Home / চাঁদপুর / চাঁদপুরে পিতৃহারা এক ক্ষুদে কণ্ঠযোদ্ধা দীপা রায় চৈতি
Chaite-660x330

চাঁদপুরে পিতৃহারা এক ক্ষুদে কণ্ঠযোদ্ধা দীপা রায় চৈতি

চাঁদপুরে প্রথমবারের মতো ‘সেরা কণ্ঠ শিল্পী’ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে দৈনিক মতলবের আলো পত্রিকা। এই প্রতিযোগিতার শতাধিক ক্ষুদে শিল্পী থেকে ফাইনাল রাউন্ডের টিকেট পাওয়া সেরা দশের সর্বকনিষ্ঠ দিপা রায় চৈতি। সে চাঁদপুর খ্রীষ্টিয়ান মিশন স্কুলের ২য় শ্রেণির শিশু শিক্ষার্থী।

আয়োজকদের বেঁধে দেয়া বয়সের মাপকাঠিতে চৈতির এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার কথা ছিলো না। রেজিস্ট্রেশনের দায়িত্বরতদের একটুখানি বেখেয়ালে চৈতির সুযোগ হয় বিচারকদের সামনে নিজেকে প্রমাণ করার। বাছাই পর্বেই তার কণ্ঠের যাদুতে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। পল্লিগীতি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী, লালনগীতি, নজরুল আর রবীন্দ্রগীতিসহ দেশের বহু কালজয়ী গাণ তার মুখস্ত-ঠোটস্থ।

প্রথম রাউন্ড থেকে দ্বিতীয় রাউন্ড- চৈতিকে বাদ দিতে অনেক প্রতিযোগির অভিভাবক দাবি তোলেন। তাদের যুক্তি হলো, প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার নীতিমালায় চৈতির বয়স খুবই কম। এমনটা হবে জানলে তারাও তাদের শিশু সসন্তানদের রেজিস্ট্রেশন করাতো। কারণ শিশুদের প্রতি সবারই একটু দূর্বলতা থাকে। এক পর্যায়ে বিচারকরাও চৈতীকে বাদ দেয়ার জন্য বিভিন্নভাবে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেন।

কঠিনসব গানের বিষয় তাকে বেঁধে দেন, যাতে করে শিশু চৈতি বাদ পড়ে যায়। কিন্তু সকল পরীক্ষার কপালে বিজয়ের তিলক পড়িয়ে অদম্য এই ক্ষুদে কণ্ঠযোদ্ধা পৌঁছে যায় সেরা দশের ফাইনাল রাউন্ডে।

২৩ জুন সন্ধ্যায় চাঁদপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে ফাইনাল রাউন্ডে সেরা দশ কণ্ঠশিল্পীর বিচারকার্য পরিচালার সময় কথাগুলো অকপটে স্বীকার করে নেন প্রতিযোগিতার সঞ্চালক। মঞ্চের অতিথি আর দর্শকসারিতে বসা সকল প্রতিযোগী, অভিভাবক, শিল্পী, কলাকৌশলীসহ উপস্থিত সকল দর্শক করতালি দিয়ে চৈতীকে অভিনন্দন জানায়। চৈতিীর চোখে তখন জল টলমল।

ঘাড় থেকে মাথা কিছুটা নিচে ঝুঁকিয়ে বসে আছেন বিচারকরা। মঞ্চের অতিথি, অন্যান্য প্রতিযোগী, তাদের অভিভাবক, শিল্পী, কলাকৌশলী আর উপস্থিত দর্শকদের মতো আমিও তখনো আঁচ করতে পারেনি সঞ্চালক এবার নতুন কোন গল্পেরর পাঠ উন্মোচন করবেন।

অনেকটা আবেগঘন কণ্ঠে তিনি জানালেন, ‘দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাউন্ডে চৈতির গান পাগল বাবা দিলীপ রায় মেয়ের সাথে ছিলেন। বিচারকদের পায়ে ধরে মেয়েকে সালাম করিয়ে বলেছেন, চৈতিকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। তার মেয়ে একদিন বড় শিল্পী হবে। আজকের আয়োজনে চৈতির বাবারও থাকার কথা ছিলো, কিন্তু তিনি আর বেঁচে নেই।’

গত ১ মে তিনি স্ট্রোক করে মারা গেছেন। কথাটা শোনা মাত্রই পুরো হলরুমে অদৃশ্য এক নীরবতা নেমে এলো। ক্ষানিক আগে মঞ্চ কাঁপানো বাহারী যন্ত্রগুলোড় অলক্ষ্যে বেজে উঠলো অদৃশ্য এক শোকের পিয়ানো। সে সুর আর শোকের মূর্ছনায় চারিদিকে পিনড্রপ স্যাইলেন। চৈতি ফুঁফিয়ে কাঁদছে। মঞ্চের বিচারক, সঞ্চালক আর অতিথি সবার চোখে জল টলমল। কেউ কেউ চোখের পানি আটকে রাখতে ব্যর্থ হয়ে গোপনে চোখ মুছে নিচ্ছে। হাতের উল্টো পিঠে আমিও কিছু জল আড়াল করে ফেললাম।

মাইক্রোফেনে কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে শিশু চৈতির, ‘আমি আজকে আমার বাবার জন্য গান করতে এসেছি, বাবা গান খুব ভালোবাসতেন, আপনারা আমার বাবার জন্য প্রার্থনা করবেন’। কান্নার মিছিলে চৈতির কণ্ঠ থেমে এলে, পাশের চেয়ারে তাকে বসিয়ে দেন সঞ্চালক। চেয়ারে বসে অনেকক্ষণ কান্না করে ক্ষুদে এই শিশু শিল্পী দিপা রায় চৈতি।

ছোট্ট এই জেলা শহরে এমন একটি আয়োজনটি নিঃসন্দেহে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। তাদের চেষ্টা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তবে আয়োজকদের আয়োজন ছাপিয়ে আমার কাছে বড় হয়ে উঠলো অদম্য এই ক্ষুদে শিল্পীর জীবনের গল্প। এতটুর বয়সে পিতাকে হারিয় মায়ের আঁচল ধরে যার কান্না করার কথা ছিলো, অথবা খেলনা নিয়ে বসে থেকে বাবা হারানোর কষ্ট ভুলে থাকার কথা ছিলো, অথচ সে মঞ্চে দাঁড়িয়েছে ‘বাবার জন্য গাইবে বলো, বাবার স্বপ্ন পূরণ করবে বলে’।

আমি হলফ করে বলতে পারি এই মঞ্চটি দেশের বড় কোনো টিভি চ্যানেলের হলো নিশ্চয় পরের দিনের জাতায় পত্রিকাগুলোতে চৈতিকে নিয়ে বহু সংবাদ হতো, ফিচার হতো। কিন্তু না, একটি মফস্বল শহর। তাই এখানের সব খবর জাতীয় দৈনিকে আসে না। আবার পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এমন অসংখ্য প্রতিভাবান চৈতিরা হারিয়ে, যেচ্ছে।

ভাবছি এমন পরিস্থিতিতে কান্না মুছে কি করে গাইবে শিশু মেয়েটি। কিন্তু ননা, আমাদের অবাক করে দিয়ে একে একে তার কণ্ঠে বেজে ওঠে লোক সংগীত, পল্লীগীতি ও আধুনিকসব কালজয়ী বাংলাগান। এই প্রতিযোগিতায় চৈতির ভাগ্যে কি আছে তার জন্য আমাদের ফলাফল ঘোষণার আগ পর্যন্ত আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে হয়তো । কিন্তু ছোট্ট এই মেয়েটি অদম্য ছুটে চলা, তার সংগ্রাম, কণ্ঠের যাদু আর মুখের মায়াময়তা এই দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী সবার মাঝে অনন্তকাল সে বেঁচে থাকবে।

দর্শকসরিতে বসা চৈতীর মা লিপি রায় অশ্রুসিক্ত চোখে জানান, তিনি এবং তার স্বামী প্রচন্ড সংগীত প্রিয় মানুষ। দু’জনেরই স্বপ্ন ছিলো গান করার। তবে পারিবারিক বাধ্যবাধকতা আর অর্থের অভাবে তাদের গান শেখা হয়নি। এজন্য মেয়েকে নিয়ে তাদের অনেক স্বপ্ন ছিলো। বিশেষ করে চৈতির বাবা দিলীপ রায় মেয়েকে অনেক বড় শিল্পী হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন।

লিপি রায় বর্তমানে চাঁদরের ব্রাকের একাউন্স হিসেবে কাজ করছেন। চৈতি চাঁদপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সংগীত বিভাগের শিক্ষার্থী। তার সংগীতগুরু মৃণাল সরকার ও অনিতা কর্মকার।

দৈনিক মতলবের আলোর গৌরবের ১১বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘সেরা কণ্ঠশিল্পী প্রতিযোগিতার ইভেন্ট পার্টনার হিসেবে রয়েছে ফেমাস ডেন্টাল কেয়ার।

লিখেছেন- সাংবাদিক আশিক বিন রহিম
আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৯: ২৫ পিএম, ২৪ জুলাই ২০১৮, মঙ্গলবার
ডিএইচ

Leave a Reply