একজন বাংলাদেশী তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার । তিনি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির (বিসিএস) সাবেক সভাপতি।
তাঁকে কম্পিউটারে বাংলা ভাষা যুক্ত করার পথপ্রদর্শক মনে করা হয়। তার প্রতিষ্ঠানের বিজয় বাংলা কিবোর্ড ১৯৮৮ সালে প্রকশিত হয় যা প্রথম বাংলা কিবোর্ড এবং ইউনিকোড আসার পূর্বপর্যন্ত বহুল ব্যবহৃত হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও সাধারণ বিষয়ের ওপর অনেকগুলো বইয়ের লেখক তিনি।
তাঁর নতুন পরিচয় হলো তিনি এখন বাংলাদেশ সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রি। সংসদ সদস্য না হওয়ায় তাঁকে মন্ত্রিসভায় টেকনোক্র্যাট হিসেবে নেয়া হয়েছে। বুধবার দপ্তর বন্টনে এই মোস্তাফা জব্বারকে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। এতদিন মন্ত্রণালয়টি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিল। এই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম সরিয়ে তথ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। একই মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির দায়িত্ব পালন করছেন জুনাইদ আহমেদ পলক। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ মন্ত্রিসভার নতুন সদস্যকে শপথ পড়ান। শপথ অনুষ্ঠান শেষ করেই তিনি চলে আসেন চারবার সভাপতির দায়িত্ব পালন করা বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির (বিসিসি) অফিসে। সেখানে মন্ত্রী হওয়া অনুভূতি, মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পেছনের গল্প এবং আগামী দিনের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেন।
শনিবার বিকেল ৩টায় রাজধানীর কারওয়ানবাজারে বিডিবিএল ভবনে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) মিলনায়তনে আয়োজিত সংবর্ধনায় এসে নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন তিনি।
কম্পিউটারে বাংলা ফ্রন্টের উদ্ভাবক মোস্তাফা জব্বার বলেন, আইসিটি খাতের মন্ত্রিত্ব পাওয়া তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনের সেরা সাফল্য। তবে তাঁর মন্ত্রিত্ব আরো আগেই পাওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন মোস্তাফা জব্বার। তিনি জানান, টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় ক্যানসারে আক্রান্ত। অনেক কর্মকর্তাই জানিয়েছেন, একটা কানা গলির মধ্যে দিয়ে সবাই। সেই অবস্থা থেকে আমাদের বের হতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মন্ত্রী বলেন, ‘আমার প্রথম কাজ হবে ইন্টারনেটের দাম কমানো ও গতি বৃদ্ধি করা। ইন্টারনেট ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ আলোচনায় থাকবে না। আমার মন্ত্রণালয়ে বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান এক তরফা ব্যবসা করতে পারবে না। আমার দেশের মার্কেট আমার দখলে থাকবে। বাংলাদেশে কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করতে হলে অবশ্যই দেশের মানুষের প্রতি সম্মান রেখে বাংলায় চিঠিপত্র আদান প্রদান করতে হবে।’
সংবর্ধনা অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বেসিসের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি রাসেল টি আহমেদ। উপস্থিত ছিলেন বেসিসের সাবেক সভাপতি এ তৌহিদ, হাবিবুল্লাহ এন কারিম, সারওয়ার আলম, রফিকুল ইসলাম রাওলি, এ কে এম ফাহিম মাসরুর, শামীম আহসান।
মোস্তাফা জব্বার বলেন, আমার দেশের ১৬ কোটি মানুষের ৯৬ ভাগ ইংরেজি বুঝে না। এজন্য তারা যে ভাষা বুঝে সেই ভাষায় আমাদের কন্টেন্ট তৈরি করতে হবে। শুধু ইংরেজি ব্যবহার না করে ক্ষেত্র বিশেষে বাংলা, ইংরেজি দুটি ভাষায় ব্যবহার করা হবে। ১০০ দিনে কী করা সম্ভব সেসব কাজ করতে হবে। পাঁচ বছরের চিন্তা করলে হবে না।
সংবাদ সম্মেলনে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী বলেন, ‘আমি বিটিআরসির ওপর ক্ষুব্ধ। কেন তারা এখনো ইন্টারনেটের মূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারেনি। কমায়নি।’
মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পেছনের গল্প কী? একটি জাতীয় দৈনিকের এমন প্রশ্নের জবাবে মোস্তাফা জব্বার বলেন, ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমি বেসিসের সভাপতি হিসেবে ১৮ মিনিটের একটি বক্তব্য দিয়েছিলাম। সেখানে আমি প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছিলাম যে, তিনি যদি সহযোগিতা করেন তা হলে আমরা ৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করতে পারব। তিনি কিন্তু সেদিনই প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, এই ৫ বিলিয়ন করতে হলে আমাকে বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে হবে। এই বাড়তি দায়িত্ব পালন করার জন্য তিনি যে আমাকে আজকে মন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করিয়েছেন। এর জন্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। প্রকৃতপক্ষে আমি ব্যক্তি মোস্তাফা জব্বারকে প্রতিনিধিত্ব করছি না। আমি আমাদের দেশের তথ্যপ্রযুক্তির খাত পুরোটার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার চেষ্টা করছি। আমি মনে করি, মোস্তাফা জব্বার মন্ত্রী হয়নি; এ দেশের আইসিটি খাত মন্ত্রী হয়েছে। আমার জন্য যে জায়গাটি সহজ মনে হবে সেটি হচ্ছে- প্রকৃতপক্ষে একটি সরকার যখন ডিজিটাল রূপান্তরের দিকে যায়, তখন যদি তাকে যথাযথভাবে পরিচালনা করা না যায়, তা হলে কিন্তু পুরো সরকার ডিজিটাল হওয়াটা কঠিন হয়ে যায়। আমার দায়িত্ব হবে, আমাকে যেখানে যেই দায়িত্বই দেওয়া হোক না কেন, আমি চেষ্টা করব আমাদের সরকারকে ডিজিটাল রূপান্তর এবং ডিজিটাল শিল্প খাতে যেন বাংলাদেশ নেতৃত্ব দিতে পারে সে জায়গাটি প্রস্তুত করা।
উল্লেখ্য, মোস্তাফা জব্বারের পৈতৃক নিবাস নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে। ১৯৪৯ সালের ১২ আগষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ উপজেলার চর চারতলা গ্রামের নানার বাড়ীতে তাঁর জন্ম। মোস্তাফা জব্বারের বাবা আব্দুল জব্বার তালুকদার পাটের ব্যবসায়ী ও সম্পন্ন কৃষক ছিলেন। তার দাদা আলিমুদ্দিন মুন্সি ছিলেন বিশাল ভূ সম্পত্তির মালিক যার উপাধি ছিলো তালুকদার। তার মা রাবেয়া খাতুন সমগ্র জীবন গৃহিনী হিসেবেই জীবন যাপন করেছেন।
১৯৬০ সালে প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করে তৎকালীন সিলেট জেলার (বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার অধীনস্থ) বিরাট নামক একটি উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে হবিগঞ্জ কেন্দ্র থেকে মানবিক শাখায় মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন এবং মানবিক শাখায় উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ঢাকা কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৯৬৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক সম্মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই পরীক্ষাটি ১৯৭১ সালে হবার কথা ছিলো তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি পরীক্ষা হলেও মুক্তিযুদ্ধের কারণে পরে সেটি বাতিল হয়ে যায়। এরপর তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭২ সালের পরীক্ষা ১৯৭৪ সালে সম্পন্ন করে দ্বিতীয় শ্রেণীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে মোস্তাফা জব্বার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি মুজিব বাহিনীর খালিয়াজুরি থানার সহ অধিনায়ক ছিলেন। তার বাড়ীর পাশের সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার ১৬১ জন রাজাকার যুদ্ধোত্তরকালে তার কাছে আত্মসমর্পণ করে যার মধ্যে ১০৮ জনকে মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করে।
তথপ্রযুক্তিতে বিশেষ অবদান রাখা এবং বিজয় বাংলা কীবোর্ড ও সফটওয়্যার আবিষ্কার করার জন্য তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সেরা সফটওয়্যারের পুরষ্কার, পশ্চিমবঙ্গের কমপাস কম্পিউটার মেলার সেরা কমদামী সফটওয়্যারের পুরষ্কার, দৈনিক উত্তরবাংলা পুরষ্কার, পিআইবির সোহেল সামাদ পুরষ্কার, সিটিআইটি আজীবন সম্মাননা ও আইটি এ্যাওয়ার্ড, বেসিস আজীবন সম্মাননা পুরষ্কার, বেস্টওয়ে ভাষা-সংস্কৃতি পুরষ্কার, বৃহত্তর ময়মনসিংহ সমন্বয় পরিষদ সম্মাননা, বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটি ও সিলেট শাখার সম্মাননা বিশ্বমেধাসম্পদ সংস্থার আবিষ্কারক-উদ্যোক্তার স্বীকৃতি এবং অর্থনৈতিক ও মানবিক উন্নয়ন সংস্থার নেত্রকোণার গুনীজন সম্মাননা, রাহে ভান্ডার এনোবল এওয়ার্ড ২০১৬ (প্রযুক্তিবিদ হিসেবে) এবং এসোসিও ৩০ বছর পূর্তি সম্মাননাসহ ২০টি পুরষ্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। এছাড়াও তার রয়েছে অসংখ্য শুভেচ্ছা সম্মাননা।
বার্তা বিভাগ
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ০১:০৩ পিএম, ৪ জানুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার
ডিএইচ
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur