওতায়। ধুমপান রোধ করতে হবে। নেশার প্রথম ধাপ হলো ধুমপান। সিগারেট আর মাদক এক নয়। তাই সিগারেটকে মাদকের প্রবেশদ্বার বলা হয়। তামাক জাতকে আইনের আওতায় আনতে পারলে আমাদের মাদক রোধ করা সম্ভব হতে পারে ।
যতদূর জানা যায় , ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ ৪ বছরে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর হেরোইন উদ্ধার করেছে ৪৮ কেজি, গাঁজা ১৬ হাজার কেজি, ফেনসিডিল দেড় লাখ বোতল, ইয়াবা ট্যাবলেট ৫০ লাখ পিস ৷এর বাইরে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং কোস্টগার্ড বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে ৷২০১৮ ও চলমান পরিসংখ্যান আপাতত নেই ।
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী,এ আইনে ২০১৭ সালে সারাদেশে মামলা হয়েছে ১,০৬,৫৩৬টি ৷ এ মামলাগুলো মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং কোস্টগার্ডের অভিযোগ, আটক এবং মাদকদ্রব্য উদ্ধারের ভিত্তিতে করা হয়েছে ৷ আর এ সংখ্যা ২০১৬ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ৷
যে পরিমাণ মাদকদ্রব্য ধরা পড়ে, তা বিক্রি হওয়া মাদকের মাত্র ১০ %৷ আর ৯০ % মাদকই ধরা পড়ে না ৷ জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা-র মতে, বাংলাদেশে বছরে শুধু ইয়াবা ট্যাবলেটই বিক্রি হচ্ছে ৪০ কোটির মতো, প্রতিটির দাম দুইশ’ টাকা হিসেবে যার বাজারমূল্য আট হাজার কোটি টাকা ৷
২০১৭ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে ইয়াবার ব্যবহার ৮০% বেড়েছে৷ আর ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে বেড়েছে ৪৬ %৷ ২০১২ সালে মাদকসেবীর মধ্যে ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা ছিল ৫ দশমিক ৭৭ %, ২০১৬ সালে তা হয়েছে ৩১ দশমিক ৬১ %৷
২০১০ সালে বাংলাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ছিল ৪৬ লাখ, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৭০ লাখ ৷ ৭০ লাখের মধ্যে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মাদকসেবী আছে ৬৩ দশমিক ২৫ %৷ তাদের মধ্যে ৭০ ভাগের বয়সই ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে৷
বাংলাদেশের শুধু শহরাঞ্চল নয়, গ্রাম এলাকায়ও পৌঁছে গেছে মাদক ৷ আর ঢাকাসহ শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মাদকসেবী এবং ব্যবসায়ীদের বড় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে ৷ চলমান মাদকবিরোধী অভিযানের মধ্যেও ঢাকার বসুন্ধরা এলাকার কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে এর একটি
চিত্র পাওয়া গেছে ।
দেশে মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ৷ এর বাইরে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং কোস্টগার্ড মাদক নিয়ন্ত্রণ এবং মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানে কাজ করে ৷এর পর এর গতি থামছে না । মাদক আমাদের তরুণ প্রজম্মের জন্যে একটি ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের একটি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে , দেশে কমপক্ষে ৭০ লাখ মানুষ সরাসরি মাদকাসক্ত। এদের মধ্যে ৮৬ % পুরুষ আর ১৩ % নারী। আরো জানা যায়, এক লাখেরও বেশি মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রভাবশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী এবং শিশু-কিশোররাও জড়িত মাদক ব্যবসার সঙ্গে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৪৬ লাখ। আসক্তদের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ। অধিদপ্তরের জরিপে বলা হয়,আসক্তদের ৯১ % কিশোর ও তরুণ। মাদকাসক্তদের ৪৫ % বেকার এবং ৬৫ % আন্ডার গ্র্যাজুয়েট। মাদকাসক্তের ১৫ % উচ্চ শিক্ষা।
আইন-শৃংখলা বাহিনীর কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অবৈধ মাদক আমদানির জন্য প্রতি বছর ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি দেশি মুদ্রা পাচার হয়ে যাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে,বাংলাদেশে ৪৩ % মানুষ মাদকে আসক্ত তাদের ২০ % নারী। মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে যতদূর জানা গেছে- পৃথিবীর শতাধিক দেশের ৫০-৬০ কোটি মানুষ মাদকে আসক্ত বলে বিশ্ব স্বাস্থা সংস্থা জানায়। ৩৬ টি দেশে অধিক ক্ষতিকর মাদক উৎপাদন করলে তা ’ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে শতাধিক দেশকে মাদকের লীলাভূমি হিসেবে পরিণত করেছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রচারিত একটি পোস্টারে জানা গেছে, গাঁজা,ফেনসিডিল,হেরোইন,মদ,ইয়াবা ও সিগারেট ইত্যাদি ক্ষতিকর মাদকে মানুষের দেহে ক্ষতিকর প্রভাবের মধ্যে রয়েছে-ভালো মন্দ বিচার করার ক্ষমতা হ্রাস, দৃষ্টি ও মতক্রম,সিজোক্রোনিয়া রোগের সৃষ্টি,হার্ট ও ফুসফুসে প্রদাহ স্বাস্থ্যের অবনতি, গ্যাস্ট্রিক, আলসার, লিভার সিরোসিস ও ক্যান্সার রোগের উৎপত্তি, স্মরণশক্তি ও মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতা হ্রাস পায়, অস্বাভাবিক আচরণ, যৌনক্ষমতা হ্রাস, মানসিক সমস্যা ইত্যাদি জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে জীবনকে ধ্বংস করে দেয়।
সুতরাং মাদকের এ ছোবল যে কোনোভাবেই থামাতে হবে। সরকারের আইন-শৃংখলা বাহিনীর পাশাপাশি ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার,ছাত্র শিক্ষক,অভিভাবক, ব্যাংকার,কৃষক,মজুর,রাজনীতিবিদসহ সকল পেশাজীবিকে মাদকের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে মাদক নির্মূলে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তা নাহলে এর খেসারত আপনার,আমার সকলকেই গুণতে হবে। যুব সমাজ ধবংস হবে এবং সামাজিক মূল্যবোধ ভুলুন্ঠিত হবে। মাদক ব্যবসার সাথে সম্পৃক্তদের সঠিক তথ্য প্রদানে আইন-শৃংখলা বাহিনীকে সহায়তা করতে হবে।
সম্পাদকীয়
২৬ জুন ২০১৯
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur