Home / বিশেষ সংবাদ / চুরিহাট্টার ছাইয়ে চাপা পড়েছে নাহিদার দু’সন্তানের স্বপ্ন
nahida-with-two-child

চুরিহাট্টার ছাইয়ে চাপা পড়েছে নাহিদার দু’সন্তানের স্বপ্ন

চকবাজারে চুরিহাট্টায় আগুনে অঙ্গার হয়েছেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য স্বামী। ওই আগুনে পুড়ে গেছে ছিমছাম পরিবারের অনেক স্বপ্নও। দুই সন্তানের ভবিষ্যতও এখন অনিশ্চিত।

এক মাস পরই বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেবে বাড়ির মালিক। অথচ একটি টাকা আয়েরও কোনো বন্দোবস্ত নেই। চার বছরের অবুঝ মেয়ের আবদার বাবাকে হাসপাতাল (মেয়ে এখনো জানে তার বাবা হাসপাতালে) থেকে নিয়ে আসার।

ছেলের পড়াশোনাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম। দু’চোখে এখন শুধুই অন্ধকার দেখছেন চুরিহাট্টায় আগুনে নিহত মঞ্জুর স্ত্রী নাহিদা বেগম। আগুনে সব কিছু পুড়ে শেষ হওয়ার সাথে সাথে এখন ছাইয়ের নিচে যেন চাপা পড়ছে নাহিদার দুই সন্তানের সব স্বপ্নও।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুরিহট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে মারা যান এ এস এম আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। তার স্ত্রী নাহিদা বেগম এখন সন্তান আর সংসারের কথা বলতে গিয়ে বারবারই যেন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ছিলেন।

নিজের দুঃখ আর কষ্টের মধ্যেও সন্তানদের কিছুই বুঝতে দিতে চান না তিনি। তাই দু’চোখের পানি মুছে আঁচলে মুখ ঢাকছেন প্রতিনিয়ত। কিন্তু এ কষ্ট কি লুকানো যায় কখনো? কেউ কি লুকাতে পেরেছেন?

না, নাহিদাও পারছেন না। লুকানোর শত চেষ্টার পরও যেন সব কিছু প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মকে মেনে নিয়ে দুই সন্তানের ভবিষ্যত গড়ার উপায়ান্তর খুঁজছেন তিনি। দুটি ফুটফুটে সন্তান আর স্বামীর আদর ভালোবাসা নিয়ে যেখানে সাজানো সংসারে ব্যস্ত থাকার কথা, আজ সেই নাহিদার সময় কাটছে এখন জায়নামাজে, তাসবিহ তাহলিল আর দোয়া দুরুদে।

চুরিহাট্টার ক্ষতিগ্রস্ত মূল ভবনের নিচেই ছিল মঞ্জুর ওষুধের দোকান : হায়দার মেডিকেল হল। এক নামেই সবাই চিনতেন। সাথে তার বিকাশ ও মোবাইলে ফ্লেজি লোডের ব্যবসাও ছিল। ২০১২ সালে মামার দোকানের মালিকানা নিয়ে এখানেই ওষুধের তথা ফার্মেসির ব্যবসা শুরু করেন মঞ্জু।

বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি থানার মির্জানগর গ্রামে। ২০০৫ বিয়ে করে একই জেলার বেগমগঞ্জ থানায়। নোয়াখালীতেই দীর্ঘ দিন চাকরি করেছেন কুমুদিনী ফার্মাসিটিকেলস্-এর অধীনে। এরপর ২০১২ সালে ঢাকায় এসে বসত গড়েন পুরান ঢাকায়।

সংবাদকর্মীর সাথে আগুনে নিহত আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর স্ত্রী নাহিদা বেগম বলছিলেন তার সংসার আর সন্তানদের কথা। বড় ছেলে রাসিনুর রহমান লালবাগের ওয়েস্টার্ন হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির এ শাখায় পড়ালেখা করছে। ছোট্ট মেয়ে ফাহমীদা। বয়স ৪ বছর। বেজায় দুষ্টু। ছোট হওয়ায় বাবাকে হারানোর উপলব্ধিটাও এখনো তার মধ্যে আসেনি।

তাই সকালে, বিকেলে কিংবা রাত দুপুরে যখনি বাবার কথা মনে পড়ছে, তখনি বারবার মায়ের কাছে এসে বায়না ধরছে হাসপাতাল থেকে বাবাকে নিয়ে আসার জন্য। সে জানে বাবা অসুস্থ্ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মেয়ের বায়নায় কষ্টে আঁচলে মুখ ঢাকেন মা নাহিদা বেগম। তবে ছেলে রাসিনুর সব কিছু বুঝেই যেন অনেকটা পাথর হয়ে গেছে। আগের মতো চঞ্চলতাও তার মধ্যে নেই। স্কুলের বন্ধুদের সাথে আগের মতো হৈ-হুল্লরও করে না। পড়ার টেবিলে অজান্তেই বইয়ের পাতায় গড়িয়ে পড়ে অশ্রু।

মঞ্জুর ওষুধের দোকান চুরিহাট্টায় থাকলেও ছেলের স্কুলের দূরত্বের কথা চিন্তা করে পরিবারসহ বাসা নিয়ে থাকতেন লালবাগের হরনাথ ঘোষ লেনে। সরু গলি পথ পার হয়ে চারতলায় ছোট্ট একটি ঘর। সেখানেই চারজনের গাদাগাদি করে থাকা। স্বামীর স্মৃতি চিহ্নটুকুও আর হয়তো ধরে রাখতে পারবে না নাহিদা বেগম। কেননা বাসা ভাড়ার টাকা বকেয়া হলে যেকোনো সময়েই বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেবেন বাড়ির মালিক।

নাহিদা জানান, আমার পরিবার আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নয়। আর আমার স্বামী মঞ্জুর পরিবারের কেউই আমার এবং আমার সন্তানের দায়িত্ব নিচ্ছে না। ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামে গিয়েও কোনো কিছু করার ব্যবস্থা নেই। চুরিহাট্টার কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেছেন কিছু দিন ঢাকায় থাকতে হবে। কিসের কাগজপত্রও যেন নিয়ে গেছেন তারা। বলেছেন সরকারি কিছু অনুদান পাওয়া যাবে।

নাহিদা জানান, আমার কাছে তো তেমন কিছু মনে হচ্ছে না। দেখতে দেখতে আজ ৪১/৪২ দিন গত হয়েছে। কিন্তু আমার তো একটি দিনও আর চলে না। দুই সন্তানকে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ানো ছাড়া আমার সামনে আর কোনো উপায়ই এখন নেই।

নাহিদা আরো জানান, স্বামীর যে অর্থকড়ি ছিল তা আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে। দোকানের ক্যাশ দোকানেই থাকত। বিকাশের টাকা সব সময় দোকানেই রাখা লাগল। আমার স্বামীর সাথে ওই দিনের আগুনের লেলিহান শিখায় পরিবারের শেষ সম্বলও পুড়েছে। আমার সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ার যে স্বপ্ন দেখতাম সেই স্বপ্নও আগুনে পুড়ে যাওয়া ছাইয়ের নিচে আজ চাপা পড়েছে। দুই সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে আজ আমি কিছুই আর ভাবতে পারছি না। মাথার উপরে যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। (নয়াদিগন্ত)

বার্তা কক্ষ
২ এপ্রিল, ২০১৯