প্রচলিত আয়কর আইন ও আসন্ন বাজেট ভাবনা বিষয়ে লিখেছেন ঢাকা ট্যাকসেস বার এসোসিয়েশনের সভাপতি এ্যাড. মোঃ আব্বাস উদ্দিন। চাঁদপুর টাইমস পাঠকদের কাছে তা তুলে ধরা হলো।
প্রতি বছরের মতো ২০১৯-২০২০ সালের বাজেট ঘোষিত হতে যাচ্ছে। ঘোষনার আগেই এবাজেট- ”মেঘা বাজেট” হিসেবে আলোচিত হচ্ছে।
অবশ্য বাজেট হতে হবে সস্তা হাত-তালি আর রাজনীতির উর্ধে। তবে যে কোন বাজেটের স্বার্থকতা নির্ভর করে এর সুষমতা তথা বাস্তবতার উপর। বাজেট প্রনয়ন যেহেতু আয়কর নির্ভর- সেহেতু আয়কর আইনে যাঁরা প্রাজ্ঞ, বাজেট প্রনয়নে তাঁদের মতামত বাজেট প্রনয়নকে নিঃসন্দেহে বাস্তব মুখী করে তুলতে সাহায্য করতে পারে। মনীষি মন্টেস্কু তাই বলেছেন ” আইন শাস্ত্রে যিনি যতোটা অজ্ঞ, আইন প্রনয়ন ও প্রয়োগে তিনি ততোটাই ব্যার্থ”।
আর এর সাথে যদি যুক্ত হয় দলীয় করনের ভাইরাস, যা ঘাটতি বাজেটের মুকুট পরে, প্রতিয়মান হয় বিদেশী ঋণ নির্ভর এবং অনেকটাই তামাশা রূপে। দার্শনিকের ভাষায় বলতে হয় ” ধার করে ঘি খাওয়ার চাইতে- পান্তা ভাতের কার্যকারিতাই বেশী”। প্রতি বছর ঘাটতি মেটাতে বিদেশী ঋন অথবা স্থানীয় ব্যাংক হতে ঋণ নেয়া কোনটাই খুব একটা কল্যানকর নয়। করের পরিমান তথা হার বৃদ্ধির চেয়ে করদাতার সংখ্যা বাড়নোই যুক্তি যুক্ত। আর এ ব্যাপারে জনগনকে উদ্বদ্ধ করতে হবে।
আয়কর আইন একটি জটিল বিষয়। তাই আয়কর আইন প্রনয়নে অধিকতর সচেতন হওয়া দরকার। গড্ডালিকা প্রবাহ বা ভাবাবেগের অবকাশ এখানে নেই বললেই চলে। আমাদের মত জনবহুল একটি উন্নয়নশীল দেশে যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদের অবদান প্রায় শূন্যের কোঠায়, রাজস্বের ভুমিকা সেখানে অপরিসীম । উন্নয়নের জন্য অবকাঠামোর বিনির্মান অত্যাবশ্যক। আর এ জন্য চাই সরকারের রাজস্ব আদায়ের যৌক্তিক লক্ষ্য। কর প্রদান যোগ্য জনগনকে আইনী শৃংখলে না বেঁধে উদ্বুদ্ধকরন জরুরী। অতœহননের পথ পরিহার করে জাতীয় প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নেয়াই সকল পরিকল্পনা ও সংকল্পের মুল প্রতিপাদ্য হওয়া উচিৎ।
সুপারিশ
১। ১৯৮৪ সনের আয়কর অধ্যাদেশের ১৯(২১), ১৯(২১এ), ১৯(২৪) ১৯(২৭) ও ১৯(২৮) ধারা গুলো বিনিয়োগকারীদের অধিক বিনিয়োগের পথকে রুদ্ধ করে। দেশে স্বনির্ভর না হওয়া পর্যন্ত উক্ত আইনগুলির কার্যকারিতা শিথীল করার জন্য সুপারিশ করছি।
২। প্রত্যেক জেলা শহরে কর অফিস স্থাপন এবং উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কর বিভাগকে সম্প্রসারন করা জরুরী। ইউনিয়ন পর্যায়ে অনেক সক্ষম লোক রয়েছেন যারা করযোগ্য আয়ের আওতায় পড়েন। করদাতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে- ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খোলা, জমি ক্রয়-বিক্রয়, রাজউক হতে প্লান পাশ করার সময়, মফশ্বল এলাকায় বিল্ডিং নির্মানে কমিশনার/চেয়ারম্যানের অনুমোতি প্রদানের সময় টি.আই.এন সার্টিফিকেট দাখিলে বাধ্যবাধকতা আরোপ করলে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির সাথে-সাথে করদাতার সংখ্যাও ব্যপক হারে বৃদ্ধি পাবে। এতে রাজস্ব বিভাগের আয়, পরিচিতি ও গ্রহন যোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে।
