গতকাল রাতে মধ্যরাতের টহল ডিউটি ছিল, সাধারণত রাত আড়াইটায় বের হতে হয় নির্দিষ্ট এলাকার তদারকির জন্য! যেহেতু রাতে বের হতে হবে তাই অফিস থেকে একটু আগেই বের হচ্ছিলাম, সময় তখন রাত ৯:৪৫! হঠাৎ ওয়্যারলেসে প্রচন্ড কোলাহলের শব্দ.! রেডিও অপারেটর ও ডিউটি অফিসারের সাথে কথা বলে জানলাম স্থানীয় জনতা তিনজন ভুয়া ডিবি পুলিশ সদস্যকে আটক করেছেন, যারা এক বয়স্কা মহিলাকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
এই প্রথম ভুয়া ডিবি পুলিশের টিমে এক নারী সদস্যের কথা শুনে কিছুটা কনফিউজড হলাম। যদিও ডিবি’র বিভিন্ন টিমে পুলিশের নারী সদস্যরা একের পর এক দুর্দান্ত কাজ করে চলেছেন। কিন্তু ভুয়া টিমে কখনো নারী সদস্য থাকে এরকম শুনিনি। তারপরও শুনে বেশ স্বস্তি পেলাম এবং মনে মনে স্থানীয় লোকজনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিলাম।
এই ঘটনায় কত যে ট্যুইস্ট তা বোধ করি সাদা চোখে বোঝার উপায় নেই। প্রায় কয়েক ঘণ্টা পর মূল ঘটনার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়। ভিকটিম প্রায় ৫৮ বছর বয়সী। এখানে চরিত্র কয়েকটি; এক রহস্যময়ী নারী, একটি সংস্থা, মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্র (নাম উহ্য রাখছি) ও কয়েকজন কথিত ভুয়া ডিবি পুলিশ সদস্য।
রহস্যময়ী নারী, নাজ মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে গিয়ে জানান, তার মা মাদকাসক্ত এবং তাকে পুনর্বাসিত করা দরকার। নির্দিষ্ট ঠিকানা দিয়ে তিনি বলেন, যেহেতু তার মা আসক্ত তাই আসতে চাইবেন না, জোর করে নিয়ে আসতে হবে! পুরো পরিবার দুর্ভোগ পোহাচ্ছে এ বিষয়ে। যথারীতি রিহ্যাবের লোক পৌঁছে যান এবং মধ্যবয়সী মাকে জোর করে গাড়িতে তুলতে যান! আর মেয়ে নাজ ফোনে ফোনে নির্দেশনা দিতে থাকেন। মা (সম্পূর্ণ সুস্থ) গাড়িতে উঠবেন না…!!
মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে প্রায় হাজারেরও অধিক লোক জমায়েত হয়ে যায় এবং মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রের সদস্যরা হয়ে যান ভুয়া ডিবি পুলিশ সদস্য। এক, দুই করে উত্তেজিত জনতা সকলেই কথিত ভুয়া ডিবি সদস্যদের পেটানো শুরু করেন! তাদের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে আহত হয় দু’জন পুলিশ সদস্য! এই পুলিশ দিয়ে যে কি হবে, শুধু কাজ না করে মার খায়, কি দরকার ছিল শুধু শুধু কথিত অভিযুক্তদের বাঁচানো? হোক না তারা ভালো লোক। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমাদের মার খাওয়া পুলিশ, উত্তেজিত জনতার কাছ থেকে ওই তিনজন সদস্যকে রীতিমত ছিনিয়ে এনে গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিয়ে আবার থানায় নিয়ে আসেন।
এবার শুরু হয় পঞ্চকেন্দ্রিক সমস্যা! একদিকে ভিকটিম বয়স্কা মা, একদিকে তার মেয়ে নাজ, অন্যদিকে মাদকাসক্ত পুনর্বাসন সংস্থা, আরও একটি সংস্থা ও ভুয়া ডিবি পুলিশ সদস্যরা। নাজকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় আপনি আপনার সুস্থ মাকে রিহ্যাবে পাঠাতে চান কেন? ‘তিনি বলে উঠেন কে মা? উনি আমার মা নন’
‘মাকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলে উঠেন, সে উচ্চ শিক্ষিতা হয়েছে তাই আমার মত মহিলাকে মা হিসেবে মানতে চায়না!’
