‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক কথা। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচিত ‘কপালকুন্ডলা’ উপন্যাসের নায়ক নবকুমার’কে উদ্দেশ্য করে নায়িকা কপালকুন্ডলার বলা উক্তিটি আজ মনে পড়ছে দেশের প্রাথমিক সমাপনি পরীক্ষার হাল চিত্র দেখে।
‘কপালকুন্ডলা’ উপন্যাসের নায়ক সমুদ্র যাত্রায় ফিরে যাওয়ার সময় রান্না জন্যে লাকড়ি সংকট মেটাতে সমুদ্র তীরে যাত্রা বিরতি করে। শুকনো কাঠ সংগ্রহে নবকুমার বনে প্রবেশ করে।
সমুদ্র তীর বেয়ে নির্জন বন থেকে শুকনো গাছের ডাল সংগ্রহ করে ফিরে আসতে দেরি দেখে যাত্রীদের মধ্যে নানা মন্তব্য শুরু হয় । কেউ কেউ বলেছিল নবকুমা’কে বনের বাঘ সাবাড় করেছে তাই ফিরছে না। এরই মধ্যে জাহাজের নাবিক ও অন্যান্য যাত্রীরা নবকুমারের অপেক্ষা না থেকে জোয়ার আসার সাথে সাথে যাত্রা করে। নবকুমার ছাড়াই জাহাজটি ছেড়ে দেয়।
শুকনো গাছের ডাল সংগ্রহ করে নবকুমার সমুদ্র পাড়ে ফিরে এসে দেখে জাহাজটি নেই। নিরূপায় নবকুমার সমুদ্র পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে সূর্য অস্তে যাওয়ার শেষ লগ্নে ফিরিবা মাত্র দেখিলেন নিরাবরণ অপূর্ব রমণীমূর্তি নায়িকা ‘কপালকুন্ডলাকে’। জনশূন্য বালুময় রশ্মিতে কপালকুন্ডলা নবকুমারকে দেখতে পেয়ে বলে, ‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ’।
‘কপালকুন্ডলা’ উপন্যাসের নায়ক নবকুমারের মতোই কি আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা ‘পথ হারাইয়াছে’ ? পিইসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী নবীন মেধাবীরা এক রকম অজ্ঞতাস্বরে নকলের দিকে ঝুঁকে পড়ছে । যাদের ওপর পরীক্ষার নামে প্রশ্ন ফাঁস আর নকলের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। তার কি বুঝে দেখে লিখলে কি হবে আর না দেখে লিখলে কি হবে? এ ভাবে পাবলিক পরীক্ষা চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ মেধাবীরা পঙ্গুত্ব্ বরণ করবে।
পাবলিক পরীক্ষা গুলোতে যতই প্রশ্ন ফাঁস,নকল আর জিপিএ-৫ এর প্রতিযোগিতা বাড়ছে ততোই মেধাবী নিখোঁজের তালিকা বাড়ছে। প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িত বা সন্দেহভাজনদের তালিকায় শিক্ষক সমাজকে যতটুকু দায়ী করা হচ্ছে ;তার চাইতে বেশি দায়ী ও অপরাধী অভিভাবক শ্রেণি বিশেষ।
তারা নিজেদের ফ্রেসটিজ রক্ষার্থে পরীক্ষার আগের দিন রাতে প্রশ্নের উত্তরসহ সন্তানের হাতে তুলে দিয়ে পরীক্ষার হলে পাঠায়। একজন মেধাবী ছাত্রের হাতে যখনি নকল আর প্রশ্ন পরীক্ষার পূর্বে তুলে দেয়া হয়, তখন ওই ছাত্রের মেধার অবক্ষয় শুরু হয়।
যদিও উপরোক্ত কথাগুলো আমার বলা ঠিক হয়নি। তবুও বলতে চাইছি, মেধাবীদের রক্ষার জন্যে দেশের শিক্ষা অধিদপ্তরকে সচেতন হতে হবে।
বহুতল ভবন নির্মাণে রড ব্যবহার না করে বাঁশ ব্যবহার করা হলে ওই ভবনের ভীত কেমন হবে? রডের বদলে বাঁশ ব্যবহার যেমনি উপহাসের পাত্রে পরিণত হয়। ঠিক তেমনি পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে পরীক্ষার্থীদের হাতে উত্তরপত্র প্রস্তুতি হিসেবে দেয়া হলে ‘উবাচ’ ছাড়া আর কিছুই নয়।
রড হল ধাতব পদার্থ আর বাঁশ হলো উদ্ভিদজাত জড় পদার্থ। যা বেঁকে যাওয়ার আগেই ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যদি পরীক্ষার শুরু থেকে নকল আর প্রশ্ন ফাঁসের তান্ডব চলতে থাকে তবে বলবো, ‘প্রশ্ন ফাঁসের ফলে মেধাবীদের বাঁশ’দেয়া হচ্ছে। যার ভীত শক্ত নয়। ভবিষ্যৎ জাতিকে রক্ষার জন্যে হলেও সকল পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করা জরুরি। তা না হলে জাতির জন্যে একটি ভয়াবহ বিপর্যয় বয়ে আসতে পারে।
‘বাঁশ’ শব্দটি একই উদ্ভিদজাত গাছ। কিন্তু আঞ্চলিকতার টানে বজ্জাত ব্যঙ্গ শব্দও বটে। একজন আরেকজন ব্যক্তিকে ফাঁদে ফেলে বলে বাঁশ দিয়েছি,কেমন হয়েছে। ঠিক তেমনি পরীক্ষার পূর্বে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে পরীক্ষায় পাশের যে আয়োজন চলছে এতে মেধাবীদের পাশের বদলে বাঁশ দেয়া ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য নয়।
