Home / সারাদেশ / শিক্ষার মানোন্নয়নে জেলা-উপজেলা শিক্ষা কমিটি গঠনসহ ২৬ প্রস্তাব

শিক্ষার মানোন্নয়নে জেলা-উপজেলা শিক্ষা কমিটি গঠনসহ ২৬ প্রস্তাব

পাঠদানের গুণগতমান নিশ্চিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম তদারকিতে জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছেন জেলা প্রশাসকরা। সারা দেশে নামে-বেনামে গড়ে উঠা ভুইফোঁড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধে মন্ত্রণালয়ের কঠোর পদক্ষেপ,জেলা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রতিটি জেলায় একটি ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন,শহরাঞ্চলে অবস্থিত সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের গ্রামের স্কুলগুলোতে অতিথি শিক্ষক হিসেবে পাঠানো এবং ‘শিক্ষা টিভি’ নামে একটি চ্যানেল তৈরিসহ ২৬টি প্রস্তাব করেছেন জেলা প্রশাসকরা।

সোমবার (১৫ জুলাই) সচিবালয়ে মন্ত্রিসভা কক্ষে ডিসি সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের তৃতীয় অধিবেশনে ডিসিরা এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন। শিক্ষামন্ত্রী ডা.দীপু মনি প্রধান অতিথি ছিলেন। শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলও উপস্থিত ছিলেন।

বিভিন্ন জেলা প্রাশাসকরা ২৬ টি প্রস্তাব দিয়েছেন। এর প্রেক্ষিতে সবকটির মতামত দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরমধ্যে জাতীয় পর্যায়ের কয়েকটি ইতিবাচক প্রস্তাবের সাড়া দেয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেছেন। জেলা প্রশাসকদের মতে,উপজেলা শিক্ষা কমিটির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এ কমিটির মাধ্যমে শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হবে এবং এসডিজি বাস্তবায়ন গতিশীল হবে।

এছাড়া জেলা শিক্ষা কমিটির মাধ্যমে শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ নেয়া যাবে।এ কমিটির মাধ্যমে শিক্ষা গুণগতমান নিশ্চিত কর সম্ভব হবে। এ কমিটি গঠন করা হলে স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসাগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নে প্রাধিকার নির্ধারণ করা সম্ভব হবে।

জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে আসা ২৬টি প্রস্তাবের বাকিগুলো হলো-দেশের প্রত্যেক জেলা সদরের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি ভার্সন এর একটি শিফট চালু, ভূমিবিষয়ক আইন পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা শিশু কর্মকর্তাসহ শিক্ষাক্ষেত্রে কর্মরত এনজিও, সুশীল সমাজের লোকদের সমন্বয়ে ‘ত্রৈমাসিক শিক্ষা সম্মেলন’ নামে সভা আহ্বান করা ।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নির্বিচারে বেরসকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ও বিএড কলেজের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। অনুমতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা যাচাই করার জন্য জেলা পর্যায়ে কমিটি ও কমিশন গঠন করা এবং টিটিসি ও বিএড কলেজ অনুমোদনের আগে এর প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণে জেলা পর্যায়ে কমিটি যাচাই করা,বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পরিবহনের জন্য প্রতি জেলায় একটি করে কাভার্ড ভ্যান প্রদান,বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের দায়িত্ব প্রদান ।

দেশের চরাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষাদানের জন্য স্থানীয়ভাবে চুক্তিভিত্তিক যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ করার বিধান চালু,দেশের কিন্টারগার্টেন ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিবন্ধন প্রক্রিয়া আরও সহজতর করা যেতে পারে এবং বিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষা বিভাগের নিয়মিত পরিদর্শনের আওতায় আনা,ইংরেজি শেখানোর বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজি শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধি করা,সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে বেরসকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ হতে বিরত রাখা,বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে টিউশন ফি ব্যয়ের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করা এবং ‘শিক্ষা টিভি’ চ্যানেল তৈরি করার প্রস্তাব দেন জেলা প্রশাসকগণ।

সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্রই জনসচেতনতা তৈরি করার জন্য জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) নির্দেশ দেন শিক্ষামন্ত্রী ডা.দীপু মনি। নামে বেনামে ভুইফোঁড় শিক্ষা গড়ে উঠেছে জেলা প্রশাসকরা এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মন্ত্রী বলেন,‘সরকারের অনুমতি ছাড়া যাতে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে কিংবা কোনো ধরনের কার্যক্রম চালাতে না পারে তদারকি করতে বলা হয় ডিসিদের।’

ডিসিদের শিক্ষামন্ত্রী বলেন,‘যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতা বিরোধীদের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে-সেগুলো কঠোর মনিটরিং করার নির্দেশ দেন । ’

নামি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অতিথি শিক্ষক হিসেবে নিয়ে প্রত্যন্ত এলাকার স্কুলে ক্লাস নেয়ার প্রস্তাব করেছিলেন ডিসিরগণ। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শিক্ষামন্ত্রী বলেন,‘ ঢাকায় বা অন্য জায়গায় অত্যন্ত ভালো কিছু বিদ্যালয় আছে যেগুলোর অনেক সুনাম আছে। সেখানকার শিক্ষকদের অনেক সুনাম আছে। একটা প্রস্তাব আছে তাদের অতিথি শিক্ষক হিসেবে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার।’

শিক্ষামন্ত্রী বলেন,‘আমরা যেটা বলেছি, তার চেয়ে বরং খুব কম খরচে, এখন তো টেলিভিশনের দাম তেমন না। সব বিদ্যালয়ে কিন্তু সে টেলিভিশনের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন বিদ্যালয়ের খুব ভালো ভালো শিক্ষকদের ভালো ক্লাসগুলোকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে একই সঙ্গে সব স্কুলে দেখাতে পারি। সেজন্য একটা শিক্ষা টিভি জাতীয় কোনো কিছু চিন্তা করা যায় এবং সেটি করা গেলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের যারা শিক্ষক আছেন তারাও শেখানো পদ্ধতি থেকে উপকৃত হবেন।

শিক্ষামন্ত্রী ডা.দীপু মনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা সব জায়গায় অর্থাৎ যে যেখানেই থাকুক একই মান, ধরনের ও উচ্চমানের শিক্ষকদের শিক্ষাদান-পাঠদানে উপকৃত হবে। আমরা এ বিষয়ে (শিক্ষা টিভি) কথা বললাম, সেটি নিয়ে আমরা চিন্তা-ভাবনা করবো এবং আগামি দিনে কী পরিকল্পনা করা যায় সেটি দেখবো।’

মন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য বাংলা ও ইংরেজি পড়তে, লিখতে ও শুনতে পারছে কিনা- ঠিকমতো সেই দক্ষতাগুলো যেন তারা অর্জন করতে পারে সে বিষয়ে জোর দিয়েছি। মানবিক মূল্যবোধগুলো যেন প্রাথমিক থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রোথিত করে দিতে পারি- যাতে তারা সুনাগরিক হতে পারে, ভালো মানুষ হতে পারে। এছাড়া কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা, নোট বই-গাইড বই যেন একেবারেই না থাকে,অবকাঠামো উন্নয়ন যেন মান সম্পন্ন হয়, খেলার মাঠ যেন নষ্ট না হয়, কারিগরি শিক্ষার দিকে আকৃষ্ট করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় সংগীত গাওয়া, জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা- এগুলো নিয়ে জেলা প্রশাসকদের কাজ করবার সুযোগ রয়েছে, সেগুলো নিয়ে আমরা কথা বলেছি। ডা. দীপু মনি বলেন, উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা কমিটির মতো জেলা পর্যায়েও সেরকম কমিটি করা এবং মাসিক সমন্বয় সভায় বিষয়গুলো যেন উত্থাপিত হয় এবং মনিটরিংয়ের কাজগুলো যেন ভালোমতো হয়, এ বিষয়গুলো ডিসিদের বলা হয়েছে।’

ডিসিদের সন্তানদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, নিয়ম আছে যখন সরকারি কর্মকর্তারা বদলি হয়ে যান তখন সন্তানেরা সেখানকার সরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেন। কোটা রাখলে ভর্তি না হলে আসন নষ্ট হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং দফতরের কর্মকর্তাদের সন্তানদের ভর্তির জন্য কোটা আছে,সেটা আসলে ব্যবহৃত হয় না।’

সেটা কী উঠিয়ে দেবেন- প্রশ্নে শিক্ষামন্ত্রী বলেন,‘ বিচার-বিবেচনা করে দেখতে পারি এটার আদৌ প্রয়োজনীয়তা আছে কি না? ডিসিদের বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রশ্নে ডা.দীপু মনি বলেন,এটি একটি প্রক্রিয়ার বিষয়। প্রস্তাব আসলে সে ব্যাপারে কী করা যায়, সেটা আমরা ভেবে দেখবো।’

মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের আহ্বান গণশিক্ষা সচিবের । সম্মেলনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ছাড়াও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও সচিব এতে অংশ নেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপস্থাপনায় ওই মন্ত্রণালয়ের সচিব মো.আকরাম-আল-হোসেন নতুন প্রজন্মের জন্য সঠিক মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য একসাথে কাজ করতে জেলা প্রশাসকদের আহ্বান জানান। একই সাথে দেশের সার্বিক উন্নয়নের অংশ হিসেবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম বাস্তবায়নে জেলা ডিসিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অংশীদারিত্ব রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

গণশিক্ষা সচিব আকরাম-আল-হোসেন বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা সুষ্ঠু-নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠান,শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগে সভাপতির দায়িত্ব পালন,বিদ্যালয় পরিদর্শন, স্কুল সরকারিকরণে গঠিত জেলা টাস্কফোর্সের প্রধানের দায়িত্ব পালন,উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর গণশিক্ষা কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়ন ও উন্নয়ন প্রকল্প পরিদর্শন কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে জেলা প্রশাসকগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন।

বর্তমান সরকারের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় গুণগত পরিবর্তন এসেছে উল্লেখ করে গণশিক্ষা সচিব জানান, ২০০৯ সালে ছাত্র শিক্ষক অনুপাতের নির্ধারিত লক্ষ্য ১:৪৬ এর জায়গায় বর্তমানে ১:৩৬ এ উন্নীত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার বর্তমানে ১৮.০৬ %, যা নিম্নগামী হয়েছে। ছাত্রছাত্রী অনুপস্থিতির হার ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।

বার্তা কক্ষ
১৬ জুলাই ২০১৯