জানুয়ারী মাস মানেই শীত, আনন্দ, পিকনিক, নতুন বছরের নতুন মাস আর বাণিজ্য মেলা। এই বাণিজ্য মেলাকে ঘিরে কত মানুষের কত স্বপ্ন, কত মানুষের দুইটা টাকা বেশি আয় করার ইচ্ছা, কত মানুষের নিজের ব্যবসা প্রচার করার উত্তম উপায় ইত্যাদি আরো নানান কিছু। বড় বড় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ছোট খাটো ব্যবসায়ী, এমনকি রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা হকাররাও এই বাণিজ্য মেলার জন্য মুখিয়ে থাকে।
আমরা চারজন এক প্রোজেক্টের কাজে বাণিজ্য মেলায় গেলাম। মেলায় ঢুকেই নাক বরাবর হাঁটা দিলাম। আমাদের প্রথম ইচ্ছা ছিলো আগে পুরো মেলা ঘুরবো, তারপর কাজ বাজ করবো। তো নাক বরাবর হাঁটতে হাঁটতে পিছনে তাকিয়ে দেখি এক সহকর্মী হাওয়া। পিছনে কোথাও তাকে দেখতে পাচ্ছি না। ফোন দিয়ে জানলাম সে কোন এক দোকানে কিছু একটা দেখে আটকে আছে। আমাদের বাকি ৩জনকে ৫মিনিট অপেক্ষা করতে বললো। আমরা ৩জন সেখানেই দাঁড়িয়ে অন্যজনের অপেক্ষা করতে থাকলাম।
আমরা ৩জন দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে গল্প করছি। আমাদের একজনের হাতে একটা পানির বোতল ছিলো। সে শেষ পানিটুকু খেয়ে বোতলটা হাতে রেখে ডাষ্টবিন খুঁজছিলো। হঠাৎ এক মহিলা এসে বোতলটা চেয়ে বসলো। সহকর্মী মহিলাকে বোতলটা দিয়ে দিলো। মহিলা বোতলটা নিয়ে আমাদের পাশেই বাবল বিক্রি করা এক ব্যক্তির কাছে যেয়ে দাঁড়ালো এবং পাশে রাখা বস্তাতে বোতলটা রেখে দিলো। সেই বস্তাতে দেখা যাচ্ছে আরো অনেক বোতল রয়েছে। মহিলাটা দেখতে একেবারে হ্যাংলা পাতলা, ওড়নাটার এক অংশ মাথায় দিয়ে কানের পাশে গুঁজে রেখেছে। অন্য অংশটা সামনে এনে সুন্দর করে নিজের শরীর ঢেকে রেখেছে। বোতলটা বস্তায় রেখেই ‘বাবল প্যাকেজ ১০০’ ‘বাবল প্যাকেজ ১০০’ বলে চিৎকার করছে আর লোকটা মুখ দিয়ে বাবলে ফু দিয়েই যাচ্ছে। কৌতুহলবশত হোক আর যাই হোক, আমার হঠাৎ ওই মহিলার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হলো। আমি আমার সহকর্মীদের কথাটা বলতেই ওরাও সায় দিলো।
আমরা তিনজন যেয়ে আগে জিজ্ঞেস করলাম বাবলের দাম (যদিও আমরা প্যাকেজের দাম জানি। এমনি ভাব জমানোর জন্য জিজ্ঞেস করা!), কমে বিক্রি হবে কিনা ! কয় ধরণের বাবল আছে ইত্যাদি। ৩জন মিলে নানা ধরণের প্রশ্ন করতে থাকলাম। প্রশ্ন করতে করতে আমি কখন যে গল্প শুরু করে দিলাম আল্লাহই ভালো জানে! কথায় কথায় তারা কোথায় থাকে, তাদের সম্পর্ক, পরিবার, আয় -রোজগার সব জেনে নিলাম।
ভাই-বোন
মহিলার নাম জামিনা আর তার ভাই জাকির হোসেন। সম্পর্কে তারা আপন মায়ের পেটের ভাইবোন। দুইজনেরই সংসার , ছেলে -মেয়ে রয়েছে। এই বাবল তাদের নিজেদের কেনা নয়, এক মাহাজন তাদের কিনে দিয়েছেন। সারাদিন তারা দুই ভাই-বোন মিলে বিক্রি করে দেয় আর বিনিময়ে মাহাজন তাদের ২০০ আর ৩০০ করে টাকা দেয়। জাকির হোসেন পায় ৩০০টাকা আর জামিনা পায় ২০০টাকা। আমরা অবাক হয়ে জানতে চাইলাম আপনারা দুইজন তো একই কাজ করেন তাহলে ১০০টাকার তফাৎ কেন? জামিনা আমাদের বললো, “আমি তো মাইয়্যা মানুষ তাই আমার বেতন কম।” আমি জানতে চাইলাম, “আপনি কি কম সময় ডিউটি করেন, নাকি ভাইয়ের সমান সমান ডিউটি করেন?” জামিনা জানায় তারা একই সমান ডিউটি, কাজ, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিক্রি করা ইত্যাদি সব সমান সমান করে। কোনো ঊনিশ বিশ নাই। জামিনা মেয়ে তাই তার বেতন কম। শুধু এই বাণিজ্য মেলায় নয়, অন্য আরো যেসব জায়গায় কাজ করে জামিনা সেখানে ছেলেদের থেকে ওর বেতন কমই থাকে। শুধু এই জামিনা না, সকল জামিনারা কাজ করে ছেলেদের সমান কিন্তু বেতন পায় ছেলেদের থেকে কম।
জামিনার সংসারে কে কে আছে জানতে চাইলে জামিনা জানায় তার ১ছেলে এবং ১মেয়ে। স্বামীর কথা জানতে চাইলে বলে, “জামাই টামাই এর কতা কইতে মন চায় না। ওর কতা আমারে জিগায়েন না।” এই কথা বলেই মহিলা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলো। ভাইও বোনের দিকে তাকিয়ে হাসলো। জাকির হোসেনকে জিজ্ঞেস করলাম তার ছেলে -মেয়ে সম্পর্কে। জাকির হোসেন জানালেন তিনি দুই ছেলের বাবা এবং বউ, ছেলেদের নিয়ে তিনি সুখেই আছেন। জামিনা বাণিজ্য মেলা ছাড়া অন্য সময় বাসা বাড়িতে কাজ করে। জিজ্ঞেস করলাম, “এইবার বেঁচা -বিক্রি কেমন হচ্ছে?” দুই ভাই -বোন মাথা দুইপাশে নাড়িয়ে বললো, “বালা না। আগের বছর এর থেইক্কা বেশি বেছা কেনা আসছিলো।” দুইজনের সাথে আরো কিছু কথা বলা শেষ করে আমরা চলে আসলাম।
ওদের সাথে কথা বলে ভালো লাগছিলো কিন্ত মনের মধ্যে আমার কেমন করছিলো। মেয়ে বলে বেতন কম? কেন? কই কাজ তো কম করতে হয় না, তবে বেতন কেন কম? মহিলা বলে তো ওই জমিনাকে সন্ধ্যার সাথে সাথে বাড়ি ফিরে যেতে দেয় না, মেয়ে বলে তো জমিনার জন্য বসার কোন জায়গা রাখে নাই, তাহলে বেতন কেন কম হবে? প্লিজ আপনাদের দোহাই লাগি আপনারা কেউ আমাকে নারীবাদী বলবেন না। আমি নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে আসি নি। আমি নারীদের প্রাপ্ত বেতন নিয়ে কথা বলছি। ওই বাবল বেঁচার জন্য জাকির যদি ৩০০টাকা পায়, একই কাজ করার জন্য জমিনা কেন ২০০টাকা পাবে? এই উত্তর আপনারাই দিবেন। একই কাজের জন্য নারী বলে পুরুষের তুলনায় বেতন কেন কম হবে আপনারই বলেন। এই উত্তর আপনাদের কাছ থেকেই নিবো। আমি আবার বলছি আমি নারীবাদী না, আমি মানুষবাদী।
নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ১১: ৩০ এ.এম, ৩০ জানুয়ারি ২০১৮,মঙ্গলবার
এএস
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur