সকাল ৭টা, মোবাইল ফোনে অ্যালার্ম বেজে উঠতেই ঘুম থেকে উঠে পড়লেন জাকির হোসেন অর্ক। অ্যালার্ম বন্ধ করে মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে ওঠা ফেসবুক নোটিফিকেশন দেখে নিলেন। এরই মধ্যে ফেসবুক চ্যাটবক্সে বন্ধু ফারহাদকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘ক্লাস কয়টায়’? বন্ধুর কাছ থেকে উত্তর এলো, সকাল ১০টায়। তারা দুজনই বনানীতে অবস্থিত একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ শিক্ষার্থী।
অর্ক এরই মধ্যে প্রস্তুতি শেষ করে বের হলেন ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে। বন্ধু ফারহাদকে হোয়াটস অ্যাপে কল দিয়ে রাজধানীর শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডে মিলিত হলেন। বনানীর উদ্দেশে বাসে চড়ে বসলেন দুই বন্ধু। চলছে বাস, দুজনই পাশাপাশি বসা। কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। দুজনই ব্যস্ত নিজ নিজ স্মার্টফোন ব্যবহার নিয়ে। অর্ক কানে হেডফোন লাগিয়ে বাংলা র্যাপগান শোনার পাশাপাশি ফেসবুক ব্যবহার করছেন। অন্যদিকে ফারহাদ একটি গেমস নিয়ে ব্যস্ত।
সারাদিনই তারা ব্যস্ত সময় কাটান। অধিকাংশ সময় কাটে স্মার্টফোন নিয়ে। এ অবস্থা শুধু অর্ক বা ফারহাদের নয়। বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ তরুণ-তরুণীই স্মার্টফোনে বন্দি জীবন পার করছেন। মাত্রাতিরিক্ত মুঠোফোন ব্যবহারে শারীরিক ও মানসিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে যুব সমাজ। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ব্যবহার ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়ছে তরুণ সমাজ। এতে তাদের শরীরের চেয়ে মানসিক ক্ষতি হচ্ছে বেশি।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) প্রকাশিত গত নভেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সক্রিয় মোবাইল ফোন সংযোগের সংখ্যা ১৪ কোটি ছাড়িয়েছে। মোবাইল ফোনের সক্রিয় সংযোগ বা সিমের সংখ্যা ১৪ কোটি সাত লাখ। এ সময়ে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাত কোটি ৯২ লাখ।
রাজধানীর একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন আতিকুল ইসলাম। এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক তিনি। ছেলে একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘ছেলেটা প্রায় সারাদিনই তার মোবাইলে ডুবে থাকে। কখনও ফেসবুক, কখনও কথা বলা আবার কখনও ইন্টারনেট ব্যবহার করে। আজকালের ছেলে-মেয়েদের যে কী হলো, সব সময়ই মোবাইলে পড়ে থাকে। আমরা যখন ছোট থেকে বড় হয়েছি, তখন খেলাধুলা করতাম, ঘুরতে যেতাম, বন্ধুরা মিলে হৈ-হুল্লোড় করতাম। কিন্তু বর্তমান সময়ের ছেলেরা খেলাধুলা করে না, তারা আড্ডা দেয় কিন্তু এর মধ্যেও মোবাইলে ডুবে থাকে।’
তিনি বলেন, ওই বয়সে আমরা জীবন-জীবিকা, জীবনের নানা পরিকল্পনা নিয়ে অনেক কিছু ভাবতাম। গল্প-উপন্যাস পড়তাম। কিন্তু এখনকার ছেলে-মেয়েরা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের মাঝে থাকলেও ফোনে আসক্ত থাকে বেশি। তাদের ইনোভেটিভ কিছু চিন্তার ক্ষমতা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত স্মার্টফোন ব্যবহারের ফলে এমনটি হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আক্তার বলেন, ‘আমাদের বাচ্চারা বর্তমানে ক্রিয়েটিভ কোনো চিন্তা করে না। নতুন প্রজন্ম সারাক্ষণ স্মার্টফোনে ডুবে থাকে। আগে বাচ্চারা প্রচুর ছোটাছুটি ও খেলাধুলা করতো। কিন্তু এখন স্মার্টফোন অ্যাডিকশনের কারণে শারীরিক, মানসিক ক্ষেত্রে চাপ বাড়ছে। তাদের জন্য বিকল্প বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে।’
মুঠোফোনে কেন এত আশক্তি- এর কোনো সদুত্তর নেই আশক্ত তরুণ-তরুণীদেরও। দিনের সিংহভাগ সময় মুঠোফোনে পার করা কয়েকজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘স্মার্টফোন-ইন্টারনেট এখন আমাদের জীবনেরই একটি অংশ। এমনও হয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ে খাবার গ্রহণের বিষয়টিও মনে থাকে না। সময় কীভাবে পার হয়, বলতে পারি না।’
‘কেন জানি একরকম অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, একধরনের আসক্তি কাজ করে। স্মার্টফোন ছাড়া একটি দিনও কল্পনা করতে পারি না। ফেসবুক-ইন্টারনেট ব্রাউজিং, গেমস খেলা, গান শোনা, কথা বলাসহ বিভিন্ন কাজে দিনের সিংহভাগ সময় কাটে স্মার্টফোনে। যে কারণে পড়ালেখা, খেলাধুলা বা ঘুরে বেড়াতে মন চায় না।’
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, আগে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যে ধরনের বন্ধন ছিল, এখন তা নেই৷ ফলে পরিবার থেকে অনেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে অনেকে সময় কাটাতে বেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে ঝুঁকে পড়ছে।
গবেষণা তথ্য বলছে, মুঠোফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারে দৃষ্টি বৈকল্য হতে পারে। হেডফোন ব্যবহার করে উচ্চশব্দে গান শুনলে অন্তঃকর্ণের কোষগুলোর ওপর প্রভাব পড়ে এবং মস্তিষ্ক অস্বাভাবিক আচরণ করে। মুঠোফোন থেকে হাই ফ্রিকোয়েন্সির ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন নির্গত হয়। ক্ষতিকর এ তরঙ্গের সঙ্গে মস্তিষ্কের ক্যান্সারের যোগসূত্র থাকতে পারে। স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ, ডেস্কটপের অতিরিক্ত ব্যবহার ঘুমের সমস্যা বা নিদ্রাহীনতার অন্যতম কারণ।
স্মার্টফোনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক প্রসঙ্গে অধ্যাপক সালমা আক্তার বলেন, “রাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য বিশাল অংশই নির্ভর করছে তরুণ প্রজন্মের ‘ক্রিয়েটিভ অ্যাক্টিভিটি’র (সৃজনশীল অনুভূতি) ওপর। সেদিক থেকে তো বলতে হয়, আমাদের বাচ্চারা বর্তমানে ক্রিয়েটিভ চিন্তা করছে না। নতুন প্রজন্ম সারাক্ষণ স্মার্টফোনে ডুবে থাকে।”
মাত্রাতিরিক্ত স্মার্টফোন ও সোশ্যালমিডিয়া আসক্তির ক্ষতিকর দিক বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘এর ফলে আমাদের সামাজিক সম্পর্কগুলোও কমে যাচ্ছে। পারিবারিক বন্ধন অনেক সরু হচ্ছে। সিনিয়রদের সঙ্গে জুনিয়র, বাচ্চাদের সঙ্গে বাবা-মায়ের ইন্টারেকশন (যোগাযোগ) কমে যাচ্ছে। ফলে জেনারেশন গ্যাপ (প্রজন্মগত ব্যবধান) তৈরি হচ্ছে।‘
‘তাদের মধ্যে তো ইন্টারেকশন ও ইমোশনাল সাপোর্ট নেই। সেদিক থেকে তো সামাজিক অসুবিধা তৈরি হচ্ছে। বাবা-মায়েরা বুঝতে পারছেন না বাচ্চারা কী ধরনের চিন্তা-ভাবনা করছে। আবার বাচ্চারা মনে করছে বাবা-মা তাদের কাছে খুব বেশি প্রয়োজনীয় নয়। তাই তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অধিক সময় দিচ্ছে, নেশাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া বাচ্চারা যে ধরনের গেমস খেলে, তা ফলো করাও কঠিন হয়ে যায়। যেগুলো মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলে।’
উত্তরণের উপায় হিসেবে তিনি বলেন, ‘আগে বাচ্চারা প্রচুর ছোটাছুটি ও খেলাধুলা করতো। কিন্তু এখন স্মার্টফোন অ্যাডিকশনের কারণে শারীরিক, মানসিক ক্ষেত্রে চাপ পড়ছে। তাই বাচ্চাদের জন্য বিকল্প বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন- খেলাধুলার আয়োজন, কমিউনিটিতে ইন্টারেকশন বাড়ানো, সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা এবং জাতীয় প্রতিযোগিতাগুলোতে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। অন্যথায় তারা আরও বেশি বিষণ্নতার মধ্যে ধাবিত হবে।’
অধ্যাপক সালমা মনে করেন, বাবা-মা ব্যস্ত থাকলে বাচ্চারা তাদের সঙ্গে মিশতে পারে না। তখনই বাচ্চারা বিভিন্ন বিষয়ে আসক্ত হয়ে পড়ে। তাই বাবা-মায়ের উচিত বাচ্চাদের মোটিভেট (প্রেরণা জোগান) করা, একটু হলেও সময় দেয়া। তারা কোন বিষয়ে আগ্রহী, সেটা খুঁজে বের করা। ফেসবুক, মোবাইলের বিকল্প বিনোদনের ব্যবস্থা করা। সেটি টিভি প্রোগ্রামও হতে পারে। এতে বাচ্চারা অনেক বেশি আগ্রহী থাকে। এ বিষয়ে মিডিয়াও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘পরিস্থিতির কারণে আমাদের দেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় প্রযুক্তির প্রভাব এবং এর ব্যবহার নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। প্রযুক্তির ব্যবহার এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সরকার যেমন চায় না তেমনি জনগণও প্রযুক্তিকে এড়িয়ে নীরব থাকতে পারে না। সেটি কোনো সমাধানও নয়। তাই প্রযুক্তি আমাদের ব্যবহার করতে হবে। তবে আমাদের মূল স্পিড হচ্ছে প্রযুক্তির ইতিবাচক, গঠনমূলক ও উন্নয়নের দিকগুলো। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যখন আমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারব, তখন আমাদের রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সামাজিক বিকাশ ত্বরান্বিত হবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তির ব্যবহার এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের রাষ্ট্রে এটির ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই। কত বছর বয়সী ছেলে-মেয়েরা স্মার্টফোন ব্যবহার কারতে পারবে, সে বিষয়েও কিছু বলা নেই। নীতিনৈতিকতার বিষয়ে বয়সের একটা প্রভাব আছে। স্কুল-কলেজে যাওয়া শিক্ষার্থীদের যতই নৈতিকতা শিখানো হোক, নিষেধ করা হোক; সামনে কোনো উপকরণ থাকলে সেটা তারা ব্যবহার করবেই।’
‘অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ না করা পর্যন্ত তাদের স্মার্টফোন ব্যবহার করতে দেয়া উচিত নয়। সেক্ষেত্রে আমরা তাদের পড়াশোনার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে পারি’- মন্তব্য করেন তিনি।
‘এখন আমরা শুধু একমুখী ফেসবুক ব্যবহার করছি এবং এর মাধ্যমে নানা ধরনের প্রত্যাশিত-অপ্রত্যাশিত বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি। অপ্রত্যাশিত বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়ে কিশোর-কিশোরীরা সংযত আচরণ করছে না। মানুষে মানুষে ব্যবধান তৈরি হচ্ছে। যখন ব্যবধান তৈরি হবে, তখন সামাজিক বিকাশ, সামাজিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাবে এখন আমরা শিক্ষাটাও যথাযথভাবে দিতে পারছি না। শিক্ষার্থীরা দিনের অধিকাংশ সময় ফেসবুকে ব্যস্ত থাকে। এর প্রভাবে তারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ত হয়।’
‘ফেসবুকে অনেকে অধিকার ও মর্যাদাহানিকর স্ট্যাটাস ও কমেন্ট করছে। এর মধ্য দিয়ে আমরা পারস্পরিক একটা অসহিষ্ণু স্টুডেন্ট কমিউনিটি তৈরি করছি। যারা আগামীতে দেশকে নেতৃত্ব দেবে, সমাজকে নেতৃত্ব দেবে। সে জায়গায় তারা নেতৃত্ব দিতে পারবে না, কারণ তারা সামাজিকভাবে অসুস্থ। এমন কমিউনিটি কখনও একটা বৃহৎ কমিউনিটিকে লিড দিতে পারে না।’
সমাধান হিসেবে সমাজ ও অপরাধ বিষয়ক এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এজন্য আমরা শুধু ফেসবুককে পুরোপুরি দোষারোপ করতে পারি না, আমাদের সিস্টেমে গলদ আছে। সেক্ষেত্রে আমরা কিছু মূল্যবোধ অনুসরণ করতে পারি। ফেসবুক ও স্মার্টফোন ব্যবহারের বিষয়ে একটি বয়সসীমা ঠিক করতে হবে, পাশাপাশি শিক্ষক কমিউনিটি ও রাষ্ট্রের অন্যান্য কাঠামোগুলোকে ইতিবাচকভাবে এগিয়ে আসতে হবে।’
‘রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল জায়গাটা অপেক্ষাকৃত কম। অভিভাবকদের সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। এরপর শিক্ষকদের দায়িত্ব। অভিভাবক যদি স্মার্টফোন কিনে না দেন, তাহলে সন্তানের ক্ষমতা নেই স্মার্টফোন ব্যবহার করার। যোগাযোগের স্বার্থে তাকে অ্যানালগ ফোন দেয়া যেতে পারে।’
তৌহিদুল হক আরও বলেন, ‘অভিভাবকদের সঙ্গে সন্তানদের যে দূরত্ব সেটা কমাতে হবে। যতক্ষণ এ দূরত্ব কমানো না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলো বাবা-মায়ের সঙ্গে শেয়ার করবে না। পরবর্তীতে তারা নানা ধরনের অসহিষ্ণু কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়বে।’
‘মানসিক ও সামাজিকভাবে বিকলঙ্গ হওয়ার আগেই সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে। যারা আসক্ত হয়ে পড়েছে সেক্ষেত্রে স্কুল-কলেজের শিক্ষক ও অভিভাবকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তাদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।’
(জাগো নিউজ)