যাত্রীদের অভিমত ছিল নবকুমারকে বনের বাঘ সাবাড় করেছে। আর দেশের সচেতন মহলের অভিযোগ-প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী কোমলমতি মেধাবীদের কোন জন্তু সাবাড় করছে ? সবে মাত্র ওরা শিক্ষা জীবনের প্রথম স্তর পার করে সার্টিফিকেট অর্জন করতে চলছে। তার মধ্যে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে নকলের বোঝা।
প্রশ্ন ফাঁসের গৌরব নতুন কিছু নয়। যা প্রতিবছরের ন্যায় এবারও পিএসসি পরীক্ষার্থীদের মাঝে কৌতুহল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। পরীক্ষায় এ যেন নিত্য কর্মে পরিণত হয়েছে। এবারের পিএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় অতীতকে ছাড়িয়েছে। দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহারের পরেও রোখানো যাচ্ছে না প্রশ্ন ফাঁস।
ডিজিটাল যুগের প্রযুক্তিগত পদ্ধতিতে যে জালিয়াতি হচ্ছে তার ফলে মেধাবীদের খোঁজে বের করা মুশকিল হয়ে পড়েছে। পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের প্রতিযোগিতায় মেধাবীরা নির্ধিদায় হারিয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় হচ্ছে একটি শিক্ষিত জাতির গড়ার প্রথম স্তর।
শিক্ষার প্রথম সিঁড়ি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দীর্ঘ ৫ বছর অতিবাহিত করে দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা বাড়াবার পূর্বে হোঁচট খেয়ে আছড়ে পড়ছে কোমলমতি শিশুরা। শিক্ষা নিয়ে এ কেমন অরাজ্যকতা সৃষ্টি হয়েছে ? এর ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অন্ধকারে ধাবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার, ওয়াসআপ, ইমো এসব তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর যোগাযোগ মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে প্রশ্নপত্র।এমনকি সন্তানের ভালো ফলাফল অর্জন করার জন্যে অভিভাবকরা টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র ম্যানেজ করছে। হাত বাড়ালে সহজেই প্রচারপত্রের মতো যেখানে সেখানে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে সমাপনি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র।
তথ্যপ্রযুক্তির যুগে না পড়েও যখন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সহজে মিলছে পাশ। যার ধরুন একজন মেধাবী ছাত্রের মনোবল ভেঙ্গে পড়ছে। পরীক্ষার সময় রাত জেগে পড়াশুনা করে ভালো ফলাফল অর্জন করতে না পারায় কিংবা সহপাঠী বিদ্যালয়ের অমনযোগী ছাত্রের ফলাফল আর নিজের ফলাফলের তফাৎ দেখে।
‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে’ কবি গোলাম মোস্তফার কবিতার চরণটি আমাদেরতে ভাবিয়ে তুললেও পিইসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় নিস্তব্ধ করে দেয়।
মেধাবীরা নিরবে কাঁদে,তাদের কান্নার কোনো শব্দ নেই। শব্দহীন কান্না পৌঁছায় না কর্তৃপক্ষের কানে। যার কারণে মেধার মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় না।
শুধুই জিপিএ মানের উচ্চাঙ্খায় মেধাবীদের পিছিয়ে ফেলে সামনে এগিয়ে যারা তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ধেয়ে আসছে।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাগুলোর ফলাফলের দিকে নজর দিলে দেখায়, জিপিএ-৫ অর্জনকারী ছাত্রছাত্রীরা সবার আগে বর্জন হয়ে যায়। কারণ মেধার মূল্যায়ন হ্রাস পেয়েছে।
মেধাবীরা কাঁদো,যত পার কাঁদো। তোমাদের কান্না শুনার কেউ নেই। ড.জাফর ইকবাল স্যার বিশ^বিদ্যালয়ের পরীক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে একটি কলাম লিখেছেন,‘বাজায় আমার ভাঙ্গা রেকড’। পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তনের জন্যে তিনি বহুবার লিখেছেন । কিন্তু এ নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। অভিভাবক মহলের মাঝে সচেতনা সৃষ্টি আর শিক্ষক সমাজের বৈষম্য নীতি জাগ্রত না হলে এটি ঘটতে থাকবে। রোখানো সম্ভব হবে না প্রশ্ন ফাঁস।
লেখক-গাজী মহিনউদ্দিন,
সংবাদকর্মী,
অধ্যয়নরত: চাঁদপুর সরকারি কলেজ (বাংলা বিভাগ)
আপডেট,বাংলাদেশ সময় ১১:১০ পিএম,২৬ নভেম্বর ২০১৭,রোববার
এজি