১৯৭১ সালে ৪ ডিসেম্বর চাঁদপুর নৌ-বন্দরের ৬ কি.মি. উত্তরে এখলাছপুরের কাছে ৩ জন আত্মঘাতী নৌ-কমান্ডো এম ভি শেমী ডুবিয়ে দেয়। এম ভি শেমী চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুর নৌ-বন্দর হয়ে পাক হানাদাররে জন্যে গোলাবারুদ অস্ত্র ও রসদ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছিল।
চাঁদপুর সদরের কল্যাণপুর ইউনিয়নের ডাসাদী গ্রামের কৃতি সন্তান ও স্বাধীনতা যুদ্ধের অকুতোভয় সৈনিক আত্মঘাতী নৌ-কমান্ডো ও স্বাধীনতার পর নায়েক সুবেদার সহকারী এবং পরবর্তীতে বি ডি আর এর সহকারী পরিচালক মো.সালাউদ্দিন আহম্মেদ এর লেখা ’মেঘনা বক্ষে জলবিচ্ছু’ নামে এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়।
৪ নভেম্বর ১৯৭১ সালের পরন্ত বিকেলের জনৈক ইব্রাহিম নৌ-কমান্ডোদের গোপন আস্তানায় খবর দেন যে এখলাছপুরের কাছে পাক হানাদারদের একটি রসদ ,গোলাবারুদ ও একটি কাটা জীপসহ একটি জাহাজ উত্তরমুখী হয়ে নোংর করে আসছে। সাথে সাথে নৌ-কমান্ডো শাহজাহান সেলিমকে নিয়ে নদীর তীরে এসে বাইননোকুলারের সাহায্যে জাহাজটির অবস্থান নিশ্চিত হয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল এটাকে যেভাবেই হোক ডুবাতে হবে।
ঠিক সন্ধ্যার পর পর আত্মঘাতী নৌ-কমান্ডো সালাউদ্দিন,আত্মঘাতী নৌ-কমান্ডো শাহজাহান ও সেলিম এ ৩ জন একটি বড় ঘাসী নৌকায় দ্রুত বাদাম উড়িয়ে পাক হানাদাদের জাহাজটির অভিমুখে রওনা হলো। জাহাজের কাছে যেয়ে বুঝতে পারলো যে,এটি যান্ত্রিক ত্রুটির জন্যেই এখানে নোঙ্গর করে আছে এবং তীর থেকে প্রায় ৫-৬ ’শ গজ দূরে অবস্থান নিয়েছে।
জীবন বাজি রেখে পরিকল্পনা মতে,আত্মঘাতী নৌ-কমান্ডো সালাউদ্দিন ও আত্মঘাতী নৌ-কমান্ডো শাহজাহান কবীর প্রতিকূল প্রচন্ড ঠান্ডা আবহাওয়া ও ঝাপসা বাতাস উপেক্ষা করে মাইন ও অপারেশনের অন্যান্য উপাদান সামগ্রী নিয়ে কচুরিপানার মতো ভেসে ভেসে ঐ জাহাজটির নিকট গিয়ে মাইন স্থাপনের কার্যক্রম শুরু করে ।
সেলিম তখন পালতোলা নৌকা নিয়ে উত্তর দিকে মাঝির বেশে এম ভি শেমীকে অতিক্রম করে চলে গেল। মাইন স্থাপন শেষে নোঙ্গরের চেইন ধরার সময় পাক হানাদাদের নজরে পড়ে গিয়েও আল্লাহর অশেষ রহমতে জীবন বেঁচে যায় এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা তীরে অবস্থান করতে সক্ষম হয়।
এর পর পর শত্রুরা কিছু আঁচ করতে পেরে এলাপাতারিভাবে পানিতে গুলিবর্ষণের সময়ই বিকট শব্দে মাইন বিস্ফোরিত হয়ে শত্রু জাহাজটি আস্তে আস্তে ডুবতে শুরু করে। বেশ ক’জন এ দেশীয় দোসর ও পাক হানা সাঁতরিয়ে ওপরে উঠলে স্থানীয় নৌকার মাঝিরা তাদের নৌকার বৈঠা,বাঁশ ও পাটাতন দিয়ে আঘাত করে ১০-১৫ জন পাকহানা ও দোসরদের হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার দীর্ঘ ৭-৮ বছর পর ৩ মার্চ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশ রাইফেলস এর বাৎসরিক পুর্নমিলনী উৎসবে স্বীকৃতি স্বরূপ আত্মঘাতী নৌ-কমান্ডো সালাউদ্দিন আহম্মেদকে বীর উত্তম পদে ভূষিত করেন।
পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশের রাইফেলেসের সহকারী মহাপরিচালক পদে আসীন হন।
দূর্ভাগ্য স্বাধীনতাযুদ্ধেও বীর সৈনিক মো. সালাউদ্দিন আহম্মেদ (বীর উত্তম) ১৯৯০ সালে লীভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত হন। দেশে-বিদেশে সকল প্রকার সরকারি চিকিৎসার পর ২ জুন ১৯৯৫ সালে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
আমার জানামতে, তার পরিবারটি এখন বাংলাদেশে রাইফেলেসের পিলখানাস্থ সরকারি একটি বাসায় বসবাস করছেন।
আত্মঘাতী অপর সেলিমের সঠিক তথ্য জানা যায় নি। তবে শহীদ ইব্রাহিম বিএবিটির সুযোগ্য সন্তান আত্মঘাতী নৌ-কমান্ডো মো.শাহজাহান কবীর সাজু (বীর প্রতীক) ঢাকায় জীবন যাপন করছেন বলে জানা যায়।
বাংলাদেশ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধেও বেশ কিছু সংখ্যক নৌ-কমান্ডো অপারশেনের মধ্যে চাঁদপুর নৌ-বন্দরের উত্তরে এখলাছপুরের সন্নিকটে এভ ভি শেমী ডুবানোর অপারেশনটিও একটি উল্ল্যেখযোগ্য হয়ে আছে। জাতি ও দেশের সেই সন্তানদেও নিয়ে গর্ববোধ করবে।
প্রতিবেদক : আবদুল গনি
১৪ ডিসেম্বর , ২০১৮ শুক্রবার