৩। দেশে নতুন-নতুন কোম্পানীকে অপ্রদর্শিত আয় দ্বারা শিল্প-কারখানা স্থাপনে এবং সহজ শর্তে ট্যাক্স হলিডে প্রদান করলে বিনিয়োগকারীগন- বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন এবং সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান। অদূর ভবিষ্যতে কর সংগ্রহ সম্প্রসারিত হবে। মালোয়েশিয়া এবং মেক্সিকো এ নীতি গ্রহন করেই আজকের অবস্থানে এসেছে।
৪। এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশীরা অনেক সময় অজ্ঞতার কারনে শত-শত কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে প্রেরণ করেন যা আয়কর আইন অনুসারে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করতে পারে না। ফলে এ অর্থ কালো টকায় পরিনত হয় বিধায় সহজ শর্ত-সাপেক্ষে ফ্ল্যাট বাড়ি, শিল্প কারখানায় ইত্যাদিতে বিনিয়োগের সুযোগ দিলে সরকার অনেক রাজস্ব আয় করতে পারবে।
৫। হাঁস-মুরগী, পশু পালন, দুগ্ধ খামার, বনায়ন, শর্ত সাপেক্ষে ব্যাক্তি মালিকানাধীন হাসপাতাল এবং সমবায় সমিতির আয়কে সম্পূর্ন রূপে করমুক্ত করার সুপারিশ করছি।
৬। ২০০৭-২০০৮ সালের পাশকৃত আয়কর বিধির অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে চাই যে, দেশে প্রচুর অ-প্রদর্শিত অর্থ বিদ্যমান রয়েছে। ধনী দেশের কথা বিবেচনায় না রেখে এদেশের প্রেক্ষাপটে ঐ সব অর্থকে দেশের ভেতরে বিনিয়োগের জন্য পুর্বের ন্যায় ১৯এ, ১৯এএ, ১৯এএএ, ১৯বি,১৯বিবি,১৯বিবিবি ও ১৯বিবিবিবিবি এবং আরো সহজ শর্তে বৈধ অপ্রদর্শিত অর্থ/ বিনিয়োগকে প্রদর্শনের সুযোগ করে দিলে- নতুন এয়ার পোর্ট, পদ্মা সেতু, মহা সড়ক ও ফ্লাইওভার নির্মান করা কঠিন হবে না এবং বিদেশী ঋণের উপর নির্ভরশীল হতে হবে না। বরং অ-প্রর্দশিত অর্থ যদি প্রর্দশনের সুযোগ করে দেয়া না হয় তাহলে উক্ত অ-প্রর্দশিত অর্থ মানি লন্ডারিং এর মাধ্যমে দেশের বাইরে চলে যাবে কষ্টার্জিত বিদেশী মুদ্রার কাঁধে ভর করে। তবে স্বল্প উন্নত দেশ হিসেবে অ-প্রদর্শিত টাকা প্রদর্শনের সুযোগের আওতা বাড়ালে সরকার অধিক রাজস্ব পাবে, ফলে বিদেশী ঋণ নির্ভরতা কমে যাবে।
৭। করদাতাগন ”ল” পয়েন্টে মহামান্য হাইকোর্টে আয়কর রেফারেন্স মামলা দায়ের করা কালীন বর্তমানে প্রচলিত ১৫% ও ২৫% কর এবং ট্রাইবুনাল দায়ের করা কালীন ১০% কর প্রদান প্রত্যাহার করা দরকার। তানা হলে বিচার প্রার্থীগন তাদের অধিকার ও ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হবে।
৮। বিশ্ব ব্যাংক ও ধনী রাষ্ট্রের বাধার কথা চিন্তা না করে অপ্রদর্শিত অর্থের উপর পূর্বের ন্যায় ৫% বা ৭.৫০% কর প্রদানের সুযোগ দেওয়ার সুপারিশ করছি। প্রয়োজনে এসআরও জারী করা যেতে পারে।
৯। আয়কর অধ্যাদেশের ৮২বিবি ধারায় দাখিলকৃত আয়কর রিটার্নকে অডিটের আওতায় নিলে আপত্তি নেই, তবে এর জন্য পূর্বের ন্যায় একটি রুল থাকা আবশ্যক যাতে করদাতাগন হয়রানি হতে রক্ষা পান। তানা হলে করদাতাগন ৮২বিবি ধারায় রিটার্ন দাখিলে নিরুৎসাহিত হবে এবং সরকারের অগ্রীম নগদ রাজস্ব পেতে অধিক সময় ক্ষেপন হবে।
১০। নতুন করদাতা ৮২বিবি ধারায় আয়কর রিটার্ন দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে, কারন করদাতাগন তাদের আয়কর প্রদানকৃত মুলধন যাহাই হোকনা কেন তাহা অর্থ আইন-২০১২ সালের ৮২বিবি(৫) বিধান মতে ৫ বৎসরের মধ্যে অন্যত্র হস্তান্তর বা বিনিয়োগ করতে পারবে না মর্মে যে আইনটি করা হয়েছে তাহা কর বান্ধব আইন নহে বিধায় ৫ বৎসরের বাধাটি প্রত্যাহারের সুপারিশ করছি।
১১। আয়কর আইন একটি জটিল বিষয়, এতে সরকার ও করদাতার অনেক গোপনীয় বিষয় থাকে যা আয়কর অধ্যাদেশের ১৬৩ ধারায় বর্নিত আছে। তবে উক্ত ধারার উপ-ধরা ১৬৩(এফ),(জি), (এইচ) ও অন্যান্য উপধারা সংশোধন বা বাতিল করা প্রয়োজন। কারন এজি অফিস কর্তৃক উক্ত ধরাগুলোর অজু হাতে করদাতার আয়কর নথি ও নিস্পত্তিকৃত আয়কর মামলা পুন:রায় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে পুন: কর নির্ধারন করেন, এটা কোন ক্রমেই গ্রহন যোগ্য নয়। এতে আরোও জটিলতা বৃদ্ধি পায়।
১২। ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের ১৭৪ ধারার অধীনে ২এ এবং ২বি বাতিলের জন্য জোর সুপারিশ করছি, কারন করদাতার নিকট আত¦ীয় এবং কর্মচারী পরিচয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসে তদবির করে থাকে। এ অবৈধ লেন-দেনের মাধ্যমে সরকার তার প্রকৃত আদায় যোগ্য কর হতে বঞ্চিত হয়। তবে এতদ্বিষয়ে সরকারকে নিদেন পক্ষে ৩০০/- টাকার নন-জুডিশিয়াল ষ্ট্যাম্পে মামলা পরিচালনা করার নিয়ম প্রবর্তন করতে হবে। এতে সরকারের প্রচুর আয় বৃদ্ধি পাবে।
১৩। সরকার ১৬সিসিসি নামক কালো আইনটি পুনরায় প্রবর্তন করে টার্ণওভার বা বিক্রয়ের উপর ০.৩০% হারে আয়কর ধার্য্য করেন। এখানে উল্লেখ্য করদাতার বৎসর শেষে ব্যবসায়ের লোকসানওতো হতে পারে। ফলে প্রদানকৃত অর্থের সমন্বয় করা কঠিন। এমতাবস্থায় ১৬সিসিসি ধারাটি বাতিল হওয়া আবশ্যক। এতে করে কর বিভাগের প্রতি করদাতাদের অনিহা জন্মে।
১৪। ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের ১২১এ ধারার আদেশের বিরুদ্ধে ট্রাইবুনাল ও হাইকোর্টে রেফারেন্স দায়েরের সুযোগ নেই বিধায় উক্ত ১২১এ ধরার প্রদত্ত রায়ের বিরূদ্ধে ন্যায় বিচারের স্বার্থে ১৫৮ ধারায় ট্রাইবুনাল এবং ১৬০ ধারায় হাইকোর্টে রেফারেন্স মামলা দায়ের করার বিধান করা জরুরী।
১৫। আয়কর বিভাগে দক্ষ জনবলের সংখ্যা কম থাকায় আশানারুপ, করদাতার সংখ্যা, কর আদায়, কর নিষ্পত্তি করনে ধীরগতিতে চলিতেছে বিধায় উক্ত বিভাগে লোকবল নিয়োগ দেওয়া অতিব জরুরী সংগ্রহ ও করের পরিধি সৃষ্টিতে অন্তরায় হয়ে দাড়ায়।
১৬। সর্বোপরি যুগের প্রয়োজনে, বাস্তবতার নীরিখে বিশাল সংখ্যক, কর আইনজীবীদের জন্য বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের মতো ’ট্যাক্স বার কাউন্সিল’ গঠন একান্ত জরুরী। এতে সরকার হবে উপকৃত আর কর আইনজীবীগনের যথার্থ স্বীকৃতিতে তাদের মেধা ও মননের বিকাশ ঘটবে। এ বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত যতটা জরুরী ততটাই কল্যানকর বলে মনে করি।
১৭। আয়কর বিভাগের যে সকল কর অঞ্চল আছে ঐ সকল কর অঞ্চল হইতে কর্মচারীদেরকে অন্য কোন কর অঞ্চলে বদলীর ব্যবস্থা নাই যার ফলে তারা একই কর অঞ্চলে ঘুরে-ঘুরে দুর্নীতিতে আবদ্ধ হয় বিধায় সরকার বহুগুনে রাজস্ব আদায় হইতে বঞ্চিত হয়। এমতাবস্থায় যে কোন কর্মচারীকে এক অঞ্চল হইতে অন্য অঞ্চলে বদলির নিয়ম চালু করিতে হইবে।
১৮। আয়কর আপীলাত ট্রাইবুনাল একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার কথা শুধু কাগজে কলমে আছে, আয়কর অধ্যাদেশের ১১ ধারায় জেলা জজ সহ অন্যান্য পদবীর লোক নিয়োগের বিধান আছে কিন্তু বর্তমানে শুধু দু’জন কমিশানর দিয়ে বেঞ্চ গঠন করা হয় ফলে বিচার ফরিয়াদিগন অনেক সময় ন্যায় বিচার হইতে বঞ্চিত হয়ে থাকেন। প্রত্যেক বেঞ্চে জুডিসিয়াল সদস্য নিয়োগ একান্তই দরকার তা না হলে ন্যায় বিচার ব্যহত এবং অন্যায় আশ্রয় পাবে। ইহা ছাড়াও আপীলাত ট্রাইবুনাল বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৯ মোতাবেক মহামান্য হাইকোর্টের অধীনে উল্লেখ করে আইন পাশ করতে হবে। আয়কর আপীলাত ট্রাইবুনাল মহামান্য হাইকোর্টে মামলার রেফারেন্স সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১১ ও ১১২ আনতে বাধ্য থাকার নির্দেশ থাকতে হইবে।
সরকারের আসন্ন মেঘা বাজেটের কৌশলী প্রয়োগের উপরই নির্ভর করে জাতীয় প্রবৃদ্ধি। এ বাজেটের একটি বৃহত অংশ যদিও ঘাটতি বাজেট হিসেবে বিবেচিত, আমাদের বিশ্বাস প্রাজ্ঞ পরিকল্পনা মন্ত্রী মহোদয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিজ্ঞ কর্তাব্যাক্তিদের সহায়তায়- এ বাজেটকে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হবেন এবং তা আপনার পক্ষেই সম্ভব। অপ্রদর্শিত আয়কে প্রদর্শনে উৎসাহিত করার মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করা হোক আরেকটি কৌশল। আমাদের জাতীয় অর্থনীতির নিরীখে এর কোন, ব্যতিক্রম আছে বলে মনে করি না। সর্বোপরি সকল প্রচার মিডিয়ায় আয়কর কি, এবং কেন সক্ষম ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কে কেন আয়কর দেয়া উচিৎ এবং রাষ্ট্র ও সভ্যতা বিনির্মানে আয়করের ভুমিকাকে তুলে ধরা একান্তভাবে অপরিহার্য। এতদ্বিষয়ে জনগনকে উদ্বুদ্ধ করন সময়ের দাবী। করাদাতাদের আস্থায় নিয়ে, কর আদায় করাই রাজস্ব আইনের স্বার্থকতা। তাং ০৭/০৪/২০১৯ইং
মোঃ আব্বাস উদ্দিন, এডভোকেট
বাংলাদেশ সূপ্রীম কোর্ট
সাবেক প্রেসিডেন্ট- ঢাকা ট্যাকসেস বার এসোসিয়েশন, ঢাকা
মোবাইলঃ ০১৮১৯-২৭২৭৯৬।