আজ সকালে গুগলে ঢুকে দেখি, গুগলের চিরাচরিত ‘Google’ লেখাটির পরিবর্তে নতুন একটা গুগল ডুডল দেখাচ্ছে। ডুডলটিতে গুগল লেখাটি লেখা হয়েছে গাঢ় লাল রঙে। আর চারপাশে বটল গ্রিন বর্ডার। পিছনের পটভূমিতে নীল আকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। Google লেখাটির প্রথম ‘ও’- এর জায়গায় বসানো হয়েছে একজন কবির মুখ। সেখানে সাদা চুল আর চশমা পরা কবি গালে হাত দিয়ে কবিতা লিখছেন, বাতাসে তাঁর সফেদ চুল উড়ছে- এমন দৃশ্য দেখানো হচ্ছে। কবির গায়ে সবুজ শার্ট আর হাতে ঘড়ি। দেখে চিনতে পারলাম না। আমার মস্তিষ্ক চট করে কবি শামসুর রাহমানকে চিনতে পারলো না।
তাই ডুডলে ক্লিক করলাম। ওটা আমাকে শামসুর রাহমানকে নিয়ে সার্চের পাতায় নিয়ে গেল। তারপরই মনে পড়লো, আজ শামসুর রাহমানের ঊননব্বইতম জন্মবার্ষিকী। সেই উপলক্ষে ডুডলটি গুগল তৈরি করেছে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে। এই ডুডলটি কেবল বাংলাদেশে প্রদর্শন করছে গুগল। আহা! গুগল মনে করিয়ে না দিলে সারাদিনে হয়তো মনেই থাকতোই না, আজ কবির জন্মদিন। থাকবেই বা কেমন করে? ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের মাধ্যমিকের সাহিত্য কণিকা বইয়েই যে কবির জন্মতারিখ ভুল দেওয়া রয়েছে!
প্রসঙ্গে ফিরে যাই। কবি শামসুর রহমান আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বলে হয়ে থাকেন একটা বিশেষ কারণে। তাঁর “একটি ফটোগ্রাফ” নামের একটা কবিতা আছে। ওই কবিতাটি আমার মনে দাগ কেটেছিলো খুব করে। কবিতার ভাবার্থ হলো- দুই বছরের মাথায় লেখক তাঁর মৃত ছেলের কথা ভুলে গেছেন।
এই কবিতা আমি যখন প্রথম পড়েছি, তখন সবে আমার মা মারা গিয়েছিলেন। প্রচণ্ড হাহাকার আর কষ্ট গুমরে মরছিলো বুকের ভেতর। কবিতা পড়ে মনে হয়েছিলো, ‘একদিন কি তাহলে আমিও আম্মুকে ভুলে যাবো? আজ যে এতো বেশি হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তা কি শুকনো চরের মতো হয়ে যাবে? এও কি সম্ভব? কবি তো তাইই বলেছেন তাঁর কবিতায়!’
তখন বিশ্বাস করিনি কবিতাটি। কিন্তু সত্যিই একসময় যখন কষ্টগুলো ফিকে হতে শুরু করেছে, তখন থেকেই শামসুর রহমানের কবি স্বত্বাকে সম্মান করতে শুরু করেছি। তাঁর প্রতি ভালোবাসা জন্মাতে শুরু করেছে। কবিরা বুঝি এমন অন্তর্যামীই হয়?
১৯২৯ সালের আজকের দিনে কবি ঢাকার মাহুতটুলিতে জন্ম নিয়েছিলেন। শামসুর রাহমানের মায়ের নাম আমেনা খাতুন, পিতা মুখলেসুর রহমান চৌধুরী। পৈত্রিক বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার পাড়াতলী গ্রামে হলেও ঢাকা নগরেই তাঁর বেড়ে ওঠা। ১৯৪৫ সালে ঢাকার পোগোজ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। তারপর দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধারণ করেন স্নাতক ডিগ্রি।
তাঁর পেশা ছিলো সাংবাদিকতা। ১৯৫৭ সালে দৈনিক মর্নিং নিউজে সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। তারপর বিভিন্ন সময়ে রেডিও বাংলাদেশ, দৈনিক গণশক্তি নামক পত্রিকাগুলোয় সাংবাদিকতা করেছেন। শুধু সাংবাদিকতাই নয়, কবি দৈনিক বাংলার সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘ দিন।
কবি শামসুর রাহমান একনিষ্ঠভাবে কাব্য সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৬৬। নাগরিক কষ্ট, দুঃখ-সুখ, প্রত্যাশা, হতাশা, বিচ্ছিন্নতা, বৈরাগ্য ও সংগ্রাম তাঁর কবিতায় বিশেষভাবে উঠে এসেছে। বাঙালির বিভিন্ন সংগ্রামের গৌরবদীপ্ত অধ্যায়, যেমন- মুক্তিযুদ্ধ, বিভিন্ন গণ আন্দোলন বার বার ফিরে এসেছে তাঁর কাব্যে। দেশপ্রেম ও সমাজ সচেতনতায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন তিনি। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬০ সালে। এছাড়াও তাঁর প্রধান কাব্যগ্রন্থ হলো- বিধ্বস্ত নীলিমা, নিরালোকে দিব্যরথ, বন্দী শিবির থেকে, আমি অনাহারে, বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে ইত্যাদি। কবির মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে লেখা কবিতাগুলো পড়লে গায়ের পশম যেন সব দাঁড়িয়ে যায়। এতোই গভীর ছিলো তাঁর লেখনী।
বিখ্যাত এই কবি উপন্যাস লিখেছেন ৪টি, প্রবন্ধগ্রন্থ ১টি, ছড়ার বই ৮টি। তিনি কিছু অনুবাদ কবিতার বইও বের করেছিলেন। তাঁর কবিতায় অতি আধুনিক কাব্যধারার বৈশিষ্ট্য সার্থকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। প্রকৃতির উপর নির্ভর করে তিনি উপমার প্রয়োগ করতেন। ওদিকে তাঁর কবিতার বিষয় ও উপাদান ছিলো শহরকেন্দ্রিক।
সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭৯ সালে কবিকে তার পঞ্চাশ বর্ষপূর্তিতে জাতির পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। ষাট বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতীয় সংবর্ধনা দেয়া হয় ১৯৮৯ সালে।
কবি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক এবং স্বাধীনতা পদকসহ দেশ-বিদেশের অনেক পুরস্কার অর্জন করেন। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট এই দেশপ্রেমিক কবি ইহলোক ত্যাগ করে পাড়ি জানান পরলোকে।
আজ ঊননব্বইতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কবি শামসুর রহমানের প্রতি বিনম্র সম্মান জ্ঞাপন করছি।
বার্তা কক্ষ
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur