নিত্য ব্যবহারের জিনিসপত্র থেকে শুরু করে গবাদিপশু, গাড়ি, বাড়ি সবই কেনা যাচ্ছে অনলাইনে। অনলাইন শপিংয়ের এই সময়ে বাদ পড়ছে না মাদকও। অনলাইনে অর্ডার দিলে অন্যান্য পণ্যের মতোই বাসায় পৌঁছে দেয়া হচ্ছে মাদক।
হোম ডেলিভারির এই সুযোগ লুফে নিচ্ছেন এক শ্রেণির মাদকসেবীরা। এ সুযোগ নিচ্ছেন অনেক নারীও। মাদকসেবী ও বিক্রেতাদের অসংখ্য গ্রুপ রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে।
এছাড়াও তারা ভাইবার, ইমো ব্যবহার করে থাকে। নিরাপত্তার জন্য সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও মাদকসেবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। মাদক বিক্রির এ অদৃশ্য হাটে এবার চোখ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের।
অধিদপ্তর সূত্র বলছে, সামনে অনলাইনে মাদক বেচাকেনায় নজরদারি ও জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এরইমধ্যে অভিযানও শুরু হয়েছে অধিদপ্তরের।
চীন থেকে টাইলস আমদানি করতেন রবিউল ইসলাম। রাজধানীর বাংলামোটর এলাকায় তাদের এই টাইলসের দোকানের নাম ছিলো ‘রেইন বাথ’। এই নামে ফেসবুকে পেইজ ও গ্রুপ করেছিলেন। এই গ্রুপে সক্রিয় থাকতেন তার স্ত্রী আসমা আহমেদ ডালিয়া, শ্যালিকা স্বপ্না ও নাসিরসহ আরো অনেকে। গ্রুপে চ্যাট করতেন।
প্রয়োজনীয় কথা বলতে কল করতেন ভাইবার, ইমো ও হোয়াটসঅ্যাপে। তবে এই রেইন বাথের আড়ালে ছিলো ভয়ঙ্কর বাণিজ্য। মরণনেশা ইয়াবা পাইকারি বিক্রি করতেন তারা।
বিশ্বস্ত, পরিচিত বিক্রেতারা গ্রুপে চ্যাট করে অর্ডার দিতেন। কথাগুলো ছিলো সাঙ্কেতিক। অর্ডার নিয়ে যথাস্থানে তা পৌঁছে দেয়া হতো। এমনকি নিরাপদে টাইলসের শোরুম থেকেও ইয়াবা সংগ্রহ করতেন মাদকাসক্তরা।
বিষয়টি নজরে পড়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের। গত ৯ই জুলাই এলিফ্যান্ট রোডের শেল সিদ্দিক বহুতল ভবনে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় রবিউল ইসলাম ও ডালিয়াকে। ধানমন্ডি থেকে ডালিয়ার বোন স্বপ্না ও তার স্বামী শামীম আহমেদ এবং রানী নামে এক নারীকে।
পশ্চিম রাজাবাজার থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ডালিয়া ও স্বপ্নার মা মনোয়ারা বেগমকে। ওই অভিযানে ৫০ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। জিজ্ঞাসাবাদে এই ইয়াবা পরিবারের সদস্যরা জানান চাঞ্চল্যকর তথ্য।
শুধু বাংলামোটরের ওই রেইন বাথ নয়, একইভাবে বংশালের এমএস মার্কেটে ইলেকট্রনিকের পণ্যের গোডাউনে রাখা হতো কোটি কোটি টাকার ইয়াবা। অর্ডার দেয়া হতো অনলাইনে। ১২ই অক্টোবর এমএস মার্কেটে অভিযান চালায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। কোটি টাকা মূল্যের ৩০ হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয় চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন ইসলাম, নোয়াখালীর সুধারামের মোবারক হোসেন বাবু ও ঝালকাঠির দুলাল চন্দ্র শীলকে।
এ ঘটনায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়। একটি মামলার বাদী মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মো. হেলাল উদ্দিন জানান, এই চক্রের মূলহোতা নাসির উদ্দিন। তারা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে মাদক ঢাকায় পাঠাতো। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য অনলাইনে অর্ডার নিতো।
বিশেষ করে চ্যাটের মাধ্যমে অর্ডার নেয়া হতো। কথা বলতো ইমো, ভাইবার ও হোয়াটঅ্যাপে। অর্ডার আগেই নিয়ে রাখার কারণে মাদক পৌঁছার পরপরই ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হতো। তাদের ক্রেতারা মূলত মাদকের ছোট পর্যায়ের ব্যবসায়ী। এই ব্যবসায়ীরা পরে খুচরা বিক্রি করতেন। চক্রের অনেকে গ্রেপ্তার হলেও মূলহোতা নাসির উদ্দিন পলাতক।
তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানান মো. হেলাল উদ্দিন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে রয়েছে ডিজে পার্টি ঢাকা, ডিজে ঢাকা এরকম নানা নামের পেইজ। এতে রয়েছে বিভিন্ন পার্টি সংবাদ সংক্রান্ত পোস্ট।
ইরফান আদনান নামে নিকেতনের এক যুবক জানান, একবার অনলাইনে পার্টির টিকিট নিতে গিয়ে ফোন ও মেইল ঠিকানা দিয়েছিলেন তিনি। তারপর থেকে তার ইমোতে কল দিয়ে প্রায়ই আমন্ত্রণ জানানো হয়। নানা ধরনের প্রস্তাব দেয়া হয়। কিছুদিন আগেও গাজীপুরের একটি রিসোর্টে ডিজে পার্টি হচ্ছে জানিয়ে তাকে ইমোতে কল দিয়ে বলা হয়, ‘স্যার, আপনারা ক’জন আসবেন। কাপল হলে একটি টিকিটের মূল্য অর্ধেক রাখা হবে। আর আপনি একা এলে আমাদের ব্যবস্থা আছে। আপনি চাইলে আমরা এসকর্টের ব্যবস্থা করে দেব। সব ধরনের ড্রিংকস রয়েছে এখানে। তবে বাবা পেতে হলে আগে অর্ডার প্লিজ।’ এভাবেই নিরাপদে অনলাইনে চলছে পার্টির নামে লাগামহীন ভয়ঙ্কর বাণিজ্য।
মোহাম্মদপুরের একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন সুচন্দা ছন্দা (ছদ্ম নাম) জানান, তিনি অনলাইনেই মাদকের অর্ডার দিতেন। টাকা দিতেন সরাসরি, কখনও অগ্রিম পাঠিয়ে দিতেন বিকাশে। বন্ধুদের সঙ্গে শখের বসে গাঁজা সেবন করেছিলেন কয়েকবার। কখনও ভাবতে পারেননি মাদকে আসক্ত হবেন তিনি।
সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যেই দুঃসহ যন্ত্রণা তাকে চেপে বসে। কয়েক বছর প্রেম করেছেন। স্বামী-স্ত্রীর মতো সময় কাটিয়েছেন তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মায়ের পছন্দে প্রেমিক অন্য মেয়েকে বিয়ে করে ঘর বাঁধে। তারপর থেকে স্বেচ্ছায় ঘরবন্দি ছন্দা।
পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে ফেসবুকের ইনডেক্স চ্যাট করেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই যেন ভালো লাগে না। এরমধ্যেই এক বন্ধুর কাছে গাঁজা খুঁজেন তিনি। সেই বন্ধু তাদের একটি গ্রুপে যুক্ত করে নেয় ছন্দাকে। ফেসবুকের ওই গ্রুপ মাদক বিক্রি করে।
একইভাবে বলে দেয়া হয় সেবনের পদ্ধতি। এমনকি ইউটিউবেও সেবনের পদ্ধতি সংবলিত ভিডিও আপলোড করা রয়েছে তাদের। প্রথম ক’দিন সেবন করলেও পরে দুর্গন্ধের কারণে তা থেকে সরে যান। শুরু করেন ইয়াবা সেবন। ওই গ্রুপের বন্ধুরা শিখিয়ে দেয় কিভাবে ইয়াবা সেবন করতে হবে।
ছন্দা জানান, তিনি নিজেও ঘনিষ্ঠ কয়েক বন্ধুকে নিয়ে গ্রুপ করেছিলেন। সেখানে কথা বলে প্রায়ই বন্ধুরা মিলে বাসায় আড্ডার ব্যবস্থা করতেন। আড্ডায় মাদক সরবরাহ করতো অনলাইনের বন্ধুরা। কয়েক বন্ধু ছিলো যারা নিজেরা মাদক সেবন ও বিক্রি করতো।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক খুরশিদ আলম বলেন, ভাসমান মানুষ থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষিত পর্যন্ত মাদকের ভয়াল থাবায় আক্রান্ত। শিক্ষিত মাদকসেবী-ব্যবসায়ীরা তথ্য প্রযুক্তির সুবিধা নিচ্ছে। ফোন, ইমো, ভাইবার, ফেসবুকে তারা অর্ডার দিচ্ছে। কথানুসারে সরবরাহ করা হচ্ছে। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও মাদক প্রতিরোধ করতে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (গোয়েন্দা ও অপারেশন) সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমেদ বলেন, অপরাধীরা যেভাবে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। তাদের শনাক্ত করতে আমাদেরও সে ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা উচিত। দক্ষ জনবলও প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত সে ধরনের সাপোর্ট মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের নেই। (মানবজমিন)
নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৩:১০ এএম,২৮ নভেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার
ডিএইচ