নাজকে যখন বললাম, ‘আপনার মা নয়, আপনি তাও বাসায় রিহ্যাবের লোক পাঠিয়েছেন কেন? আপনি তো অপরাধ করেছেন।’
এতক্ষণ খুব শক্ত থাকা নাজ এবার অবস্থান থেকে সরে এসে চুপ হয়ে যান! ভিকটিম মাকে যখন বললাম কি করতে চান, তিনি বলেন, ‘একটা সমঝোতা করে দিন।’
আহা! এই হলো মা!!
ভুলে ভরা সময়ে কার কি ভুল ছিল:
১) উত্তেজিত জনতা:
একজন সুবিবেচকও ছিলেন না, যিনি একটু বোঝার ও জানার চেষ্টা করবেন যে আসলে হচ্ছেটা কি? জনতার স্রোতের মাঝে যারা খুব কথা বলছিলেন তাদের মাঝেও একজন স্থিরবোধ সম্পন্ন মানুষকে দেখা যায়নি। উপরন্তু পুনর্বাসন কেন্দ্রের গাড়িটাও দুমড়ে মুচড়ে ফেলে! ০৩ জন লোক অযথাই মরতে বসেছিলেন, পুলিশ সঠিক সময়ে না পৌঁছালে অনেকেই খুন মামলার আসামি হয়ে যেতেন! তাই এরূপ অস্থির সময়ে দয়া করে মাথা ঠান্ডা রেখে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাহায্য নিন।
২) মেয়ে-নাজ :
এই প্রকারের উচ্চ শিক্ষিতা মেয়ে যে, নিজের বয়স্কা মায়ের অস্তিত্বকে বিলীন করতে চায় তাদের অস্তিত্ব এই দুনিয়ায় সৃষ্টিকর্তা যেন শূন্যের কোটায় নিয়ে আসেন!
৩) রিহ্যাব সেন্টার:
পরিবারের সদস্যদের সরাসরি উপস্থিতি ছাড়া আসক্ত ব্যক্তি নিজেদের জিম্মায় নিতে গেলে, ভুয়া ডিবি’র তকমা লেগে যাবে তাই সাধু সাবধান!
৪) পুলিশ :
বোকা পুলিশ জানতোই না নিরপরাধীকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেদের চরম বিপদে পড়তে হবে! তাও ভালো কেউ মোবাইলে ভিডিও করে লিখেননি ০৩ অপরাধীকে জিম্মায় নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে থানা পুলিশ!
এবং সবশেষে
৫) মা :
মায়েরা কখনো ভুল করেন সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত করে, কখনো বা তাদের পথকে মসৃণ করে! বৃদ্ধ বয়সে মায়েরা আবারও ভুল করেন অপরাধী সন্তানের ভুল ক্ষমা করে দিয়ে। ক্ষমা করতে করতে একদিন জীবন প্রদীপ নিভে যায় আমাদের মায়েদের….!
মায়ের হস্তক্ষেপে পুরো বিষয়টি মীমাংসা হয়ে যায়, যে যার গন্তব্যে চলে যান! মা একটু থেকে যান, একটু কথা বলতে চান… ‘নিতান্তই ছোট এক পুলিশ কর্মকর্তা একাকিনী মাকে আশ্বস্ত করেন, তার এক ছেলে আছে সব সময়ের জন্য! মা যেন একটুকুও ভয় না করেন।’
মা হাসিমুখে ফিরে যান……
মায়ের মুখে প্রশান্তির হাসি-সেটিই আমাদের আশীর্বাদ!
(লেখক: সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার (ডেমরা জোন)
(লেখকের ফেসবুক পেইজ থেকে সংগৃহীত)